সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচিত নাম মিল্টন সমাদ্দার। সবাই তাকে একজন মানবিক মানুষ হিসেবে চিনলেও আড়ালে তিনি এক ভয়ংকর প্রতারক। তার বিভিন্ন ধরনের প্রতারণা এবং আশ্রমের আড়ালে নানা অনিয়ম নিয়ে অনুসন্ধানী সংবাদ প্রকাশ করে কালবেলা। গত বৃহস্পতিবার ‘মানবিক মুখোশের আড়ালে ভয়ংকর মিল্টন সমাদ্দার’ ও ‘জীবনের ধাপে ধাপে প্রতারণা’ শীর্ষক দুটি সংবাদ প্রকাশ করে কালবেলা। এরপর থেকেই কালবেলা অফিসে ফোন দিয়ে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়ে অনেকেই মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন রাজনীতিবিদ, চিকিৎসক, নায়িকা, সমাজসেবক থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। তারা প্রত্যেকেই মিল্টন সমাদ্দারের বিভিন্ন ধরনের প্রতারণা এবং তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন।
এর মধ্যে একজন ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকসুর সাবেক জিএস গোলাম রাব্বানি। তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘একটি পেজ থেকে মাথায় গুরুতর ক্ষত ও ইনফেকশনে আক্রান্ত অজ্ঞাতপরিচয় এক কিশোরকে নিয়ে করা পোস্টে একজন আমাকে মেনশন করলে আমার নজরে আসে। তাকে ঢাকা নিয়ে আসতে পোস্টে উল্লিখিত হটলাইন নম্বরে যোগাযোগ করলে জানানো হয়, মিল্টন সমাদ্দার যোগাযোগ করে কিছুক্ষণ আগে গাড়ি পাঠিয়ে ছেলেটাকে নিয়ে গেছেন। আমি শুনে খুশি হয়ে মিল্টন সাহেবের নম্বরে ফোন করলে পিএস পরিচয়ে একটা মেয়ে ফোন করার কারণ জানতে চায়। আমি ছেলেটার কথা জিজ্ঞেস করতেই মেয়েটি সহসা রূঢ় আচরণ করে মুখের ওপর ফোন কেটে দেয়। আমি ফের কল দিয়ে মিল্টন দাদার সঙ্গে কথা বলতে জোরাজুরি করলে দুই-আড়াই মিনিট হোল্ডে রেখে ওপাশ থেকে কেন ডিস্টার্ব করছি বলে মিল্টন সাহেব কর্কশ স্বরে জানতে চান! তিনি অপ্রত্যাশিতভাবে চরম অসৌজন্যমূলক, বাজে ব্যবহার করেন। পরে কল্যাণপুরে স্থানীয় একজনের মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, ছেলেটার অসহায়ত্ব দেখিয়ে অনুদান সংগ্রহ করলেও তার কোনো চিকিৎসা করাচ্ছে না, এমন ঘটনা নাকি আরও বহু আছে! অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রির বিষয়েও ইঙ্গিত দিল।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ডা. গুলজার হোসেন উজ্জল ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমাকে মিল্টন তার প্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন চিকিৎসক হিসেবে কাজ করার জন্য প্রস্তাব দেন। বৃদ্ধাশ্রম আমার কাছে আবেগের জায়গা। তবে তিন মাস কাজ করার পর আমার মন উঠে যায়। মিল্টনের প্রতিষ্ঠানের নানারকম অসংগতি আমাকে সন্দিগ্ধ করে তোলে। মিল্টন সমাদ্দারের ব্যক্তিত্বও আমার কাছে নির্লোভ সমাজেসেবী বা জনসেবীর মতো (যা তিনি বোঝাতে চান) মনে হয়নি। সর্বোপরি আশ্রমের বৃদ্ধদের তিনি যে পরিবেশে রাখেন, তা দেখে আমার নিজেরই করুণা হয়। আমি নিজে একাধিকবার মৌসুমি ফল ও খাবার কিনে দিয়েছি। লক্ষ করেছি সেসব খাবার আশ্রমবাসীকে ঠিকভাবে বিতরণ করা হয়নি। উপরন্তু আশ্রমের বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের নিয়ে তিনি যেভাবে ভিডিও ও ফটোসেশন করতেন, তা রীতিমতো বাটপারিসুলভ আচরণ বলে মনে হতো। আমি তাদের যেভাবে চিকিৎসা দিতাম, সেভাবে ওষুধ কিনে দেওয়া হতো না। আমি একপর্যায়ে সেখানে যাওয়া বন্ধ করে দিই। একদিন মিল্টনের সঙ্গে আমার কথা-কাটাকাটিও হয়।’
মাজহারুল ইসলাম নামের এক ভুক্তভোগী ফেসবুক লাইভে এসে দাবি করেন, তাদের প্রায় ১৫ জনের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে নার্সিংয়ে চাকরি দেওয়ার কথা বলে মিল্টন সমাদ্দার অর্থ হাতিয়ে নিলেও কাউকেই চাকরি দেননি।
নায়িকা জাহারা মিতু মিল্টন সমাদ্দারের একটি পোস্টের নিচে কমেন্টে লিখেছেন, ‘কী সুন্দর অভিনয়! কী অভিনব প্রতারণা! প্রথমে তুই তোকারি করে পরে আবার তুমি করে বলছে। হঠাৎ মনে পড়ে গিয়েছে যে হায়রে, আমাদের তো ক্যামেরা ওপেন করা। প্রতি মাসে লাখ লাখ মানুষ টাকা পাঠায়। আমিও পাঠিয়েছি। আর এখন এসব কুকর্ম ফাঁস হলো। আর কেউ টাকা পাঠাবেন না এদের।’
কালকিনি থেকে ইফতেখার আলম রিশাদ নামের একজন ফোন করে কালবেলাকে জানিয়েছেন, গুলশান থেকে একজন অসুস্থ মানুষকে উদ্ধার করে তারা ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করেন। এরপর লোকটি মানসিক ভারসাম্যহীন হওয়ায় নাম বলতে না পারায় তাকে আশ্রমে পাঠানোর জন্য মিল্টন সমাদ্দারকে ফোন দিলে তিনি বাজে ব্যবহার করেন এবং অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করে ফোন কেটে দেন।
বাংলাদেশ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা নাফিসা আনজুম খান লিখেছেন, ‘আমিও এমন একটি বিষয়ে ২০২১ সালে কল করেছিলাম ওনাদের। যে অপমান হয়েছিলাম সেদিন, ভয়ে আর তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টাও করিনি।’ এ ছাড়া অসংখ্য মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিল্টন সমাদ্দারের ‘মুখোশের’ ফিরিস্তি তুলে ধরে পোস্ট করেছেন।
এদিকে মিল্টন সমাদ্দারকে নিয়ে কালবেলায় সংবাদ প্রকাশের পর সাভারের বাহিরটেক এবং বরিশালের উজিরপুরে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের উচ্ছ্বাস বইছে। এসব এলাকা থেকে একাধিক ভুক্তভোগী কালবেলাকে ফোন করে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
খ্রিষ্টান হয়েও মুসলিম পরিচয়ে ফেসবুকে বিজ্ঞাপন: সাধারণ মানুষের থেকে ফেসবুকের মাধ্যমে প্রতি মাসে প্রায় কোটি টাকা অনুদান সংগ্রহ করেন মিল্টন সমাদ্দার। তার মোট পাঁচটি আইডিতে ফলোয়ারের সংখ্যা ২ কোটির ওপরে। এসব আইডি ও পেজ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তার ব্যক্তিগত পেজ (Milton Samadder) থেকে বিভিন্ন সময়ে ফলোয়ার বাড়াতে অর্থ খরচ করে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। এজন্য জামায়াতের সাবেক নেতা ও যুদ্ধাপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হক, পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান, মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট মুরসি, মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের মতো ব্যক্তিদের ছবি ও মিথ্যা বক্তব্য ব্যবহার করেছেন। তার পেজ থেকে ২০২১ সালের ১১ এপ্রিল একটি বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। সেখানে দেলাওয়ার হোসাঈন সাঈদীর ছবি দিয়ে লেখা হয়, ‘আমি সাঈদী সাহেব বলছি। আগামী সপ্তাহে আমার মুক্তি হতে চলছে, আপনার একটা ভোট আমার খুবই প্রয়োজন, ডান পাশে ভোট দিন।’ বিজ্ঞাপনটিতে তিনি এক দিনে ১০০ ডলার খরচ করেন। পরে তিনি একই বিজ্ঞাপন আরও তিনবার প্রচার করেন। দ্বিতীয়বার ১১ থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত, তৃতীয়বার ১২ থেকে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত ও চতুর্থবার ১৩ থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত। এই তিনটি বিজ্ঞাপনেও তিনি প্রতিটির জন্য ১০০ করে মোট ৩০০ ডলার খরচ করেন। মিল্টন সমাদ্দার নিজে খ্রিষ্টান। কিন্তু ২০২১ সালের ২৪ ও ২৫ মে তার পেজে দুটি বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয় মুসলিম পরিচয়ে। ওই বিজ্ঞাপনে তিনি একজন নারীর ফিলিস্তিনি পতাকা হাতে থাকা একটি ছবি দিয়ে লেখেন, ‘আমি একজন মুসলিম হিসেবে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা চাই। আপনিও যদি ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা চান, নিচে ডানপাশে লাইক দিয়ে ভোট দিন।’
একই পেজ থেকে হেফাজত নেতা মামুনুল হকের ছবি দিয়ে একটি বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। ২০২০ সালের ৬ ও ৭ ডিসেম্বর প্রচারিত ওই বিজ্ঞাপনে মামুনুল হকের ছবির সঙ্গে লেখা হয়, ‘মুসলিম রাষ্ট্রে কোনোদিন ইসলামবিরোধী কোনো কিছু হতে দেব না। যতদিন এক ফোঁটা রক্তও রয়েছে, ডান পাশে লাইক বাটনে ক্লিক করে ভোট দিয়ে পাশে থাকুন।’
একই বছরের ১৭ অক্টোবর তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের কোরআন হাতে একটি ছবি দিয়ে লেখা হয়, ‘জীবন চলে যাবে, শেষ রক্ত বিন্দুকণা দিয়ে লড়ে যাব, তবু আল্লাহর কিতাবে আঁচড় লাগতে দেব না। একমত হলে পেজে লাইক দিয়ে পাশে থাকুন।’ ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর মিল্টন সমাদ্দারের পেজে এরদোয়ান, মুরসি, মাহাথির ও ইমরান খানের ছবি দিয়েও বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়।
অন্যদিকে তার ‘Child & Old Age Care.’ নামের ফেসবুক পেজ থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। এভাবেই প্রতারণার মাধ্যমে মানুষকে ধোঁকা দিয়ে তিনি তার ফেসবুকে ২ কোটি অনুসারী বানিয়েছেন বলে প্রমাণ পেয়েছে কালবেলা।