রাফসান জানি
প্রকাশ : ১১ জুন ২০২৪, ০৩:৪৮ এএম
আপডেট : ১১ জুন ২০২৪, ০৯:৪৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

পুলিশে উপেক্ষিত মানসিক স্বাস্থ্য

কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা নেই
পুলিশে উপেক্ষিত মানসিক স্বাস্থ্য

বাংলাদেশ পুলিশের মোট সদস্য সংখ্যা দুই লাখের বেশি। এর মধ্যে প্রায় দেড় লাখই সরাসরি মাঠপর্যায়ে কাজ করেন। দেশের জনসংখ্যা বিবেচনায় নিয়ে এখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত এই বাহিনীর জনবল অপ্রতুল। এ কারণে দীর্ঘ সময় ধরে একটানা দায়িত্ব পালনে বাধ্য হন পুলিশ সদস্যরা। অনেকেই প্রয়োজনের সময় ছুটি পান না। নানা কারণে পারিবারিক চাপসহ ব্যক্তিগত সমস্যার মধ্যেও দায়িত্ব অব্যাহত রাখেন পুলিশ সদস্যরা। এর ফলে কারও কারও মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। এমন পরিস্থিতিতে যথাসময়ে কাউন্সেলিং বা চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরানো যায়। তবে এ বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ না থাকায় মাঝেমধ্যেই ঘটছে নানা দুর্ঘটনা।

জানা গেছে, চাকরিতে যোগদানের শুরুতে পুলিশ সদস্যদের সারদায় মৌলিক প্রশিক্ষণের সময় ‘স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট কোর্স’ করানো হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে পুলিশের কাঠামোতে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক কোনো কাউন্সেলিং বা চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই, যা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত পুলিশ সদস্যদের আরও বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছে, পুলিশ সদস্যদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি সামগ্রিকভাবে উপেক্ষিত থাকায় আত্মহত্যা, হত্যার মতো ঘটনা ঘটছে। গত শনিবার রাতে রাজধানীর গুলশানে ফিলিস্তিন দূতাবাসের সামনে সহকর্মী মো. মনিরুল হককে উপর্যুপরি গুলি চালিয়ে হত্যা করেন কনস্টেবল কাওছার আলী।

কাওছারের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, তার মানসিক সমস্যা ছিল, যা নিয়ে তিনি চিকিৎসকের শরণাপন্নও হয়েছিলেন।

এ ঘটনার আগেও কর্মস্থল, ব্যারাক ও বাড়িতে পুলিশ সদস্যদের আত্মহত্যার খবর পাওয়া গেছে। যেগুলো বিশ্লেষণ করলেও সংশ্লিষ্টদের মানসিক সমস্যার বিষয়টি বেরিয়ে আসে।

২০২০ সালের খোদ পুলিশের পরিচালিত জরিপেও বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে হতাশার চিত্র উঠে এসেছে। জরিপে অংশ নেওয়া পুলিশ সদস্যরা সময়মতো ছুটি না পাওয়া, অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা, পরিবারকে সময় দিতে না পারা, ঊর্ধ্বতনদের বাজে ব্যবহারসহ নানা বিষয় উঠে আসে।

বাংলাদেশ পুলিশের মৌলিক প্রশিক্ষণ ও পরবর্তী সময়ে যে ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তাতে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টি খুবই সীমিত পরিসরে থাকে। উন্নত বিশ্বে পুলিশের স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট করার জন্য যে ধরনের ব্যবস্থাপনা থাকে, তা বাংলাদেশ পুলিশে ছিটেফোঁটাও নেই বলে জানিয়েছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘স্ট্রেস ম্যানেজমেন্টের জন্য আমাদের পুলিশ সদস্যদের যে ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন, তা সেই অর্থে আমাদের ব্যবস্থাপনায় নেই। মৌলিক প্রশিক্ষণ এবং চাকরিতে যোগদানের পর কিছু ক্লাস মাঝেমধ্যে হয়। এখন যদি পশ্চিমা বিশ্ব বা উন্নত রাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তাহলে বলব—ওইসব দেশে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে যে ধরনের প্রশিক্ষণ হয় তার ছিটেফোঁটাও আমাদের এখানে নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশের চাকরি সবচেয়ে স্ট্রেসফুল চাকরিগুলোর একটি। যারা মাঠে-ময়দানে কাজ করে, তাদের মধ্যে শারীরিক ও মানসিক যে ধরনের স্ট্রেস যায়, তা নিরসনে আমাদের এখানে সেই অর্থে খুব বেশি একটা কাজ করা হয় না, যা নিয়মিত কাজ করা প্রয়োজন। কারণ কর্মক্ষেত্রে এসে পুলিশ সদস্যরা নানা ধরনের প্রেশার নিয়মিত নিচ্ছে। তার মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক আছে কি না, তা দেখার খুব একটা সুযোগ হয় না, যা দেখা খুবই জরুরি।’

ঢাকায় পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট (পিওএম) বিভাগে দেড় বছর ধরে দায়িত্ব পালন করছেন কনস্টেবল রফিকুল ইসলাম (ছদ্মনাম)। গতকাল সোমবার তার সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘এই দেড় বছরে ছুটি পেয়েছি একবার। ছুটি পাওয়া যায় না, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডিউটি করা লাগে। কখনো কখনো ১২-১৮ ঘণ্টাও ডিউটি করতে হয়। সকাল ৮টায় ডিউটি শুরু হলে উঠতে হয় আরও তিন ঘণ্টা আগে। প্রস্তুত হওয়া, অস্ত্র সংগ্রহসহ নানা আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ডিউটিতে যেতে হয়। এরপর ফিরব কখন, তার কোনো ঠিক নেই। এভাবে দিনের পর দিন ডিউটি করতে হয়। ছুটি না পেলে পরিবারের কাছে যাওয়া যায় না, তাদের সময় দেওয়া যায় না। এই দূরত্ব কখনো কখনো কলহে রূপ নেয়, যা মানসিকভাবে খুব প্রেশারে ফেলে দেয়।’

ডিএমপির লালবাগ বিভাগের একটি থানায় কর্মরত উপপরিদর্শক পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘পুলিশে চাকরির পুরোটা সময় চাপে থাকতে হয়। চাকরিতে আসার পর একবার আমার খুব খারাপ অবস্থা হয়েছিল। কর্মস্থল, পরিবার সামলানো মুশকিল হয়ে যাচ্ছিল। নানাবিদ চাপে আমার সমস্যা হচ্ছিল। আমার যে মানসিক সমস্যা হচ্ছে, তা বুঝতেই অনেকদিন লেগেছে। পরে আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েছি। নিয়মিত কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে আমি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসি।’

তিনি বলেন, ‘মানসিক সমস্যায় পড়া এবং পরবর্তী সময়ে সুস্থ হয়ে ফিরে আসা—এই বিষয়টা সহকর্মী বা কর্মস্থলে বলতে পারিনি। কারণ মানসিক সমস্যা শুনলে সবাই ভাবে পাগল। ফলে গোপনে তা করতে হয়েছে।’

মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক সচেতনতা বাহিনীতে তৈরি করা খুবই জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক কাউন্সেলিং বা চিকিৎসাসেবা দেওয়ার বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেই। হাসপাতালের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এই হাসপাতালটি পুলিশ সদস্য ও তাদের পরিবারের জন্য জেনারেল হাসপাতাল। এখানে সব ধরনের সেবাই দেওয়া হয়। তবে তা সীমিত পরিসরে। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বিশেষ কোনো ব্যবস্থা আমাদের এখানে নেই। ভবিষ্যতে হবে কি না, তা পলিসি পর্যায়ের বিষয়।’

পুলিশ সদস্যদের মৌলিক প্রশিক্ষণের সময় স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে কোর্স করানোর পাশাপাশি চাকরিতে থাকা অবস্থায় বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পুলিশ সদস্যদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে সচেতন করা হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। বাংলাদেশ পুলিশের মুখপাত্র পুলিশ সুপার (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস) ইনামুল হক সাগর কালবেলাকে বলেন, ‘প্রশিক্ষণে স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট ও বিভিন্ন ধরনের কাউন্সেলিং আমাদের ট্রেনিং মডিউলের অন্তর্ভুক্ত। মৌলিক প্রশিক্ষণের সময় এগুলো করানো হয়। পরবর্তী সময়ে চাকরিজীবনেও পেশাগত মানোন্নয়নে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সেখানেও স্ট্রেস ম্যানেসমেন্ট, কী করা যাবে, কী করা যাবে না—এসব বিষয় অ্যাড্রেস করা হয়। কীভাবে স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট করতে হয়, তা নিয়ে কথা বলা হয়। এ ছাড়া টাইম টু টাইম ফোর্সদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ব্রিফ করে থাকেন। সবসময়ই এগুলো নিয়ে কাজ করা হয়।’

বিভিন্ন ধাপে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অধস্তন পুলিশ সদস্যদের আচরণগত বিষয়ে সুপারভিশন করে থাকেন জানিয়ে ইনামুল হক বলেন, ‘সুপারভিশনের মাধ্যমে কারও আচরণে অস্বাভাবিক কোনো কিছু পরিলক্ষিত হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী আমাদের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হয়।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

স্মার্ট লেনদেনে এক ধাপ এগিয়ে গুগল ওয়ালেট, কী পাচ্ছেন গ্রাহকরা?

সিইসির সঙ্গে বৈঠকে জামায়াতের প্রতিনিধিদল

বইয়ের সঙ্গে গাছ উপহার, জাতীয় পরিবেশ পদক পাচ্ছেন মাহমুদুল

মেলার স্টলে আ.লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন, নারী নেত্রী আটক

সেনাবাহিনীর অভিযান / সাবেক সিইসি নুরুল হুদার সঙ্গে মবকাণ্ডে জড়িত গ্রেপ্তার ১

কোচিং থেকে বাড়ি ফেরা হলো না হৃদয়ের

ইতিহাসের ব্যয়বহুল ন্যাটো সম্মেলন : মিনিটে ব্যয় সাড়ে ১৪ কোটি টাকা

২০২৬ সালের এইচএসসি পরীক্ষা হবে পূর্ণাঙ্গ পাঠ্যসূচিতে

ইরানের কতজন পরমাণুবিজ্ঞানী নিহত, জানাল ইসরায়েল

কুলাউড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স / রোগীদের নিম্নমানের খাবার দেওয়ার অভিযোগ

১০

কলম্বোতে টস জিতে ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশ, একাদশে ফিরেছেন মিরাজ

১১

বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে হাওরে হাউসবোট দখলের অভিযোগ 

১২

বৃহস্পতিবার শুরু এইচএসসি, অংশ নিচ্ছে ১২ লাখ শিক্ষার্থী

১৩

অতর্কিত হামলায় ইসরায়েলের ৭ সেনা নিহত

১৪

দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন ওএসডি

১৫

লাল ডিম না সাদা ডিম, কোনটির পুষ্টিগুণ বেশি

১৬

ভুয়া খবর ছড়াচ্ছে দুটি সংবাদমাধ্যম, ট্রাম্পের ক্ষোভ

১৭

মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদন / বাঙ্কার বাস্টারেও ধ্বংস হয়নি ইরানের পরমাণু কেন্দ্র

১৮

ইরানে ফের হামলার চেষ্টা, ইসরায়েলি ড্রোন ভূপাতিত

১৯

রাজশাহী মহানগরীর থানা-ওয়ার্ড যুবদলের কমিটি গঠনে সতর্ক চিঠি

২০
X