জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনের জন্য দলীয় মনোনয়ন পেতে ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছেন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের পদে থাকা নারী নেত্রীরা। মূল দলের পাশাপাশি বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের বর্তমান ও সাবেক নেত্রীদের অনেকেই এ দৌড়ে শামিল হয়েছেন। সেইসঙ্গে দলের প্রয়াত কিংবা প্রবীণ প্রভাবশালী নেতাদের মধ্যে অনেকের পরিবারের সদস্যরাও মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টা করছেন। দিন যত ঘনিয়ে আসছে নারী আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে বাড়ছে উৎকণ্ঠা। সেইসঙ্গে চূড়ান্ত তালিকায় নিজের নাম নিশ্চিত করতে গণভবন, দলীয় সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন তারা। দলের মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য ও নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করছেন কেউ। নারী আসনে মনোনয়নের জন্য তদবিরের চাপে হিমশিম খাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন কোনো কোনো নেতা।
এ পরিস্থিতিতে আজ থেকে সংরক্ষিত নারী আসনে দলীয় মনোনয়নের জন্য আবেদনপত্র বিতরণ শুরু করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। একই দিন এই নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করছে নির্বাচন কমিশন।
গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ২৯৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২২৩টি আসন পায়। সেই হিসাবে সংরক্ষিত নারী আসনের মধ্যে ৩৭টি পায় আওয়ামী লীগ। এ ছাড়া ৬২ জন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য তাদের জন্য নির্ধারিত ১১টি আসন আওয়ামী লীগকে ছেড়ে দিয়েছেন। ফলে সব মিলিয়ে সংরক্ষিত নারী আসনের ৪৮ জন সদস্যকে মনোনয়ন দেবে ক্ষমতাসীন দল।
গত ১১টি সংসদের কোনোটিতেই সংরক্ষিত নারী আসনে ভোটের নির্বাচনের প্রয়োজন পড়েনি। প্রতিটি আসনের বিপরীতে একক প্রার্থী থাকায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন নির্দিষ্ট দলের মনোনীতরা। এবারও আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত তালিকায় নাম থাকা মানেই নির্বাচিত হওয়ার নিশ্চয়তা। সেই তালিকায় নিজের নাম নিশ্চিত করতে ব্যাপক চেষ্টা চালাচ্ছেন আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। তাদের মধ্যে উপজেলা পর্যায়ের নেত্রী থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরাও রয়েছেন। সংরক্ষিত আসনে নির্বাচনের পর এক বা একাধিক নারী সংসদ সদস্য মন্ত্রিসভায় যুক্ত হতে পারেন। এ কারণে আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ অনেক নেত্রীও আগে এমপি পদ নিশ্চিত করতে চাইছেন বলে জানা গেছে।
তবে দলীয় সূত্র বলছে, গত তিনটি সংসদের মতো এবারও পুরোনোদের বাদ দিয়ে নতুনদের মূল্যায়ন করা হবে। এই তালিকায় দলের জেলা-উপজেলার ত্যাগী, পেশাজীবী, মুক্তিযোদ্ধা পরিবার ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রভাবশালী নারী নেত্রীদের মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে। এ ছাড়া গত কয়েকটি সংসদে যেসব জেলা থেকে নারী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হননি, সেসব জেলার নারীদের প্রাধান্য দেওয়া হবে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের দায়িত্বশীল নেত্রী, শরিক দলের দু-তিনজন এ তালিকায় স্থান পেতে পারেন বলে ইঙ্গিত দিয়েছে আওয়ামী লীগের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র।
দলীয় নিয়মানুযায়ী আজ (মঙ্গলবার) থেকে দলীয় আবেদনপত্র বিতরণ শুরু করবে ক্ষমতাসীন দলটি। আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত আবেদনপত্র সংগ্রহ ও জমা দেওয়া যাবে। প্রতিটি আবেদনপত্রের দাম রাখা হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। পরের সপ্তাহের যে কোনো দিন সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের সভা অনুষ্ঠিত হবে। আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের প্রধান শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সে সভায় চূড়ান্ত করা হবে দলীয় প্রার্থীদের নাম।
আওয়ামী লীগের উপদপ্তর সম্পাদক সায়েম খান কালবেলাকে বলেন, ‘আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দলীয় মনোনয়নপত্র সংগ্রহ ও জমা দেওয়া যাবে। এরপর দলের সভাপতির সম্মতিক্রমে বসবে সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের সভা। তবে এখনো সেই সভার তারিখ চূড়ান্ত করা হয়নি।’
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, কোন কোন জেলা থেকে এবার নারী সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন দেওয়া হবে, কোন কোন পেশার প্রতিনিধি রাখা হবে—এসব হিসাব-নিকাশ অনেকটাই এগিয়ে রেখেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তবে আবেদনপত্র বিক্রির পর মনোনয়ন বোর্ডের সভায় তিনি সব কিছু চূড়ান্ত করবেন। এ বিষয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ইঙ্গিত দেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে দলের পরীক্ষিত ও ত্যাগীদের গুরুত্ব দেওয়া হবে। যারা দলের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন, যারা আমাদের দুঃসময়ের পরীক্ষিত কর্মী, তাদের ব্যাপারটা আমরা অগ্রাধিকার দেব।’
সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে জীবনবৃত্তান্ত জমা দিতে এসেছিলেন কয়েক ডজন নারী নেত্রী। এ সময় তাদের উদ্দেশে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি মনোনয়ন দেবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এখানে কারও কিছু করার নেই।’
এর আগে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য অনেকেই উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কিংবা পৌরসভার মেয়র পদ ছেড়েছেন। তবে নারী আসনে এমপি হওয়ার জন্য কেউ যেন স্থানীয় সরকারের পদ না ছাড়েন—সে বিষয়ে সাবধান করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। গণভবনে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসা সংরক্ষিত নারী আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যারা বর্তমানে উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান বা অন্য কোনো পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, সংরক্ষিত নারী আসনের আশায় তাদের আগেই পদত্যাগ করার দরকার নেই।’
জানা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে আওয়ামী লীগের ৪৩ এমপির মধ্যে চারজন এবার সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। বাকি ৩৯ জনের মধ্যে দু-তিনজন আবারও মনোনয়ন পেতে পারেন। দলের কার্যনির্বাহী সংসদের পাঁচ নেত্রীকে সংরক্ষিত নারী আসনে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে বলে ইঙ্গিত মিলেছে। এ ছাড়া যারা দলের মনোনয়ন পেয়েও আসন সমঝোতার কারণে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন, তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হতে পারে। তবে জাতীয় নির্বাচন দলের মনোনয়ন পেয়েও যারা জিততে পারেননি, সংরক্ষিত আসনে তাদের বিবেচনা না করার সম্ভাবনাই বেশি।
অন্যদিকে সংসদে ১৪ দলের শরিকদের প্রতিনিধিত্ব কমে যাওয়ায় নারী আসনে তাদের দু-তিনজন নেওয়া হতে পারে। নির্বাচনকে ঘিরে শরিকদের ক্ষোভ প্রশমিত করার জন্যই এমন উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে। এক্ষেত্রে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর স্ত্রী আফরোজা হক রীনা, সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতার, সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দীলিপ বড়ুয়ার স্ত্রী অধ্যাপিকা তৃপ্তি রানী বড়ুয়া, জাতীয় পার্টি-জেপির চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর স্ত্রী তাসমিমা হোসেন বা তাদের পরিবারের কোনো সদস্যকে সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য করার বিষয়টি আলোচনায় রয়েছে। এ ছাড়া তৃতীয় লিঙ্গ, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তা থেকেও দু-তিনজনকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, সংরক্ষিত আসনে নির্বাচন শেষে মন্ত্রিসভার আকার বাড়ানো হতে পারে। অন্তত দুজন নারী এমপিকে মন্ত্রিসভায় যুক্ত করা হতে পারে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন কালবেলাকে বলেন, ‘সংসদের সংরক্ষিত আসনে মনোনয়নের জন্য ত্যাগী ও রাজনীতি সংশ্লিষ্ট নারীদের মূল্যায়ন করা হবে। যারা দুঃসময়ে দলের জন্য কাজ করেছেন, কেন্দ্র থেকে তৃণমূল যেখানেই হোক তাদের সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন দেওয়া হবে। দু-একটি আসন ১৪ দলের শরিকদের জন্যও ছেড়ে দেওয়া হতে পারে। তবে দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।’