ইসরায়েল আর হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি না হওয়ায় মুসলমানদের পবিত্র রমজান মাসে জেরুজালেমে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। রমজান শুরুর আগে যাতে একটি যুদ্ধবিরতিতে যাওয়া সম্ভব হয় তার একটা জোর প্রচেষ্টা চলছিল কিছুদিন ধরে। কিন্তু ইসরায়েল ও হামাসের অনড় অবস্থানের কারণে তা ভেস্তে যায়। এ অবস্থায় রমজানে জেরুজালেমের আল আকসা মসজিদে যাতায়াত ও পরিদর্শনের সুযোগ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে হামাস। তবে ইসরায়েল দাবি করছে, হামাস রমজান মাসে এই অঞ্চলটি অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে, যা কয়েকদিনের মধ্যেই শুরু হতে পারে। এদিকে শনিবার গাজা উপত্যকার মধ্যাঞ্চলের নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি হামলায় পাঁচ মাস বয়সী এক শিশুসহ ১৫ জন নিহত হয়েছে। অন্যদিকে গাজায় এ পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৩১ হাজার ছাড়িয়েছে। আহত
ছাড়িয়েছে ৭২ হাজার। খবর আলজাজিরার।
আল আকসা হলো ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান। এ জায়গাটিকে ইহুদিরাও তাদের পবিত্রতম স্থান বলে মনে করে, যা তাদের কাছে টেম্পল মাউন্ট নামে পরিচিত। কখনো কখনো এ জায়গাটি ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘর্ষের ফ্ল্যাশ পয়েন্ট হয়েও দাঁড়ায়। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আজকালের মধ্যে ফিলিস্তিনে পবিত্র রমজান মাস শুরু হবে। প্রায় প্রতি বছর রমজান মাসে এ মসজিদ এলাকার পরিবেশ অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। এ সপ্তাহে আল আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণ পরিদর্শনের সময় সেখানকার পরিবেশ এখন পর্যন্ত শান্ত দেখা গেছে। আয়াত নামে এক নারী অনেকটা কষ্ট নিয়ে বলেন, ‘লোকেরা নিয়মিত রমজানের ঐতিহ্য উদযাপন এবং উপভোগ করতে পছন্দ করে। কিন্তু এ বছর তার আর কিছুই হবে না।’
উল্লেখ্য, রোজার শুরুতে ৪০ দিনের একটা যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা ভেস্তে যায়। যদিও মিশরের একটি সূত্র বলছে, ইসরায়েলের সঙ্গে একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে তারা হামাসের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আজকালের মধ্যে দেখা করবে। শনিবার ইসরায়েল বলেছে, তাদের গোয়েন্দাপ্রধান মার্কিন প্রতিপক্ষের সঙ্গে দেখা করেছেন। কারণ তারা ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্ত করে আনার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এরপর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর একটি বিবৃতি প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, ‘হামাস তার অবস্থানে অটল রয়েছে। তারা আসলে কোনো চুক্তিতে আগ্রহী নয়।’ এদিকে আল আকসা মসজিদ ঘিরে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা জারি রেখেছে ইসরায়েলি পুলিশ। মসজিদ কমপ্লেক্সের প্রতিটি গেটে কন্ট্রোল অ্যাক্সেস চালু করা হয়েছে। ১৯৬৭ সালে যুদ্ধের মাধ্যমে ইসরায়েল এই অংশসহ পূর্ব জেরুজালেম দখল করে। তাই এই স্থানটি ফিলিস্তিনিদের কাছে সংগ্রামের একটি প্রতীক হয়ে উঠেছে। এখানে প্রায়ই ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনী এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনার বেশিরভাগই হয় রমজান মাসেই। এ জায়গাটিকে ইহুদিরা তাদের পবিত্রতম স্থান মনে করলেও, এখানে তাদের ধর্মীয় প্রার্থনা করার অনুমতি নেই। তারা শুধু এই জায়গাটিতে প্রবেশ করতে পারে।
২০২১ সালের মে মাসে আল আকসায় সহিংসতায় জেরুজালেমে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। ওই ঘটনার জেরে হামাস তখন জেরুজালেমে রকেট নিক্ষেপ করে। তখন গাজায় ছোটখাটো একটি যুদ্ধও হয়। এ নিয়ে তখন আরব বিশ্ব ও ইসরায়েলিদের মধ্যে ব্যাপক অস্থিরতাও দেখা দেয়। এ বছর রোজার মাস কীভাবে কাটবে, তা নির্ভর করছে ইসরায়েলের ওপর। কারণ তারা কী ধরনের উদ্যোগ বা কৌশল নেবে সেটি এখনো স্পষ্ট নয়। চরম ডানপন্থি ইসরায়েলি জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন গেভির আল আকসা মসজিদে প্রবেশে কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারির আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, এটি করা হবে হামাসের বিজয় উদযাপন বন্ধ ও ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তির জন্য। তবে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেছেন, রমজানের প্রথম সপ্তাহে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মসজিদে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে। তবে তারা প্রতি সপ্তাহে নিরাপত্তা পরিস্থিতি পুনর্মূল্যায়ন করবে। তবে এই আল আকসায় কত সংখ্যক মুসলমানদের প্রবেশের অনুমতি মিলবে, তা এখনো স্পষ্ট করেনি ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ। গাজা যুদ্ধের সময় পশ্চিম তীর থেকে ফিলিস্তিনিদের জেরুজালেমে প্রবেশে অনেকাংশেই বাধা দেওয়া হয়েছে। তবে পবিত্র এই রমজান মাসে জুমার নামাজ পড়তে হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে আল আকসায় যেতে হবে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর চেকপোস্টের মধ্যে দিয়ে। ইসরায়েল সরকারের মুখপাত্র আইলন লেভি জোর দিয়ে বলেন, ধর্মীয় প্রার্থনার স্বাধীনতার জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তিনি বলেন, ‘রমজানে প্রায়ই এমন একটি উপলক্ষ তৈরি হয় যখন উগ্রপন্থিদের কারণে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এবার আমরা তা প্রতিরোধের জন্য কাজ করছি।’ তার দাবি, ‘আমরা আগের বছরের মতো ধর্মীয় প্রার্থনার জন্য টেম্পল মাউন্টে প্রবেশের সুবিধা অব্যাহত রাখব। তবে কেউ যদি এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে পরিবেশ বিঘ্নিত করার চেষ্টা করে—আমরা তা প্রতিরোধ করব।’ ইসলামি ওয়াকফ কাউন্সিলের সদস্য ও আল আকসা বা হারাম আল শরিফের পরিচালক ড. ইমাম মুস্তফা আবু সোয়ের বলেন, ‘কয়েক বছর থেকেই পশ্চিম তীর থেকে যারা আল আকসায় আসছে তাদের অনুমতি দিচ্ছে ইসরায়েল। কিন্তু এতে কোনো সংঘর্ষ বা সহিংসতা হয়নি।’ তার দাবি, ‘এখানে মানুষ প্রার্থনা করতে আসে। শান্তি বিঘ্নিত করতে আসে না। যদি ইসরায়েলি পুলিশ কিংবা নিরাপত্তা বাহিনী তাদের কোনো বাধা না দেয়, তাহলে আশা করি কোনো সংকট তৈরি হবে না।’ এবার রমজানে সারা বিশ্ব আরও গভীরভাবে খেয়াল করবে জেরুজালেমে আল আকসা মসজিদ ঘিরে কিছু ঘটছে কী না।