সারা বিশ্বের সার্জারির উৎকর্ষ সাধনের পেছনে অ্যানেসথেসিয়ার ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত সার্জারির আগে রোগীকে অচেতন বা শরীরের কিছু অংশ অবশ করাকে বলা হয় অ্যানেসথেসিয়া। ফলে কিডনি, হৃদযন্ত্র, মস্তিষ্ক, এমনকি চেহারা পরিবর্তনসহ জটিল অপারেশন সহজ হয়েছে। অ্যানেসথেসিয়া যত ভালো হয়, সার্জারিও তত ভালো হয়—এমনটাই বলা হয়ে থাকে। শুধু অজ্ঞান বা চেতনা নাশ করার নাম অ্যানেসথেসিয়া নয়। অজ্ঞান করার পর রোগীর প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কাজ কৃত্রিমভাবে চালিয়ে যাওয়াটাও অ্যানেসথেসিয়ার অংশ। প্রি-অপারেটিভ অ্যাসেসমেন্ট, পোস্ট অপারেটিভ কেয়ার, আইসিইউ ম্যানেজমেন্ট, জটিল চিকিৎসা—সবকিছুর সঙ্গে অ্যানেসথেসিয়া জড়িত। পুরো প্রক্রিয়া ঠিকভাবে করতে না পারলে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও দেশে তা চরম অবহেলিতই বলা যায়।
জানা গেছে, সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ৩০ হাজার সার্জারি হয়। কিন্তু এ খাতে সক্রিয়ভাবে কর্মরত মাত্র আড়াই হাজার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। অনেক সময় চিকিৎসক নন—এমন ব্যক্তি রোগীকে অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে থাকেন। ফলে ঘটছে নানা অঘটন। ক্লিনিক্যাল অন্যান্য বিভাগের মতো সুযোগ-সুবিধা না থাকায় অ্যানেসথেসিওলজিস্টের ঘাটতি পূরণ হচ্ছে না। সম্প্রতি খতনা করাতে গিয়ে রাজধানীর মালিবাগ জেএস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল সেন্টারে শিক্ষার্থী আয়হাম এবং গত জানুয়ারিতে সাঁতারকুল ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশু আয়ানের মৃত্যুর পর অতিরিক্ত অ্যানেসথেসিয়া প্রয়োগের অভিযোগ ওঠে।
চিকিৎসকদের মতে, চিকিৎসা খাতের অন্যান্য বিষয়ে যতটা জোর দেওয়া হচ্ছে, অ্যানেসথেসিয়ার ক্ষেত্রে ততটাই উদাসীনতা রয়েছে। যদিও সার্জারির ক্ষেত্রে অ্যানেসথেসিয়া ব্যবস্থাপনা সবচেয়ে জরুরি ও স্পর্শকাতর। পেশাগত সুরক্ষা ও প্রণোদনার অভাবে তরুণ চিকিৎসকরা অ্যানেসথেসিয়া খাতে কাজ করতে আগ্রহী নন। এই খাতে চাহিদার অনুপাতে যোগ্য চিকিৎসক না থাকায় মৃত্যুও বেড়ে যাচ্ছে। অনেক সময় অ্যানেসথেসিওলজিস্ট নন—এমন মানুষও সার্জারির আগে রোগীকে অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে থাকেন। এতে রোগীর মৃত্যু ঘটে। দুর্ঘটনার পর মূলত এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। তাই সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে অ্যানেসথেসিয়া খাতে প্রণোদনা ও সামাজিক নিরাপত্তা বাড়াতে হবে। তাহলে তরুণ চিকিৎসকরা এ খাতে কাজ করতে আগ্রহী হবে।
বাংলাদেশ হেলথ ওয়ার্কফোর্স স্ট্র্যাটেজি ২০২৩ শীর্ষক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কৌশলপত্রের তথ্যানুযায়ী, অ্যানেসথেসিওলজিস্ট ও ল্যাব টেকনিশিয়ানের অভাবে কোনো কোনো সরকারি হাসপাতালে সার্জারি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে অ্যানেসথেসিওলজিস্টের মতো বিশেষায়িত চিকিৎসকের সংকট বেশি। সারা দেশে ৬৫০টির বেশি সরকারি হাসপাতালে অ্যানেসথেসিওলজিস্ট আছেন মাত্র ৬৩৮ জন। অর্থাৎ প্রতি হাসপাতালে একজনেরও কম অ্যানেসথেসিওলজিস্ট কর্মরত রয়েছেন। এই খাতে সরকারি হাসপাতালে অধ্যাপক আছেন মাত্র ১২ জন। সবমিলিয়ে পদ খালি আছে ২৭৬টি। ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব সোসাইটিজ অব অ্যানেসথেসিওলজিস্টস সংস্থার মতে, প্রতি ১ লাখ মানুষের বিপরীতে অন্তত পাঁচজন অ্যানেসথেসিওলজিস্ট প্রয়োজন। বাংলাদেশে এখনো প্রতি ৩ লাখ মানুষের জন্য রয়েছে মাত্র একজন অ্যানেসথেসিওলজিস্ট।
জানা গেছে, সরকারি হাসপাতালে প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ হাজারের মতো অস্ত্রোপচার হয়। বেসরকারি হাসপাতালে এ সংখ্যা দুই থেকে তিনগুণ বেশি। বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেসথেসিওলজিস্ট, ক্রিটিক্যাল কেয়ার ও পেইন ফিজিসিয়ানস (বিএসএসিসিপিপি) জানিয়েছে, দেশে কর্মরত অ্যানেসথেসিওলজিস্ট আছেন মাত্র ২ হাজার ৪০০ জনের কম। অথচ প্রয়োজন ১২ থেকে ১৩ হাজার অ্যানেসথেসিওলজিস্ট।
অন্য একটি সূত্র বলছে, অ্যানেসথেসিয়া জটিলতায় রোগীর মৃত্যুর পেছনে মানসম্মত যন্ত্রপাতি ও ওষুধেরও দায় রয়েছে। বিশ্ব মানের অ্যানেসথেসিয়া যন্ত্রের দাম এখন গড়ে ২৫ থেকে ৩৯ লাখ টাকা। সেখানে বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতালে সর্বোচ্চ ১২ লাখ টাকায় এ যন্ত্র কেনা হয়। বেসরকারি হাসপাতালে মানভেদে ৪৫ হাজার থেকে ৮ লাখে কেনা হয় অ্যানেসথেসিয়া যন্ত্র। যন্ত্রের মানের কারণেও অনেক সময় শিশুদের শরীরে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। ওষুধের মান নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। কিন্তু এসব বিষয় সবসময় আলোচনার বাইরে থেকে যায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ কালবেলাক বলেন, কোনো চিকিৎসক কখনো রোগীর ক্ষতি কিংবা মৃত্যু কামনা করেন না। অ্যানেসথেসিয়ায় মৃত্যুর জন্য চিকিৎসককে দায়ী করার আগে যন্ত্র ও ওষুধের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা জরুরি। কারণ, সার্জারি বা চিকিৎসা খাতে অ্যানেসথেসিয়া অত্যন্ত জরুরি। সামাজিক মর্যাদা, অর্থনৈতিক সুরক্ষাসহ নানা কারণে তরুণ চিকিৎসকরা অ্যানেসথেসিয়ায় উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনে আগ্রহী নন। সরকারকে বিষয়টা বিবেচনায় নিতে হবে। অ্যানেসথেসিয়া খাতে সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেসথেসিওলজিস্ট ক্রিটিক্যাল কেয়ার অ্যান্ড পেইন মেডিসিনের প্রেসিডেন্ট এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নার্সিং ফ্যাকাল্টির ডিন অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বণিক কালবেলাকে বলেন, অ্যানেসথেসিয়ার কারণেই সার্জারির উৎকর্ষ সাধন হয়েছে। অ্যানেসথেসিয়ার কল্যাণে কিডনি, হৃদযন্ত্র, মস্তিষ্ক, এমনকি চেহারা পরিবর্তনসহ জটিল অপারেশন সম্ভব হচ্ছে। যে রোগীর অ্যানেসথেসিয়া যত ভালো হবে, সার্জারি তত ভালো হবে। একজন অ্যানেসথেসিওলজিস্ট জানেন রোগীকে কী করে কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। তাই ছোট-বড় যে কোনো সার্জারির আগে প্রত্যেকেরই উচিত হাসপাতালে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা আছে কি না, সার্জন ও অ্যানেসথেসিওলজিস্ট দক্ষ এবং অভিজ্ঞ কি না, সেটি যাচাই করে নেওয়া। আর অ্যানেসথেসিওলজিস্টদের উচিত প্রি-অপারেটিভ অ্যাসেসমেন্ট করে, রোগীর সঙ্গে কথা বলে, রোগী বা স্বজনদের সম্মতি নিয়ে অ্যানেসথেসিয়ার প্রক্রিয়ায় যাওয়া।
তিনি আরও বলেন, অনেক জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে গিয়ে দেখবেন, অ্যানেসথেসিয়া সম্পর্কে না জানা ব্যক্তি তা রোগীর ওপর প্রয়োগ করছেন। তাই সার্জারিতে অপমৃত্যু কমাতে অ্যানেসথেসিয়া চিকিৎসক বাড়ানো জরুরি। কিন্তু সুযোগ-সুবিধা কম থাকায় অ্যানেসথেসিওলজিস্ট হতে আগ্রহী নন তরুণ চিকিৎসকরা।