দেশের আইনজীবী সমিতিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ও গুরুত্বপূর্ণ সমিতি হিসেবে পরিচিত সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী (বার) সমিতি। সমিতির বিগত দুটি নির্বাচন নিয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায় তৈরি হয়েছে। ঘটেছে নজিরবিহীন ঘটনাও। ওই দুটি নির্বাচনের ক্ষতের প্রভাব এখনো রয়েছে সমিতি প্রাঙ্গণে। এখনো মাঝেমধ্যেই চলছে মিছিল-পাল্টা মিছিল। এরই মধ্যে একতরফা ভোটে বিজয়ী সমিতির পক্ষ থেকে ২০২৪-২৫ সালের কার্যনির্বাহী কমিটির নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করা হয়েছে। তপশিল অনুযায়ী ৬ ও ৭ মার্চ ভোট গ্রহণের দিন রাখা হয়েছে। অন্যদিকে সমিতির অ্যাডহক কমিটির পক্ষ থেকে আরও একটি তপশিল ঘোষণা করা হয়েছে। এভাবে দুপক্ষে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে তপশিল ঘোষণার পরই সমিতিতে আলোচনায় এসেছে—বিগত দুটি নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, এবার কী হবে?
আইনজীবীরা বলছেন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি। এ সমিতির একটি ঐতিহ্য ছিল। এখন সেই ঐতিহ্য পুরোপুরি নেই। স্বৈরাচারী আচরণের মাধ্যমে বারের নেতৃত্ব দখল করা হচ্ছে। এটার পেছনে মূলত দায়ী রাজনীতি। সমিতিতে নষ্ট রাজনীতি ঢুকেছে। সমিতির পরিবেশ ঠিক রাখতে হলে সমিতিকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। পরপর দুটি নির্বাচন নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আর এজন্য প্রয়োজনে সমিতির সিনিয়র সদস্যদের সঙ্গে বসে তাদের মতামত নিতে হবে। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ বের করতে হবে।
গতবারের একতরফা ভোটে বিজয়ী সমিতির বর্তমান সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুন নূর দুলাল কালবেলাকে বলেছেন, সমিতির নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করা হয়েছে। তপশিল অনুযায়ী নির্বাচন হবে। এখানে আলোচনার কিছু নেই। তবে আলোচনার দরজা যে একেবারে বন্ধ সেটাও বলব না। তিনি আরও বলেছেন, গতবারও সুষ্ঠু ভোট হচ্ছিল। তবে বিএনপির একজন ব্যক্তির কারণে পুরো বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা মিসগাইডেড হয়েছে। একজনের কারণে তারা নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরে গেছে। এতে বার ও বিএনপি দুটোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অ্যাডভোকেট দুলাল আরও বলেন, এবার ভোটার তালিকা টানিয়ে দিয়েছি। কারও আপত্তি থাকলে জানাবে। এরপর একটা নিরপেক্ষ সাব-কমিটি গঠন করব। বারের নির্বাচন যেভাবে হয়, সেভাবেই এবারও নির্বাচন হবে।
সমিতির সিনিয়র আইনজীবীরা বলছেন, সমিতির পরপর দুটি নির্বাচন নিয়ে যে কলঙ্কজনক ঘটনা ঘটেছে, তা থেকে উত্তরণে আলোচনার কোনো বিকল্প নেই। এ ব্যাপারে সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান বলেন, একসময় এই সমিতি রাজনীতিমুক্ত ছিল। শামসুল হক চৌধুরী ৬ বার এই সমিতির সভাপতি হয়েছেন। এরপর ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, ব্যারিস্টার আমির উল ইসলামসহ অনেকেই সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দল-মত নির্বিশেষে সমিতি পরিচালিত হয়েছে। তখন সমিতি স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করেছে। তবে গত কয়েক বছর ধরে সমিতিতে দলীয় রাজনীতি হচ্ছে। সমিতিতে প্যানেলভিত্তিক কোনো নির্বাচন ছিল না। এখন হচ্ছে। বার দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। পেশাগতভাবে বিভক্ত হয়নি, তবে পেশার ওপর প্রভাব পড়েছে। কে আওয়ামী লীগ করছে, কে বিএনপি করছে—সেটা প্রকাশ্যে আসছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিমের সাবেক সমন্বয়কের দায়িত্ব পালনকারী এম কে রহমান আরও বলেন, ‘সবারই রাজনৈতিক আদর্শ আছে। এটা থাকবেই। তবে বারকে রাজনীতির বাইরে রাখতে হবে। প্রতিদিন এই আদালত চত্বরে যে স্লোগান হচ্ছে, সেটা কিন্তু বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য নয়। আইনের শাসনের জন্য নয়। এটা করা হচ্ছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। এসব ব্যাপারে কোর্টের নিষেধাজ্ঞাও আছে। এই পরিবেশ তো বিচারও বিঘ্নিত করে। বারের পরিবেশটা সুন্দর করার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে চিন্তা করতে হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে সিনিয়র এই আইনজীবী বলেন, বারের গত দুটি নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। গতবার নির্বাচন মাঝপথে বয়কট করা হয়েছে। নির্বাচন প্রতিনিধিত্বমূলক হয়নি। এর আগের নির্বাচনে ভোট গণনা নিয়ে সমস্যা হয়েছে। তালা ভাঙার ঘটনা ঘটেছে। বারটা কলুষিত হয়েছে। গত দুটি নির্বাচনের মতো কলঙ্কিত নির্বাচন থেকে বের হতে হলে করণীয় সম্পর্কে এম কে রহমান বলেন, দক্ষ, নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা সাব-কমিটি গঠন করতে হবে। সাব-কমিটিকে যা যা সহযোগিতা দরকার সেটা দিতে হবে। এর আগে গত বছর প্রধান বিচারপতিসহ অন্য বিচারপতিদের অনুরোধে নির্বাচনী সাব-কমিটির প্রধান হিসেবে মনসুরুল হক চৌধুরীর নাম প্রস্তাব করল। কিন্তু মনসুরুল হক চৌধুরীকে সহযোগিতা করল না। এতে করে তাকে পদত্যাগ করতে হলো।
তিনি বলেন, এবারও যাদের দিয়ে নির্বাচনী সাব-কমিটি করার কথা শোনা যাচ্ছে, তাদের দিয়ে করলে তো নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না। সমিতিতে আস্থা ও বিশ্বাসের যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে, তা কাটিয়ে নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে হলে সব সিনিয়র আইনজীবী নিয়ে বৈঠক করতে হবে। সবার সুচিন্তিত মতামত নিয়ে নির্বাচন কীভাবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করা যাবে, সে ব্যাপারে সবার মতামত নিতে হবে।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক ও বিএনপি সমর্থক আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল কালবেলাকে বলেন, ‘সমিতির সদস্যরা পর পর দুবছর ভোটাধিকার বঞ্চিত হয়েছেন। এবারও অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কিত। অবৈধভাবে সমিতি দখল করে রেখেছে একটি গোষ্ঠী। আশা করি, এবার নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে সমিতির সাবেক সভাপতি, সম্পাদকসহ সিনিয়র সদস্যরা যথাযথ ভূমিকা রাখবেন।’
জানা যায়, ২০২৩ সালের ১৫ ও ১৬ মার্চ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ভোটের নির্ধারিত দিন ছিল; কিন্তু সমিতির নির্বাচন পরিচালনা সাব-কমিটি গঠন নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে সমিতির আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থক এবং সমমনা আইনজীবীরা। শুরুতেই এই সাব-কমিটি গঠন নিয়ে মতৈক্য থাকলেও পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের নেতা ও সাবেক বিচারপতি মনসুরুল হক চৌধুরীকে প্রধান করে সাত সদস্যের সাব-কমিটি ঐকমত্যের ভিত্তিতে গঠন করা হয়; কিন্তু সাব-কমিটি নির্বাচনে ভোট মেশিনে গণনা করতে চাইলে সমিতির বর্তমান সম্পাদক ও আওয়ামী লীগ সমর্থক প্যানেলের প্রার্থী আব্দুন নূর দুলাল তাতে রাজি না হওয়ায় অ্যাডভোকেট মনসুরুল হক চৌধুরী ১৩ মার্চ সন্ধ্যায় পদত্যাগ করেন। এ অবস্থায় ১৪ মার্চ বিএনপি ও আওয়ামী সমর্থক আইনজীবীরা ফের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান কে হবেন, তা নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েন। সমিতির আওয়ামী ফোরামের নেতারা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মনিরুজ্জামানকে নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান করে নির্বাচন পরিচালনা উপকমিটি ঘোষণা করেন। অন্যদিকে বিএনপি সমর্থকরা সমিতির সাবেক সহসভাপতি এ এস এম মোক্তার কবিরকে প্রধান করে একটি নির্বাচন পরিচালনা উপকমিটি গঠন করেন। বিষয়টি নিয়ে দুপক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা যায়।
উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যে ১৫ মার্চ সকালে ভোট গ্রহণ শুরুর উদ্যোগ নিলে বিএনপি-সমর্থিত প্যানেল থেকে মনোনীত প্রার্থীরা নির্বাচন পরিচালনা-সংক্রান্ত উপকমিটির সঙ্গে বিবাদে জড়ান। এক পর্যায়ে সমিতির মিলনায়তনে কয়েকশ পুলিশ প্রবেশ করে। তারা বিএনপি সমর্থক আইনজীবীদের ভোটকেন্দ্র থেকে বের করতে লাঠিচার্জ শুরু করলে প্রায় ১৫ জন আইনজীবী এবং ১০-১২ জন গণমাধ্যম কর্মী আহত হন। পরে একতরফা ভোটে আওয়ামী লীগ সমর্থক ১৪ প্রার্থীই বিজয়ী হন।
এর আগে ২০২২ সালের ১৫ ও ১৬ মার্চ সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির ১৪টি পদে নির্বাচনের জন্য ভোট গ্রহণ হয়। ওই বছরের ১৭ মার্চ রাতে ভোট গণনা শেষে ফল ঘোষণার মুহূর্তে আওয়ামী লীগপন্থি আইনজীবীরা সম্পাদক পদে ভোট পুনর্গণনার দাবি জানান। এ নিয়ে হৈচৈ-হট্টগোলের মধ্যে নির্বাচন পরিচালনা উপকমিটির আহ্বায়ক এ ওয়াই মসিউজ্জামানের পদত্যাগ করেন। ফল ঘোষণা নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়। প্রায় দেড় মাসেও এ জটিলতার নিরসন না হওয়ায় একই বছরের ২৮ এপ্রিল আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরা ব্যালট রাখা কক্ষ ভেঙে পুলিশ পাহারায় তা গণনা করে নিজেদের প্রার্থীদের বিজয়ী ঘোষণা করেন।