দেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে কুমিল্লার রামমালা গ্রন্থাগারের অবদান অসীম। গবেষক ও অনুসন্ধানীদের কাছে এই গ্রন্থাগার খুবই প্রিয়। এই গ্রন্থাগারে ৩০ হাজার বই ও আট হাজার পুথি রয়েছে। পুথিগুলো সংস্কৃত ও বাংলা ভাষায় লেখা। সংস্কৃত ভাষায় পুথির সংখ্যা ছয় হাজারেরও বেশি। এখানে যে কোনো পাঠক ও গবেষক কোনো ধরনের ফি ছাড়াই বই পড়তে পারেন। এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। কিন্তু অযত্ন-অবহেলা আর যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ১১২ বছর বয়সী এই গ্রন্থাগারের অমূল্য বই আর দুষ্প্রাপ্য পুথি।
কুমিল্লা নগরীর শিক্ষা বোর্ড সংলগ্ন ঈশ্বর পাঠশালা উচ্চ বিদ্যালয়ে অবস্থিত গ্রন্থাগারটিতে তিনটি বিভাগ রয়েছে। এগুলো হলো গবেষণা, পুথি ও সাধারণ। গবেষণা বিভাগে ভারতীয়, সংস্কৃতি, বেদ, ধর্মসহ বিভিন্ন সাহিত্যকর্ম সংরক্ষিত আছে। রয়েছে ইতিহাস, বাংলা সাহিত্য ও দর্শনের বই।
পুথি বিভাগে হাতে লেখা সংস্কৃত ও বাংলা পুথি সংরক্ষিত রয়েছে। যার সংখ্যা প্রায় আট হাজার। এর মধ্যে দুই হাজার তালপাতায় লেখা। বাকিগুলো কলাপাতা, তালপাতা, ভোজপাতা, গাছের বাকলসহ কাঠের ওপর খোদাইকৃত হাতের লেখা। এই বিভাগে তিন থেকে চারশ বছর আগের সংস্কৃত ভাষার পুথিও রয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এসব পুথি সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠার সময় থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত ২৭ ব্যক্তির কাছ থেকে এই পুথিগুলো সংগ্রহ করা হয়। তাদের নামও রয়েছে গ্রন্থাগারে। ধুলাবালুতে একাকার পুথিগুলো গ্রন্থাগারের আবদ্ধ ঘরে থাকতে থাকতে নষ্ট হওয়ার উপক্রম।
সাধারণ বিভাগে রয়েছে দেশি-বিদেশি পত্রিকা ও নানা ধরনের বই। অর্থাৎ সাধারণ পাঠকের উপযোগী জীবনগ্রন্থ, ইতিহাস, ভ্রমণবৃত্তান্ত, উপন্যাস প্রভৃতি বই এখানে আছে।
দেশ-বিদেশের বহু গবেষক এখানে আসেন বিভিন্ন পুথির ওপর গবেষণার জন্য। তিন বছর আগে চীনের একটি গবেষকদল এ গ্রন্থাগার পরিদর্শনে আসে। বেশ কয়েকদিন এখানে থেকে গ্রন্থাগারে রক্ষিত প্রাচীন বই থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেন তারা।
রামমালা গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেন দানবীর মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য। এ অঞ্চলের জ্ঞানপিপাসুদের গবেষণার সুবিধার্থে তার মা রামমালা দেবীর নামে ১৯১২ সালে কুমিল্লা শহরের উপকণ্ঠ শাকতলায় নিজ বাড়ির বৈঠকখানায় তিনি এটি প্রতিষ্ঠা করেন। সে সময় ঈশ্বর পাঠশালার অন্যতম পণ্ডিত সূর্যকুমার স্মৃতিতীর্থ গ্রন্থাগারটি পরিচালনা করতেন। সংস্কৃত ভাষায় লেখা বেশিরভাগ গ্রন্থ সাধারণ পাঠক বুঝতে পারতেন না। তাই গ্রন্থাগারে কিছু বাংলা বই, প্রবাসী, ভারতবর্ষ মাসিক পত্রিকা রাখা হতো। ধীরে ধীরে হাতে লেখা পুথিও সংগৃহীত হতে থাকে। ১৯৫০ সালে শিক্ষা বোর্ডের সামনে মহেশাঙ্গনে রামমালা গ্রন্থাগারটি স্থানান্তর করা হয়।
ঐতিহাসিক এ গ্রন্থাগারটি ঘিরে ঈশ্বর পাঠশালা উচ্চ বিদ্যালয় ছাড়াও রয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়, স্কুল-কলেজে অধ্যয়নরত হিন্দু শিক্ষার্থীদের জন্য রামমালা ছাত্রাবাস, নিবেদিতা ছাত্রী নিবাস এবং একটি দেবালয়। এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য মহেশ চ্যারিটেবল ট্রাস্ট নামে একটি ট্রাস্টি বোর্ড রয়েছে। প্রায় ছয় বছর আগে ট্রাস্টি বোর্ডের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট প্রয়াত ব্যারিস্টার নিখিলেশ দত্তের বিরুদ্ধে দুদকে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ করেন সেক্রেটারি অধ্যাপক বিমলেন্দু মজুমদার। একে অন্যকে বহিষ্কারের লিখিত নোটিশ প্রদানসহ ট্রাস্টি বোর্ডে নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্তকরণ নিয়ে সৃষ্টি হয় নানা জটিলতা। এ অন্তর্কোন্দল মামলায় গিয়ে ঠেকে। মামলা চলমান থাকায় এবং ট্রাস্টি বোর্ডের জটিলতার কারণে গ্রন্থাগারসহ রামমালায় এম ভট্টাচার্য অ্যান্ড কোম্পানি নামে একটি হোমিওপ্যাথি ওষুধ তৈরির কারখানা ও বিপণন কেন্দ্রটিও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে।
এ বিষয়ে ঈশ্বর পাঠশালা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শুধাংশ কুমার মজুমদার জানান, রামমালা গ্রন্থাগারে অনেক মূল্যবান বই আর দুর্লভ পুথি রয়েছে। অযত্ন আর অবহেলায় এসব নষ্ট হওয়ার পথে। আর্কাইভের মতো করে বড় আকারের আধুনিক গ্রন্থাগার গড়ে এই দুর্লভ পুস্তক ও পুথিগুলো সংরক্ষণ করা গেলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অনেক উপকৃত হবে।