চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরে সরকার পরিচালনা ও উন্নয়নের জন্য যে পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের পরিকল্পনা করা হয়েছিল, আয়ের উৎসগুলো সেই হারে সাড়া দিচ্ছে না। বাস্তবতা বিবেচনায় ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করছে সরকার। আর আয়ের সঙ্গে সংগতি রেখে বাজেটে বড় ধরনের কাটছাঁটের চিন্তা করা হচ্ছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটের আকার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। এখন সেখান থেকে প্রায় সাড়ে ১০ শতাংশ কমিয়ে ফেলা হচ্ছে। এতে ৮০ হাজার কোটি টাকা কমে সংশোধিত বাজেটের আকার দাঁড়াবে ৬ লাখ ৮১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। গত (২০২২-২৩) অর্থবছর সংশোধিত বাজেটের আকার ছিল ৬ লাখ ৬০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা।
সূত্রমতে, এর আগে সরকারের আর্থিক, মুদ্রা ও বিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা কমিটির বৈঠকে প্রাথমিকভাবে মূল বাজেট থেকে ৫১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা ছেঁটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। গত বছরের ৭ ডিসেম্বর তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে ভার্চুয়াল মাধ্যমে ওই সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। তবে সে সময় কমিটির কাছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর-পরিদপ্তরের অর্থবছরের ৬ মাসের হালনাগাদ আয়-ব্যয় এবং বাস্তবায়ন অগ্রগতির পূর্ণাঙ্গ তথ্য ছিল না। জানুয়ারির শেষদিকে অর্থবিভাগের হাতে সেইসব তথ্য এসেছে। তার ভিত্তিতে দ্বিতীয় দফা মূল্যায়নে বাজেট থেকে নতুন আরও ২৮ হাজার ২১৫ কোটি টাকা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
অর্থবিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, চলতি অর্থবছরের জন্য ঘোষিত বাজেট পরিকল্পনাটি ছিল অনেক উচ্চাভিলাসী। কিন্তু অর্থবছরের মাঝপথের মূল্যায়ন ও অভ্যন্তরীণ এবং বৈশ্বিক বাস্তবতা বলছে, সেই বাজেট এবার অন্তত বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না।
কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, রিজার্ভে ঘাটতি, ডলার সংকট, আমদানিতে কড়াকড়ি, সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্র সাধন এবং প্রকল্পের ব্যয়ে লাগাম টানার জেরে বর্তমানে অর্থনীতিতে চাহিদা ও জোগানের মধ্যে বড় ধরনের অসমতা তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। এ ছাড়া বৈদেশিক ঋণের অর্থছাড় আশানুরূপ না হলেও আগের ঋণের সুদাসল পরিশোধের মাত্রা বেড়েছে। আবার মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাওয়ার ভয়ে সরকারের প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের অর্থ জোগানের ক্ষেত্রে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ গ্রহণও সংকুচিত হয়ে পড়েছে। কঠোর মুদ্রানীতি প্রয়োগের মাধ্যমে দফায় দফায় নীতি সুদহার বাড়ানোর কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য ও উৎপাদন ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। কমে গেছে নতুন বিনিয়োগ। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অর্থ বিভাগ চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে বিভিন্ন খাতের প্রাক্কলন পুনর্নির্ধারণ করতে যাচ্ছে।
আগামী মার্চে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সভাপতিত্বে সরকারের আর্থিক, মুদ্রা ও বিনিময় হার-সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা কমিটির দ্বিতীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। ওই বৈঠকে অর্থ মন্ত্রণালয় উপস্থাপিত চলতি অর্থবছরের বাজেটের বাস্তবায়ন অগ্রগতি এবং তার ভিত্তিতে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের সম্ভাব্য রূপরেখা তুলে ধরা হবে।
এ মুহূর্তে সরকারি ব্যয়ে বড় ধরনের কাটছাঁটের উদ্যোগকে সঠিক ও যথার্থ বলেই মন্তব্য করেছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। এ বিষয়ে তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘সরকার এ মুহূর্তে খরচ যত কম করবে, বাজেটে বাস্তবায়নে চাপও তত কমবে। কারণ একটি বিষয় স্পষ্ট যে, এবার নানা কারণে প্রবৃদ্ধির হার খুব একটা বাড়বে না। বিনিয়োগ কিংবা কর্মসংস্থানও সন্তোষজনক নয়। গত ৬ মাসের এডিপি বাস্তবায়ন হারও মাত্র ২২ দশমিক ৪৮।’
এ অবস্থায় বাকি সময় তরিঘড়ি করে বেশি ব্যয় না করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘সরকারের উচিত ব্যয়ের আকার ৯০ হাজার থেকে এক লাখ কোটি টাকা কমিয়ে ফেলা।’
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘এই মুহূর্তে প্রয়োজন নেই এমন খাতে বাজেটে ব্যয় যত কমানো হবে, সেটি সরকার এবং সাধারণ মানুষের জন্য ততই মঙ্গল। বাজেট কতটা বাস্তবায়ন হলো সেদিকে না তাকিয়ে সরকারের এখন উচিত মূল্যস্ফীতি কমানোর দিকে নজর বাড়ানো। সেই সঙ্গে ডলার রেট, মুদ্রাবাজার ও সুদহারের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি দেওয়া এবং এসবের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় তৈরি করা।’
বাজেটে দুধরনের ব্যয় রয়েছে। এর একটি পরিচালন খাত বা আবর্তক ব্যয় এবং অন্যটি উন্নয়ন খাতের ব্যয়। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে সরকারের পরিচালন খাতে ব্যয়ের আকার নির্ধারণ করা হয় ৪ লাখ ৮৪ হাজার ২০৩ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে এই খাতের ব্যয় কমানো হচ্ছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। ফলে পরিচালন খাতে নতুন ব্যয়ের আকার দাঁড়াচ্ছে ৪ লাখ ৩৪ হাজার ২০৩ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকারের উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয় ২ লাখ ৭৭ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। বাকি ১৪ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা এডিপি বহির্ভূত উন্নয়ন ব্যয়। অর্থবছরের শেষ দিকে এসে মূল বাজেট থেকে উন্নয়ন ব্যয় ৩০ হাজার কোটি টাকা কমানো হচ্ছে। এত সংশোধিত বাজেটে উন্নয়ন ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ২ লাখ ৪৭ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা।
এবার এডিপির ৯৪ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক অর্থায়নে বাস্তবায়ন হওয়ার কথা; কিন্তু দাতা সংস্থা ও দেশগুলোর কাছ থেকে আশানুরূপ অর্থ না পাওয়ায় সেই লক্ষ্য ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা কমিয়ে সংশোধিত বাজেটে ৭৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হচ্ছে। আর এডিপির দেশীয় অর্থায়নের অংশ কমানো হচ্ছে ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
তবে সরকারের ব্যয়ের ক্ষেত্রে যে হারে কাটছাঁট করা হচ্ছে, আয়ের লক্ষ্য সেই হারে কমানো হচ্ছে না। মূল বাজেটে অনুদান ছাড়া রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ছিল ৫ লাখ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা ৫০ হাজার কোটি টাকা কমানো হচ্ছে। ফলে রাজস্ব আয়ের সংশোধিত লক্ষ্য দাঁড়াচ্ছে ৪ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত আয়ের লক্ষ্য কমতে যাচ্ছে ৪০ হাজার কোটি টাকা। বাকি ১০ হাজার কোটি টাকা কমছে অনুদানসহ অন্যান্য আয়ের খাত থেকে।
# # # # # # # # # # # # # # # # # # # # # # # # #