গত ২৪ মে (শুক্রবার) রাত সাড়ে ১২টা। রাজধানীর মিরপুর মডেল থানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয় অভিযানে আটক করা একটি মোটরসাইকেল। এভাবে আটক করা যান আদালতে জমা দেওয়ার বিধান থাকলেও তা মানেননি উপপরিদর্শক (এসআই) রুহুল আমিন। আর মোটরসাইকেল ছেড়ে দেওয়ার প্রক্রিয়ায় মধ্যস্থতা করেন চাকরিচ্যুত এসআই সুমন বিন শাকিল। এজন্য মোটরসাইকেলটির মালিক পাঠাও রাইডার মাহবুবের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা ঘুষ নেওয়া হয়। সেই টাকা লেনদেনের কয়েকটি ভিডিও আর মধ্যস্থতার ১৯ মিনিটের একটি অডিও রেকর্ড কালবেলার হাতে এসেছে। সেইসঙ্গে পাওয়া গেছে টাকা চেয়ে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো কয়েকটি মেসেজ।
কালবেলার হাতে আসা ভিডিওতে দেখা যায়, মিরপুর মডেল থানার সামনে কালো গেঞ্জি পরিহিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছেন চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা সুমন। তার সামনে সাদা শার্ট পরে দাঁড়ানো ইমরান আহমেদ নামে এক যুবক। তিনি ১ হাজার টাকার ২০টি নোট (২০ হাজার টাকা) চাকরিচ্যুত এসআই সুমনকে দেন। সেই টাকা গুনে নিয়ে থানার ভেতরে চলে যান সুমন। পরে ফিরে এসে মোটরসাইকেলের মালিক মাহবুব এবং তার বন্ধু ইমরান আহমেদকে নিয়ে আবারও থানার ভেতরে যান। এর কিছুক্ষণ পর বের হয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে চলে যান মাহবুব ও ইমরান।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সম্প্রতি রাজধানীর শেওড়াপাড়ার একটি বাসায় অভিযান চালান মিরপুর মডেল থানার উপপরিদর্শক রুহুল আমিন। সেখান থেকে চারজনকে আটক করা হয়। তবে বাড়ির ভেতরে আত্মগোপন করে গ্রেপ্তারের হাত থেকে রেহাই পান মোটরসাইকেলের মালিক মাহবুব। পরে বাড়ির সামনে থাকা মোটরসাইকেলটি জব্দ করে পুলিশ। এরপর ১০ দিনেরও বেশি সেটি মিরপুর মডেল থানায় ছিল। এরপর সমঝোতা হওয়ায় গত শুক্রবার রাতে সেটি ছেড়ে দেওয়া হয়।
জানতে চাইলে মোটরসাইকেলের মালিক মাহবুব হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘আমার মোটরসাইকেলটি আটকের পরে আমি রুহুল আমিন স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি একজন আইনজীবীকে ১০ হাজার টাকা দিতে বলেন। আমি সেটি দিই। এরপর বাইক চাইলে রুহুল আমিন টাকা পাননি জানিয়ে আরও ৫০ হাজার টাকা দাবি করেন। পরে আমার বন্ধু মাহবুবের মাধ্যমে এসআই সুমন স্যারের সঙ্গে কথা হয়। সুমন স্যারকে ২০ হাজার টাকা দিই। এরপর তিনি আমাদের নিয়ে রুহুল আমিন স্যারের কাছে যান। তিনি একটি সাদা কাগজে আমার স্বাক্ষর রেখে মোটরসাইকেল ছেড়ে দেন।’
কালবেলার হাতে আসা কয়েকটি হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজে দেখা যায়, রাত ৯টা ২ মিনিটে ভুক্তভোগী এসআই সুমনকে একটি হোয়াটসঅ্যাপে মোটরসাইকেলের ছবি পাঠান। এরপর ১০টা ৮ মিনিটে সুমন উত্তরে লেখেন, ২০ হাজার দিয়ে দেবে, যাও বাইক নিয়ে এসো। এর ৫ মিনিট পর আরেকটি মেসেজে সুমন লেখেন, নিজে ২০ হাজার দেওয়ার কথা বলে এখন না নিলে তো ভাই আমার কিছু করার নেই।’
এর ১৩ মিনিট পর আরেকটি মেসেজে লেখেন, ‘স্যারকে বলা আছে, গিয়া টাকা দিয়া বাইক নিয়া আসতে।’ এরপর ১০টা ৪২ মিনিটে আর একটি মেসেজে সুমন লেখেন, ‘ভাই আমার খাবার ম্যানেজ করে জানাও, আমি আসছি।’
এসআই রুহুল আমিনের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, এসআই সুমনের সঙ্গে টাকা লেনদেনের কথোপকথনের একটি স্কিনশর্ট রুহুল আমিনকে পাঠান ভু্ক্তভোগী। পরে ১০টা ৩৭ মিনিটে একটি কলে তাদের মধ্যে ৪৫ সেকেন্ড কথা হয়। এরপর ১০টা ৫৬ মিনিটে রুহল আমিন একটি মেসেজে ভুক্তভোগীকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমরা কোথায় আছো?’ এরপর রুহুল আমিন নিজেই ভুক্তভোগীকে কল দিলে তাদের মধ্যে ৪৯ সেকেন্ড কথা হয়। সর্বশেষ রাত ১১টা ৩১ মিনিটে তাদের মধ্যে হোয়াটসঅ্যাপে ২ মিনিট কথা হয়।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মিরপুর মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রুহুল আমিন কালবেলাকে বলেন, ‘এসবের সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আমাকে চক্রান্ত করে ফাঁসানো হয়েছে।’
তাহলে অভিযানে উদ্ধার করা মোটরসাইকেল জব্দ না দেখিয়ে থানায় এতদিন রেখে কীভাবে ছাড়লেন—এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি ওসি স্যারের নির্দেশে ছেড়েছি।’
এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে মিরপুর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) কালবেলাকে বলেন, ‘এ ধরনের লেনদেন হওয়ার তো কোনো সুযোগ নেই। লেনদেন হলে এটা অনৈতিক। কেউ এটা করে থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
থানা থেকে মোটরসাইকেল ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে তিনি অবগত ছিলেন কি না, জানতে চাইলে ওসি বলেন, ‘এটা তো স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আমরা সাধারণত বলে থাকি, কারও কাগজপত্র সঠিক পাওয়া গেলে যাচাই-বাছাই করে জিডিমূলে ছেড়ে দিতে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একসময় পুলিশে চাকরি করলেও মাদক সেবন ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে চাকরিচ্যুত হয়েছেন এসআই সুমন। তবে বর্তমানে তিনি পুলিশ পরিচয়ে বিভিন্ন থানায় দালালি করেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সুমন বিন শাকিল প্রথমে উগ্র আচরণ করেন। ঘুষ নেওয়ার ভিডিওর বিষয়টি জানানো হলে তিনি বলেন, ‘আপনার কাছে ভিডিও থাকতেই পারে। এটা তো এমন কিছু না। ভিডিওতে লেখা আছে, ওখানে কি সাউন্ড আছে?’
এরপর ঘুষ-সংক্রান্ত কথোপকথনের অডিও আছে জানানো হলে সুমন বলেন, ‘তাহলে আপনি সেটা নিয়ে মুভ করেন, আগান। আমাকে ফোন দিছেন কেন? আমি আপনার কাছে কোনো জবাব দিতে বাধ্য নই।’
এরপর তিনি ফোন কেটে দেন। পরে আবার ফোন দেওয়া হলেও আর ধরেননি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে মিরপুর জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার (মিরপুর) মাসুদ মিয়া কালবেলাকে বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। আপনার মাধ্যমেই জানলাম। আমরা খতিয়ে দেখে কেউ জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তবে পরে তিনি এই প্রতিবেদককে ফোন করে জানান, ‘সুমন মাদক সেবন করে। বর্তমানে পুলিশ থেকে চাকরিচ্যুত। বিভিন্ন থানায় এ ধরনের ঘটনা ঘটলে তিনি দালালি করার চেষ্টা করেন বলে আমরা জানতে পেরেছি।’ এসআই রুহুল আমিনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ওই অফিসার যদি জড়িত থাকেন, তবে আমরা তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেব।’