শিশু দুরন্ত হবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে শিশু যখন অতিমাত্রায় ডানপিটে ও অমনোযোগী হয়, কোথাও মনোসংযোগে ব্যর্থ হয়, তখন পড়ালেখাসহ প্রাত্যহিক কাজে ব্যাঘাত ঘটে। সেটাকে
অসুস্থতা হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। ডাক্তারি পরিভাষায় আচরণগত সমস্যাটির নাম ‘এডিএইচডি, বা অ্যাটেনশন ডেফিসিট
হাইপার অ্যাকটিভিডি ডিজঅর্ডার। অভিভাবক বা শিক্ষকরা সবার আগে এ সমস্যা চিহ্নিত করতে পারেন। সাধারণত তিন-চার বছরের মধ্যেই এ রোগের লক্ষণ দেখা যায়। তবে ১২ বছরের আগে যদি কোনো শিশু কমপক্ষে ছয় মাস ধরে অমনোযোগী, দুরন্তপনা বা অতিচঞ্চলতা দেখায়, তখন সে এডিএইচডিতে ভুগছে বলে চিহ্নিত করা হয়।
কারণ
n সমস্যাটির জন্য জিনগত ত্রুটিকে বেশি দায়ী করা হয়।
n এটিকে মস্তিষ্কের মনঃসংযোগ সংক্রান্ত সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
n কেউ কেউ রোগটিকে স্নায়ু বিকাশঘটিত বা আচরণগত সমস্যা বলে থাকেন।
n কখনো কখনো ‘নিউরো কেমিক্যাল ফ্যাক্টর’কে সংকট সূত্র বলে চিহ্নিত করা হয়।
n জন্মের সময় বা পরে যদি শিশু মাথায় আঘাত পায়, সে ক্ষেত্রে আঘাতজনিত কারণকে দায়ী করা হয়।
n সময়ের আগেই যদি কোনো কারণে শিশু জন্মায় এবং যদি তার ওজন কম হয়।
n গর্ভাবস্থায় ধূমপান ও মদপান।
n শরীরে জিঙ্কের ঘাটতি হলে।
n খাদ্যে কৃত্রিম রং ও প্রিজারভেটিভও এ রোগের কারণ।
গবেষণায় দেখা যায়, সারা বিশ্বে এ রোগে প্রতি এক হাজার শিশুর মধ্যে ১৭ থেকে ৫০ জন আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশে এ হার প্রতি হাজারে ১০ জন। এডিএইচডির আধিক্য মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের মধ্যে প্রায় চার-ছয়গুণ বেশি দেখা যায়।
লক্ষণ
n শিশুর চঞ্চলতা মানেই এডিএইচডি নয়। নিম্নোক্ত লক্ষণগুলো দেখা দিলেই এডিএইচডি—
n কোনো কিছুর প্রতি অধিক সময় মনোযোগ ধরে রাখতে না পারা।
n প্রতিনিয়ত আঘাত পাওয়া। যেমন—পড়ে যাওয়া, আঘাত পাওয়া ইত্যাদি।
n পড়ালেখা, খেলাধুলায় মনোযোগের অভাব।
n সারাদিন অস্থিরতা, দৌড়াদোড়ি, চিন্তাভাবনা না করে হঠাৎ কিছু করে ফেলা।
n স্থিরভাবে না বসা, বসলেও পা নাড়ানো, টেবিল চাপড়াতে থাকা।
n বই-কলম প্রায়ই হারিয়ে ফেলা, নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পারা, বদমেজাজ দেখানো, অন্যকে হুটহাট আঘাত করা।
n লাফিয়ে উঁচুতে উঠে যাওয়ার চেষ্টা।
n দ্রুত কথা বলা এবং শোনার আগেই জবাব দেওয়ার জন্য ব্যাকুল হওয়া।
n বড়দের কাজ বা কথাতে বাধা দেওয়া। ছোটদের খেলায় বাধা দেওয়া।
n একসঙ্গে অনেক কিছু করার চেষ্টা করা এবং কোনোটাই শেষ করতে না পারা।
n চারপাশ সম্পর্কে বেখেয়ালিপনা এবং নিয়মকানুন মানতে না চাওয়া। বারবার একই ভুল করা, অন্যমনস্ক থাকা এবং কোনো কিছু মনে রাখতে না পারা।
চিকিৎসা
n অতি চঞ্চলতা শিশুর শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও পড়াশোনার সমস্যা যাচাই করতে হবে।
n থাইরয়েড হরমোন, ফিনাইল কিটোনুরিয়া, অতিরিক্ত সিসার বিষক্রিয়া ইত্যাদি কারণ যাচাইয়ে ল্যাব পরীক্ষার মাধ্যমে দেখতে হবে।
n এডিএইচডি শিশুর চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় অভিভাবক, শিক্ষক, মনোবিদ, চিকিৎসক, সমাজকর্মীর অংশগ্রহণ থাকতে হবে।
n আচরণগত থেরাপি ও ড্রাগস থেরাপির মাধ্যমে কার্যকর ফল পাওয়া সম্ভব।
n চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ বা থেরাপি নেওয়া এবং আচরণগত নিয়মকানুন অনুসরণ করতে হবে।
n বয়স অনুপাতে সঠিক পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে।
n খাদ্য তালিকার কোমল পানীয়, চিপস, চকলেট, মিষ্টি, দোকানের জুস, প্রিজারভেটিভ খাবার, বাদাম, দুধ বা দুগ্ধজাত খাবার কমিয়ে দিতে হবে। শিশুর সবকিছুর জন্য একটি রুটিন তৈরি করতে হবে। কোনো নির্দেশ দিলে তা শান্তভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে। রূঢ় আচরণ করা যাবে না।
n শিশুর ভালো কাজের প্রশংসা করতে হবে এবং পুরস্কার দিতে হবে।
n শিশুর পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করতেই হবে। মোবাইল, টিভি তথা স্ক্রিনটাইম কমাতে হবে। শিশুকে ইতিবাচক সিনেমা, শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান দেখাতে হবে বেশি।
n শিশুকে পরিবারে বাইরে খেলার সুযোগ দিতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে নজর দিতে হবে যেন সে আত্মনিয়ন্ত্রণ না হারায়। সে ক্ষেত্রে শিশুর খেলা বা নেশার সময়কে সংক্ষিপ্ত এবং নির্দিষ্ট রাখতে হবে।
লেখক : হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক, রেনেসাঁ হোমিও মেডিকেয়ার। ২৫/৩, নবাব কাটারা, নিমতলী, চানখাঁরপুল, ঢাকা।
মোবাইল নম্বর : ০১৭১৭-৪৬১৪৫০