যখন যেখানে দায়িত্ব পালন করেছেন, জড়িয়েছেন দুর্নীতিতে। নিম্নমানের কাজ, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসাজশ, স্বজনদের অতিরিক্ত সুবিধা দেওয়াসহ নানা কারণে বিতর্কিত হলেও বদলি ছাড়া আর কোনো শাস্তি হয় না তার। মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতনদের ম্যানেজ করে ফের বড় বড় দায়িত্ব বাগিয়ে নেন। আলোচিত এই কর্মকর্তা হলেন বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) চট্টগ্রাম সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এবং ‘চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলায় ভূ-উপরিস্থ পানির মাধ্যমে সেচ উন্নয়ন’ প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) মো. নুরুল ইসলাম। এবার একসঙ্গে ২৫০টি ঠিকাদারি কাজের দরপত্র আহ্বান করে নতুন বিতর্কে জড়িয়েছেন তিনি। আর পছন্দের ঠিকাদারদের অতিরিক্ত সুবিধা দিতে রীতি ভঙ্গ করে নিজেই দরপত্র বাছাই কমিটির সভাপতি হয়েছেন।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, নুরুল ইসলাম ২০২১ সালে মুজিবনগর সেচ উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পান। তবে মাত্র চার মাসের মাথায় একই বছরের ২০ জুন দুর্নীতির দায়ে অপসারিত হন। ওই সময় তার বিরুদ্ধে কাজ দেওয়ার জন্য মোটা অঙ্কের উৎকোচ গ্রহণ ও প্রকল্প পরিচালক নিজেই প্রকল্পে গাড়ি সরবরাহ কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণ হয়। এরপর তাকে হবিগঞ্জ অঞ্চলে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়। তবে সেখানেও অনিয়মে জড়ান নুরুল ইসলাম। হবিগঞ্জ অফিস ভবনের কাজ চলমান ছিল। সেখানে ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজশে নিম্নমানের কাজ সম্পন্ন করেন। বিষয়টি ঊর্ধ্বতনদের নজরে এলে পুরো কাজটি খতিয়ে দেখা হয়।
হবিগঞ্জ অফিস ভবনের নির্মাণ কাজের অনিয়ম নিয়ে বিএডিসি অভ্যন্তরীণ একটি তদন্ত করে। সেখানে দেখা যায়, ভবন নির্মাণে প্রায় ৩৬টি খাতে অনিয়ম করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পুরো ভবনের বিভিন্ন জায়গায় নির্মাণ শেষ হতে না হতেই হাত লাগালে প্লাস্টার খসে পড়ছে। বাইরে লাগানো সিরামিক খসে পড়ছে। অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে নামকাওয়াস্তে রং লাগানো হয়েছে। এ ছাড়া নিম্নমানের ইলেকট্রিক পণ্য ব্যবহার করা হয়েছে ভবনে। অনেক কাজ সমাপ্ত না করেই খাতা-কলমে সমাপ্ত দেখানো হয়েছে বলে ওই প্রতিবেদনে দেখা গেছে।
গত বছরের ১০ মে ওই তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করা হয়। তবে অভিযোগ ওঠার পর পরই নুরুল ইসলামকে হবিগঞ্জ থেকে চট্টগ্রাম বদলি করে বিএডিসি কর্তৃপক্ষ।
এভাবে একের পর এক কর্ম এলাকায় দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও ফের চট্টগ্রাম সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এবং ‘চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলায় ভূ-উপরিস্থ পানির মাধ্যমে সেচ উন্নয়ন’ প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় নুরুল ইসলামকে। কর্মকর্তারা বলছেন, মন্ত্রণালয়ের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের পৃষ্ঠপোষকতা থাকায় নানা অপরাধে জড়িত থাকার পরও তাকে এমন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিভিন্ন অনিয়মে অভিযুক্ত হলেও এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বদলি ছাড়া তেমন কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে চট্টগ্রামে নতুন দায়িত্ব পাওয়ার পরও পুরোনো পথেই হাঁটতে থাকেন তিনি। প্রকল্পের কাজে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সভাপতি হন। যদিও পিপিআরে বলা আছে, টেন্ডার আহ্বানকারী কর্মকর্তার মূল্যায়ন কমিটির সভাপতি না হওয়াই ভালো। এক্ষেত্রে অন্য কোনো কর্মকর্তা সভাপতির দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু তিনি ইজিপির নীতিমালার দোহাই দিয়ে ক্ষমতাবলে নিজেই সে টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটির সভাপতি হয়েছেন, যা পিপিআর পরিপন্থি।
নথিপত্রে দেখা যায়, সম্প্রতি চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলায় ভূ-উপরিস্থ পানির মাধ্যমে সেচ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় একসঙ্গে প্রায় ২৫০টি উন্নয়ন কাজের দরপত্র আহ্বান করা হয়। বিএডিসির বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, সাধারণত যে কোনো প্রকল্পের উন্নয়ন কাজ ধারাবাহিকভাবে দরপত্র আহ্বান করে। জনবল সংকটসহ নানা কারণে একসঙ্গে এত কাজ শুরু হলে ঠিকঠাক দেখভাল করা সম্ভব হয় না। এতে কাজের মান খারাপ হওয়ার সুযোগ থাকে। চট্টগ্রামে একসঙ্গে ২৫০টি কাজের দরপত্র আহ্বান করে একটি রেকর্ড করেছেন প্রকল্প পরিচালক।
তারা বলছেন, কৃষি মন্ত্রণালয়ে নতুন মন্ত্রী দায়িত্ব নিয়েছেন। ফলে অতীতে যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ নানা ধরনের অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, তাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হতে পারে। ক্ষমতা খর্ব হওয়ার শঙ্কায় প্রকল্প পরিচালক দ্রুত দরপত্র প্রক্রিয়াসহ কাজ বণ্টন শেষ করতে চাইছেন।
সূত্র জানায়, প্রকল্প পরিচালক নুরুল ইসলাম ঠিকাদারদের নিয়ে নিজস্ব বলয় তৈরি করেছেন। তার বলয়ের বাইরে কেউ দরপত্রে অংশগ্রহণ করলেও কাজ পায় না। নতুন এই প্রকল্পেও তিনি একই পথে হাঁটছেন। তার পছন্দের ঠিকাদাররা যাতে দরপত্রে অংশ নিয়ে কাজ পান, সে জন্যই তিনি দ্রুত একসঙ্গে সব দরপত্র আহ্বান করেছেন।
বেশ কয়েকজন ঠিকাদারও অভিযোগ করেছেন, নুরুল ইসলাম দরপত্রের গোপন কোড নম্বর সরবরাহ করেন পছন্দের ঠিকাদারদের। এ কারণে বেশিরভাগ দরপত্রে মাত্র দু-তিনজন ঠিকাদার অংশগ্রহণ করেন।
জানা যায়, মুজিবনগরে সেচ উন্নয়ন প্রকল্পের দায়িত্বে থাকাকালে তিনি নিজের সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে গাড়ি সরবরাহের কাজ দেন। পরে ব্যাপক সমালোচনা এবং সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হলে তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে বদলি করা হয়। একই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এমআরএস বিপ্লব ট্রেডার্স চট্টগ্রামের প্রকল্পেও ম্যানুয়াল দরপত্রে অংশগ্রহণ করেছে।
সূত্র বলছে, ওই প্রতিষ্ঠানটিকে কাজ দেওয়ার জন্যই আরেকটি নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দরপত্র জমা দেওয়া হয়েছে। যাতে নুরুল ইসলামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানই কাজটি পেয়ে যায়।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলায় ভূ-উপরিস্থ পানির মাধ্যমে সেচ উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) মো. নুরুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘দরপত্র আহ্বান আমার একার বিষয় নয়। কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের ভিত্তিতেই দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। কোথাও কোনো দুর্নীতি করিনি। সরকারের যথাযথ প্রক্রিয়ায় বদলি হয়েছি।’
এসব বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ সাজ্জাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।