বাজেট বাস্তবায়ন, ঋণ নিয়ে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ, প্রকল্পে অতিরিক্ত খরচসহ নানা কারণে অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি খাতে সরকারের ঋণ বেড়েই চলছে। অনেক সময় পরিচালন ব্যয় মেটাতেও ঋণ করতে হচ্ছে সরকারকে। এতে ধীরে ধীরে বাড়ছে দেশের মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ। যদিও জিডিপির তুলনায় সরকারের ঋণ এখনো বিপজ্জনক সীমায় যায়নি। বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় ঋণ-জিডিপির অনুপাতে বাংলাদেশ এখনো ভালো অবস্থানে আছে। তবে কম রাজস্ব আয় ও ডলার সংকটের কারণে ঋণ পরিশোধ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ঋণের সুদ পরিশোধেই বাজেটের উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যয় হচ্ছে। বর্তমানে দেশের মাথাপিছু ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ টাকা। অর্থাৎ আজ যে শিশুটি জন্ম নেবে, তার মাথায় ১ লাখ টাকা ঋণের দায় চাপবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেওয়া তথ্যানুযায়ী, অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি ঋণ মিলিয়ে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারের মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৮৪ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা। দেশের জনসংখ্যা বিবেচনায় নিলে মানুষের মাথাপিছু ঋণ দাঁড়ায় ৯৯ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা। অবশ্য মাথাপিছু ঋণের তুলনায় আয় এখনো বেশি। দেশের মানুষের বর্তমান বার্ষিক মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৭৯৩ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩ লাখ ৭ হাজার ২৩০ টাকা। অবশ্য আয় বেশি থাকলেও ঋণের ঝুঁকিই এখন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তথ্য বলছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের কারণে দেশে ডলার সংকট দেখা দিয়েছিল, যা এখনো চলমান। আর ডলার সংকট সামাল দিতে আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে রাজস্ব আদায় অনেকাংশেই কমে এসেছে, যার প্রভাব পড়ে দেশের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতায়। যদিও বাংলাদেশ কখনো খেলাপি হয়নি। তবে দেশের অভ্যন্তরে ডলার সংকট, ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট আর সরকারের আয়ের উৎসে বিভিন্ন বাধা ও ঋণগ্রহণের পরিমাণ যে হারে বাড়ছে, তাতে সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা। এরপরও বর্তমানের সংকট কাটাতে সরকার আরও বেশি বিদেশি ঋণের দিকে ঝোঁক বাড়িয়েছে। এতে দেশের মানুষের মাথাপিছু ঋণ বাড়ছে গাণিতিক হারে।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মাত্র চার বছরের ব্যবধানে সরকারের
দেশি-বিদেশি ঋণ বেড়েছে ৭২ দশমিক ৪৯ শতাংশ। আর ২০১৬ সালের তুলনায় বর্তমানের এ ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ১৯১ দশমিক ৮২ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব বলছে, বর্তমানে সরকারের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ৭ হাজার ৯৬৯ কোটি ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৮ লাখ ৭৬ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা। পাঁচ বছরের ব্যবধানে বিদেশি ঋণ বেড়েছে ১০৫ শতাংশ। এর বাইরে বর্তমানে দেশের অভ্যন্তরের সরকারের ঋণের পরিমাণ ৮ লাখ ৮ হাজার ৭৯ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে বর্তমানে সরকারের ঋণ ১৬ লাখ ৮৪ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, গত ডিসেম্বরে দেশের জনসংখ্যা ছিল ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জন। এ হিসাবে দেশের মাথাপিছু ঋণ দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার ৩৭৫ টাকা। ২০১৯ সালে মানুষের মাথাপিছু ঋণ ছিল ৫৭ হাজার ৬১১ টাকা। অর্থাৎ চার বছরের ব্যবধানে মাথাপিছু ঋণ বেড়েছে ৭২ দশমিক ৪৯ শতাংশ। আর ২০১৬ সালে ছিল ৩৪ হাজার ৫৩ টাকা। সে হিসাবে সাত বছরের ব্যবধানে মাথাপিছু ঋণ বেড়েছে ১৯১ দশমিক ৮২ শতাংশ।
পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় অনুযায়ী ঋণের পরিমাণ বেশি নয়। কিন্তু সরকারের ঋণের হার দিন দিন বাড়ছে। সে অনুযায়ী রাজস্ব আয় বাড়ছে না। যে কারণে ঋণের সুদ পরিশোধে সরকারের ওপর চাপ বেড়েই চলেছে। এ ছাড়া বিদেশি ঋণ সহনীয় পর্যায়ে থাকলেও বিশ্বব্যাপী সুদের হার বাড়ায় এটা সরকারের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সংকট সমাধানে সরকারকে রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। আমার যদি আয় বেশি হয় তাহলে আমি ঋণও বেশি নিতে পারব। এতে অর্থনীতির ওপর কোনো চাপ তৈরি করবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেশের অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি ঋণ বেড়ে যাওয়া কোনো সমস্যা নয়। যদি এর বিপরীতে সরকারের আয় বা রাজস্ব বাড়ানো যায় কিন্তু এখনো দেশের রাজস্ব আয় ৪ লাখ কোটি টাকা ছুঁতে পারেনি।’