শুক্রবার, ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২১ ভাদ্র ১৪৩২
রাজন ভট্টাচার্য
প্রকাশ : ০৫ মার্চ ২০২৪, ০২:২৭ এএম
আপডেট : ০৫ মার্চ ২০২৪, ০৮:২২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

নৌ শ্রমিকদের কষ্টের কথা কেউ শোনে না

১১ দফা দাবিতে ধর্মঘট আজ থেকে
নৌ শ্রমিকদের কষ্টের কথা কেউ শোনে না

শ্রম আইন অনুযায়ী নৌযান শ্রমিকদের জন্য প্রতি পাঁচ বছর পর পর নতুন মজুরি বোর্ড গঠনের কথা। আইনে বলা আছে, দ্রব্যমূল্য ও পরিবারের লোকজন যেন স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে পারে, তা বিবেচনায় নিয়ে বেতন কাঠামো ঠিক করতে হবে। ২০১৬ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত পাঁচ বছরের গেজেট স্কেলের সময়সীমা শেষ হলেও নৌ শ্রমিকদের বেতনভাতা বাড়েনি। সর্বশেষ ২০২২ সালে ১০ দফা দাবিতে নৌযান শ্রমিকরা সারা দেশে ধর্মঘটের ডাক দিলেও সরকারের আশ্বাসের পরও প্রাপ্য আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত হয়নি তাদের। পূরণ হয়নি অন্যান্য দাবি দাওয়াও।

শ্রমিক নেতারা বলছেন, তিন বছর ধরে তারা আর্থিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করাসহ কর্মক্ষেত্রে নানা সমস্যার কথা তুলে ধরে লিখিতভাবে দপ্তরে দপ্তরে জানিয়েছেন। কেউ কথা শোনেননি তাদের। নেননি কার্যকর কোনো পদক্ষেপ। সর্বশেষ স্কেল অনুযায়ী, একজন নৌযান শ্রমিকের প্রতি মাসে ৭ হাজার ৮০০ টাকা বেতন নির্ধারণ হয়েছে।

মালিকপক্ষ বলছে, পদ্মা সেতু চালুর পর ঢাকা থেকে দক্ষিণের নৌযান কমেছে প্রায় ৫০ ভাগ। সমানতালে কমেছে আয়। ভাড়া কমিয়ে ব্যয় নির্বাহ করা তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থায় শ্রমিকদের সব দাবি পূরণ করা সত্যিই কঠিন। বিশেষ করে আর্থিক দাবি পূরণ মালিকপক্ষের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শ্রমিক নেতাদের অভিযোগ, শ্রম মন্ত্রণালয়ের আমলাদের অসহযোগিতা, আন্তরিকতার অভাব, মালিকপক্ষের দায়িত্বহীনতার কারণেই তিন বছরের বেশি সময় মজুরি বোর্ড গঠন করা সম্ভব হয়নি। এর পরিপ্রেক্ষিতে নিয়ম মেনেই দাবি-দাওয়া পূরণে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন তারা।

বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের মহাসচিব চৌধুরী আশিকুল আলম পটল সোমবার রাতে কালবেলাকে বলেন, সারা দেশে নৌ শ্রমিকদের এই কর্মসূচি সফল করতে বৈঠক চলছে। সরকার বা মালিকপক্ষের সঙ্গে এ বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি বলেও জানান তিনি।

শ্রম আইন নিয়ে কাজ করা আইনজীবীরা বলছেন, শ্রমিকদের দাবি শতভাগ যৌক্তিক। মূলত মালিক ও সরকারপক্ষের অবহেলার কারণেই শ্রমিকরা কর্মবিরতির ডাক দিয়েছেন। শ্রমিকদের দাবি পূরণে মালিকদের যত্নবান হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

শ্রমিক নেতারা জানান, দেশে ২০ হাজার নৌযানে কাজ করছেন অন্তত ২ লাখ শ্রমিক। তাদের কমবেশি সবাই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। জানতে চাইলে নৌযান শ্রমিক কর্মচারী লীগের সাধারণ সম্পাদক সবুজ সিকদার বলেন, আমাদের কষ্টের কথা কেউ শোনেনি। সবার কাছে বারবার গিয়েছি। কথা বলেছি। সবাই তো মালিকদের কথা শোনে।

নৌপথে সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি বন্ধসহ ১১ দফা দাবিতে গত রোববার বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন মঙ্গলবার থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতির ঘোষণা দেয়। বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী আশিকুল আলম বলেন, দেশের আমদানি ও রপ্তানি পণ্য পরিবহনের অনেকাংশেই নৌ পরিবহনের ওপর নির্ভরশীল হওয়া সত্ত্বেও নৌযান শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন ও নিরাপত্তার বিষয়টি সব সময় উপেক্ষিত। তিনি আরও বলেন, আমরা সমস্যাগুলোর স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে বছরের পর বছর ধরে দাবি জানিয়ে আসছি। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে দাবি মেনে নিয়ে কিছু কিছু কার্যকর করলেও অধিকাংশ সিদ্ধান্তই অকার্যকর রয়েছে বছরের পর বছর।

সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবিগুলো হলো, নৌযান শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নাবিক কল্যাণ তহবিল ও ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে কন্টিবিউটরি প্রভিডেন্ট ফান্ড গঠন। সব মালিক সমিতিকে এক প্ল্যাটফর্মে এনে এককেন্দ্রিক সিরিয়ালে আনা। মালিক সমিতিগুলোর সঙ্গে গেজেট বহির্ভূত দ্বিপক্ষীয় চুক্তিভুক্ত অমীমাংসিত দাবিগুলো পুনর্নির্ধারণ করে চুক্তি সম্পাদন। চট্টগ্রাম বন্দরে নিরাপদে জাহাজ রাখার জন্য শঙ্খ নদীকে স্রোতাশ্রয়ের উপযোগী করা, নদীর নাব্য রক্ষা, নৌপথ, নদী ও সব সমুদ্রবন্দরে পর্যাপ্ত সংখ্যক মার্কা-বয়া-বাতি স্থাপন, চ্যানেলে জাল পাতা বন্ধ এবং প্রয়োজন অনুযায়ী পাইলট সরবরাহ নিশ্চিত করা।

চট্টগ্রাম চরপাড়া-জালিয়াপাড়া পর্যন্ত নাবিকদের নিরাপদে ওঠানামার জন্য কমপক্ষে পাঁচটি ইজারামুক্ত ঘাট ও মেরিনড্রাইভ ওয়ের ওপর চরপাড়া এবং জালিয়াপাড়া এলাকায় দুটি ফুটওভার ব্রিজ স্থাপন। এ ছাড়া ভারতগামী নৌযান শ্রমিকদের ল্যান্ডিংপাস নিশ্চিত করা। পরীক্ষায় অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ ও মালিক কর্তৃক নিশ্চিত হয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া। বালুবাহী নৌযানে কর্মরত শ্রমিকদের ওপর পুলিশি হয়রানি ও চাঁদাবাজি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। আদালতের সিদ্ধান্ত ছাড়া মাস্টার-ড্রাইভার সনদ বাতিলের কর্মকাণ্ড বন্ধ করা। সামুদ্রিক মৎস্য শিকারি জাহাজ শ্রমিকদের গেজেটের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন এবং অন্যান্য সব দাবি অবিলম্বে মেনে নিতে হবে। নৌপথে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি-কালোবাজারি-জাহাজ ছিনতাই বন্ধ করা।

শ্রমিকরা আর্থিক সুবিধা বাড়ানোসহ বিভিন্ন দাবি জানালেও শ্রম আইন কী বলছে। আইন অনুযায়ী চলমান ধর্মঘট কর্মসূচির যৌক্তিকতা জানতে চাইলে শ্রম আইন নিয়ে কাজ করা আইনজীবী ইসমাইল হোসেন কালবেলাকে বলেন, মালিকপক্ষের কাছে সিবিএ নেতারা যে কোনো সময় দাবি উত্থাপন করতে পারেন। তবে শ্রম আইন প্রতিপালন করে দাবি তোলা হলে, তা যৌক্তিক হয়।

তিনি বলেন, মালিকপক্ষের কাছে শ্রমিকদের লিখিত দাবি ১৫ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি না হলে শ্রম অধিদপ্তরে নালিশের পরিপ্রেক্ষিতে সালিশের আয়োজন করা হয়। শ্রম অধিদপ্তর উভয়পক্ষের সঙ্গে আলোচনায় সমস্যা সমাধান করতে না পারলে শ্রমিকদের ব্যর্থ বলে একটি সার্টিফিকেট দেয়। এরপর শ্রমিকরা দাবি আদায়ে যে কোনো কর্মসূচি নিতে পারে। সার্টিফিকেট প্রাপ্তির পর শ্রমিকপক্ষ হ্যাঁ-না ভোটে নির্বাচন করে ধর্মঘটের কর্মসূচি চূড়ান্ত করে। এরপর ২১ দিন সময় দিয়ে ধর্মঘট করা যায়।

লঞ্চ মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় সহসভাপতি মো. সাইদুর রহমান রিন্টু কালবেলাকে বলেন, ২০১৭ সালে শ্রমিকদের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল, তারা পরের পাঁচ বছর নতুন কোনো দাবি করতে পারবে না। এরপর ২০২২ সালের নভেম্বরে তাদের আন্দোলনের পর বেশকিছু সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে।

নৌযান শ্রমিকদের ক্ষেত্রে মজুরি বোর্ডের গেজেট স্কেলের সময়সীমা ৫ বছর জানিয়ে কার্গো বাল্কহেড নৌ শ্রমিক ঐক্যজোটের আহ্বায়ক বাশার মাস্টার কালবেলাকে বলেন, নৌ পরিবহন সেক্টরে সাধারণ শ্রমিকরা এখন ৭ হাজার ৮০০ টাকা বেতন পান। তবে কারিগরি পদবিগুলোতে সর্বোচ্চ ২৬ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন রয়েছে। সাধারণ শ্রমিকদের দিনের পর দিন নৌযানে থাকতে হয়। এতে মাসে ৪ হাজার টাকার বেশি খবার খরচ চলে যায়।

২০২২ সালের নভেম্বরে ১০ দফা দাবিতে নৌধর্মঘটের ডাক দেয় বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদ। ওই মাসের ২৮ নভেম্বর সরকারের সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়।

বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি মো. শাহ আলম বলেন, ‘শ্রমিকদের মজুরি কাঠামো নির্ধারণে এক মাসের মধ্যে কমিটি গঠন ও মামলা প্রত্যাহারসহ অন্যান্য সমস্যা সমাধানে আশ্বাসের প্রেক্ষিতে ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হলেও অনেক দাবি পূরণ হয়নি। এবারের ধর্মঘট শুধু আর্থিক সুবিধা বাড়ানোর জন্য নয়। কর্মক্ষেত্রে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি। সেগুলোরও সমাধান প্রয়োজন।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সাভার-আশুলিয়ার ৩ ছাত্র হত্যা মামলা : হাসিনাসহ ২০৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশীট

সম্প্রীতির নজির গড়লেন জামায়াতের সেলিম ও গণঅধিকারের জাহিদ

যে কারণে ফেসবুক বন্ধ করল নেপাল

আফগানিস্তানে আবারো ভয়াবহ ভূমিকম্প, মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ২২০০

আর্জেন্টিনার জার্সিতে মেসির ১০টি স্মরণীয় মুহূর্ত

সাংবাদিকদের উপর হামলা / ভাঙ্গাকে বিভক্ত হতে দেব না : কৃষকদল নেতা বাবুলের হুঁশিয়ারি

বৃদ্ধা সখিনার বয়স্ক ভাতার টাকা খাচ্ছেন অন্যরা

দুই বাংলাদেশিকে ফেরত দিল বিএসএফ

নুরের সবশেষ অবস্থা ও বিদেশ যাওয়ার তথ্য জানালেন রাশেদ

নির্বাচনকে বড়লোকদের টাকার খেলায় পরিণত করার চক্রান্ত চলছে : প্রিন্স

১০

মেসির বিদায়ী ম্যাচকে ঘিরে ডি পল–ডি মারিয়ার আবেগঘন প্রতিক্রিয়া

১১

দেশের দুর্নীতি কোন পর্যায়ে, জানালেন টিআই চেয়ারম্যান

১২

বাকৃবিতে ‘নাটকীয়’ পরিস্থিতি, ক্যাম্পাস সচল নিয়ে অনিশ্চয়তা

১৩

অনুপস্থিত চিকিৎসকের হাজিরা স্বাক্ষর করে ‘ভূত’

১৪

পিআর পদ্ধতি ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় : আব্দুল হালিম

১৫

ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিশেষ নির্দেশনা

১৬

আশুলিয়ায় হুব্বে রাসূল ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে সীরাতুন্নবী কনফারেন্স অনুষ্ঠিত

১৭

একটি অপশক্তি গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা করতে চায় : হাবিব

১৮

৪০০ টাকার জন্য বন্ধুকে পিটিয়ে হত্যা

১৯

চাঁদপুরের সবুজ জিতলেন ৬৮ কোটি টাকা

২০
X