টোকন ঠাকুর
প্রকাশ : ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:১৬ এএম
আপডেট : ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:৩৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বাঁকের মুখে বাংলাদেশ: প্রসঙ্গ পিরিওডিক্যাল চলচ্চিত্র

বাঁকের মুখে বাংলাদেশ: প্রসঙ্গ পিরিওডিক্যাল চলচ্চিত্র

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর আমরা যে স্বাধীনতা লাভ করেছিলাম, চলতি প্রজন্ম সেই স্বাদ পেয়েছে ২০২৪-এর রক্তাক্ত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ছাত্র-জনতার মিলিত অভ্যুত্থানে ক্ষমতার পালাবদলের পর। নানারকম সমালোচনা তৈরি হয়েছে বা হচ্ছে এই পালাবদলের ব্যবস্থা নিয়ে। এটা তো হবেই। দেখতে হবে অভিযাত্রা কোন দিকে, তার জন্য একটু সময় তো দিতেই হবে

যে বাংলাদেশ আমরা চেয়েছি ১৯৭১ সালে, সেই চাওয়া অর্জন করতে গিয়ে লাখ লাখ বাঙালির প্রাণ ঝরে গেছে, লাঞ্ছিত হয়েছে বাংলার লাখো নারী, তবু সেই বাংলাদেশ কি আমরা পেয়েছি? দেশের কত শতাংশ মানুষ স্বাধীন নাগরিকের মর্যাদা লাভ করেছে? ভোটাধিকার, মানবাধিকার, যেমন একটি গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক পেয়ে থাকে। অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটেনি দেশের অর্ধেকেরও বেশি মানুষের। সাংস্কৃতিক ও বহুমাত্রিক মতাদর্শ ও ধর্ম পালনের সম্পূর্ণ নিরাপত্তা আসেনি। যে কারণে অনেক জনগুরুত্বপূর্ণ মৌলিক ইস্যুতেও বাংলাদেশের মানুষের জাতীয় ঐক্য ঘটে না, যা ঘটেছিল ১৯৭১ সালে। অবশ্য মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীও ছিল কিছু বাংলাদেশে, তারা পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় যুদ্ধের বাস্তবতায় পাকিস্তানি সেনাদের দালাল হিসেবে অপরাধমূলক কাজ করেছে। এককথায় তারা রাজাকার ছিল। ১৯৭১-এর স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশের বয়স বর্তমানে পাঁচ দশকে পা দিয়েছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ও জাতীয় পার্টি—এ তিন দলের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়েছে এক ও একাধিকবার। যে অভিপ্রায় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, তা কি পূরণ করতে পেরেছে রাজনৈতিক দলের সরকারগুলো? সরকার গঠন করা রাজনৈতিক দল কি বাংলাদেশের জনমানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণে মনোযোগী হয়েছে? হয়নি। জনগোষ্ঠীর বেশিসংখ্যক সাধারণ মানুষের জন্য সেই এক স্বাধীন মানচিত্র, পতাকা ও জাতীয় সংগীত ছাড়া আর কী অর্জন হয়েছে, সে প্রশ্ন রাখা যায়। খাদ্য, চিকিৎসা ও বাসস্থান নিয়ে যদি প্রশ্ন তুলি, তাহলে সাধারণ মানুষ ও সরকার গঠনের রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী-সমর্থকের চেহারা এক নয়, একেবারেই নয়। তাহলে স্বাধীনতার সুফল কি একটা শ্রেণির জন্য একচেটিয়া বরাদ্দ হতে থাকবে? সামাজিক ন্যায়-অন্যায় বিচারের প্রশ্নেও সরকারি দলের লোকদের জন্য একরকম ব্যবস্থা, সাধারণ মানুষের জন্য ব্যবস্থা সেরকম নয়। অর্থাৎ নাগরিক সুবিধা দেশের বেশিরভাগ মানুষের জন্য তা রাখা হয়নি, যা সেই শ্রেণিগত কিছু মানুষের জন্য রাখা আছে। শ্রমিকশ্রেণি প্রবাসে হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে অর্থ উপার্জন করে দেশে পাঠায়, নারী পোশাক শ্রমিকরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করতে করতে গাত্রবর্ণ বদল হয় তাদের, পাণ্ডুর লাগে দেখতে, তাদের সেই শ্রমে আসে ডলার, শাসক ও তাদের অংশীদার ধনিক ব্যবসায়ীশ্রেণি সেই টাকা কৌশলে ব্যাংক থেকে লুট করে বিদেশে পাচার করে সেখানে তাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বাড়িঘর বানায়। এসব এখন বাংলাদেশের সবাই জানে। কিন্তু কিছুই করার থাকে না যেন, এমন এক বাস্তবতার ভেতর দিয়েই ৫৩ বছর সময় এগিয়েছে, দেশের দৃশ্যমান অবকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে কিন্তু সরকার ব্যবস্থায় অংশীদার থাকা বেশিরভাগ মানুষ বা সাধারণ মানুষ প্রায় পরাধীন হয়ে গেছে। নাজুক হয়ে গেছে। কাহিল হয়ে গেছে। পরাধীন বলা ঠিক হলো না, সরকারাধীন হয়ে গেছে। কিন্তু সরকারি লোকদের জন্য যে সুবিধার ব্যবস্থা চালু আছে, সাধারণ মানুষের জন্য তা চালু নেই। এই চালু না থাকাটাই একপ্রকার বিধান হয়ে যাচ্ছিল যখন, ঠকতে ঠকতে মানুষের হয়তো পেছনের বেড়ায় পিঠ ঠেকে গেল। অর্থাৎ পরিবর্তন আবশ্যক, এমন একটা চৈতন্যে পৌঁছল সাধারণ মানুষ। ফলত, ইতিহাস রক্তাক্ত করে সংঘটিত হলো গণঅভ্যুত্থান, কেউ বলবে জুলাই অভ্যুত্থান, কেউ বলবে জুলাই-আগস্ট বিপ্লব। আমি বলব, রক্তাক্ত শ্রাবণ ২০২৪। ট্র্যাজেডি হচ্ছে, ১৯৭১ সালে যে রাজনৈতিক দলের অন্যতম নেতৃত্ব ছিল মুক্তিযুদ্ধে, ২০২৪-এ এসে সেই দল ও দলের সরকার ব্যবস্থাই হটিয়ে দিল আপামর ছাত্র-শ্রমিক-জনতা। হ্যাঁ, আওয়ামী রেজিম চেঞ্জ করতে ছাত্র-শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের জীবন দিতে হলো। শত শত নয়, হাজার পার হয়ে গেল লাশের স্তূপে, মাত্র তিন সপ্তাহেই। ফল? সরকার ও দলীয়প্রধান দেশ ছেড়ে তড়িঘড়ি হেলিকপ্টারে উঠলেন, দেশে পড়ে রইলেন তার নেতাকর্মী, ধস নামল এক অতিপরিচিত ন্যারেটিভের। যেনবা বাংলাদেশ একটি দলের একচ্ছত্র আগ্রাসন থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে তুলল, কারণ, ক্ষমতার মোহে সেই দল আত্মঘাতী খেলায় মেতে উঠেছিল, জাতীয় নির্বাচনে অসততা করে অন্তত পরপর দুবার তারা ক্ষমতায় বসেছে, যা বাংলাদেশের মানুষের কাছে অস্তিত্ব সংকটের শামিল হয়ে উঠল দিনে দিনে। নইলে, এত প্রাণ দিতে স্বতঃস্ফূর্ত হয় না শত শত ছাড়িয়ে হাজার মানুষ। এরকম হবে, এত প্রাণ দিতে হবে স্বাধীন দেশের একটি গণতান্ত্রিক নিরস্ত্র ছাত্র-জনতাকে, এটা বিশ্বাসযোগ্য ছিল না, ভাবনায়ও ছিল না আমাদের । কিন্তু তাই ঘটেছে। ঘটিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে। যেনবা গত শতাব্দীর এক পুরোনো জাহাজ ডুবে গেছে রক্তাক্ত শ্রাবণ কিংবা জুলাই হত্যাকাণ্ডের পর। সরকার পতনের পর অত্যন্ত নাজুক পরিস্থিতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। পুলিশ বিভাগ ভেঙে পড়েছে, প্রশাসন ভেঙে পড়েছে। ব্যাংকিং সেক্টর টিমটিমে। বাজারঘাট নিয়ন্ত্রণহীন। কিন্তু ভেঙে পড়াই তো আর শেষ কথা নয়। শেষ কথা, উঠে দাঁড়াতে হবে। সব অস্থিতিশীল বাস্তবতা পরাজিত করেই বাংলাদেশকে উঠে দাঁড়াতে হবে, ঘুরে দাঁড়াতে হবে।

অন্যান্য সেক্টরের মতো বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জলাবদ্ধতা ও দলাবদ্ধতাও কাটাতে হবে। গান-গল্প-কবিতা-চিত্রকলা-ভাস্কর্য-নৃত্য-নাটক-যাত্রাপালা-সার্কাস বা চলচ্চিত্রকেও যে কোনো একচ্ছত্রতা ও একরৈখিকতা থেকে মুক্ত করতে হবে। নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নপ্রবাহে নতুন তরঙ্গের চলচ্চিত্র ভাবনা, নির্মাণ ও প্রদর্শন প্রয়োজন আজ। সেই নতুনত্বে যোগদান করতে হবে এ মাধ্যমটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে যেমন, জড়তা ভাঙতে হবে নয়া সরকারি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিভঙ্গিতেও। আমি এ কথা বলতে চাই, বাংলাদেশের দর্শক নতুন চলচ্চিত্র গ্রহণ করার প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছে নেটবাহিত ব্যবস্থার গ্রাহক হওয়ার চর্চা দিয়েই। অর্থাৎ দর্শক বাংলাদেশে এগিয়ে আছে। কারণ, অন্যান্য দেশের চলচ্চিত্রও এখন তার হাতের মুঠোয়। আর চলচ্চিত্রেও তো হরেক জনরা। আলোচনা তুলব আজ পিরিওডিক্যাল চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে। নতুন বাংলাদেশে এখন আমরা আমাদের পার করে আসা ইতিহাসকে কীভাবে দেখতে পারি, কীভাবে মূল্যায়ন করতে পারি—অর্থাৎ বর্তমান বাস্তবতায় বাংলাদেশে পিরিওডিক্যাল চলচ্চিত্রকে কীভাবে দেখতে পারি আমরা? তবে কোনো কিছুই একরৈখিক নয়, কোনো একটি দৃশ্য ধারণে ক্যামেরা বসার পজিশন একই রকম করবেন না একাধিক সিনেমাটোগ্রাফার যেমন, একাধিক নির্মাতাও ফোকাস করবেন তার তার চাওয়া অনুযায়ী। কাজেই, একই ঘটনা একাধিক চিত্রনাট্যকার তার মতো করে লিখবেন, এটাই স্বাভাবিকতা। স্বাভাবিকতাই সর্বজনে গ্রহণযোগ্য। কাজেই, সে মুক্তিযুদ্ধের কোনো ঘটনাই হোক আর পলাশী প্রান্তরে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের কাহিনিই হোক, প্রত্যেকের নির্মাণ তার দক্ষতা ও পেরে ওঠার জায়গা থেকেই আলাদা হবে। কাজেই, কোনো কিছুকেই একরৈখিক করে দেখা ও দেখানোর জায়গা নেই। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কবিতা যেমন পঞ্চাশজন কবির রচনায় আলাদা আলাদাভাবেই উঠে আসবে। সেখানে শিল্পীর স্বাধীনতা যেন রক্ষা হয়, সে দায় সমাজের সবার। যেহেতু সমাজের লোকেরাই শিল্পীর কাজের ভোক্তা। কথা চলছে চলচ্চিত্র নিয়ে, কথা চলছে নতুন বাংলাদেশের বাস্তবতায় পিরিওডিক্যাল চলচ্চিত্র নিয়ে। তাই তো?

যদিও ফিকশন ও প্রামাণ্যচিত্র দুইটা দুই ভঙ্গির চিত্র। এখানে আজ আমরা প্রামাণ্যচিত্র নয়, শুধু ফিকশন-বাস্তবতার দিকে এগোবে। অবশ্য এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, পিরিওডিক্যাল হোক আর কনটেম্পোরারি হোক, প্রতিটি ফিকশন বা ফিচারফিল্ম তার তার মতো একটা গল্প নিয়ে দর্শকের কাছে পৌঁছতে চায়। কাজেই একই দাঁড়িপাল্লা দিয়ে সব গল্পকাহিনি মাপা যাবে না। ২০২৪-এ দাঁড়িয়ে যদি আমরা ১৯৪৭-কে দেখি বা ১৯৭১-কে দেখি এবং দেশ ভাগ ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যদি একাধিক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়, এর প্রত্যেকটার গল্প যেমন আলাদা হবে, নির্মাতা আলাদা, পাত্রপাত্রী আলাদা, লোকেশন আলাদা, টেকনিশিয়ান টিম আলাদা, বাজেট আলাদা—কাজেই একাকার করে দেখার সুযোগ নেই। ইতিহাসের আলো কোনো নির্মাতা তার কোন গল্পে কীভাবে দেখাবেন, তা নিয়ে নির্মাতার চিন্তার বাইরে অন্য কারও বা কোনো কর্তৃপক্ষেরও কিছু চাপিয়ে দেওয়া বা নসিহত করার সুযোগ নেই। এমনকি সরকারেরও নেই। কেন নেই? কারণ, যিনি কবিতা লিখবেন বা চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন, তিনি তার চিন্তাকে হাজির করছেন দর্শকের সামনে। দর্শক তার কাজের মূল বিচারক। যদিও দর্শক বা পাঠকের চিন্তারুচিকে পুনর্নির্মাণও তিনি করতে বসেননি। নির্মাতার স্বাধীনতা, লেখকের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করলে তো শিল্পে সীমানা নির্দেশ হয়ে যাবে, তাতে শিল্পকলা হবে না। আর স্বাধীনতা ছাড়া একজন শিল্পী হন কীভাবে? স্বাধীনতাহীন শিল্পী একপ্রকার কেরানি। আমি কেরানি অধ্যাপক বা কেরানি শিল্পীদের কথা তুলছি না এখানে। কাজেই, কোনো মতাদর্শ মাথায় নিয়ে শিল্পী থাকলে থাকতে পারেন, সে স্বাধীনতা তার আছেই, তবে কোনো শিল্পীর ওপর বাইরে থেকে কারোরই কোনো মতাদর্শ চাপিয়ে দেওয়ার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। শিল্প এক সৃষ্টি, সৃষ্টির দায়ভার স্রষ্টার, এটা মেনে নিয়েই শিল্পকলা। কোনো ধর্মাদর্শ বা রাজনৈতিক মতাদর্শকে যেমন মেনে নিতে বাধা নেই শিল্পীর, আবার অন্য কাউকেই পাত্তা না দিয়ে শিল্পী নিজেই রচনা করতে পারেন তার চিন্তার পথ। এটা পৃথিবী মেনে নিয়েছে। বাংলাদেশ পৃথিবীর অংশ।

দল বা দলীয় সরকার ব্যবস্থার রাজনীতি থাকবে, স্বাভাবিক। তারা সেই রাজনীতি বিস্তারের চেষ্টা চালাবেন, তাও ঠিক। কিন্তু শিল্পী মূলত প্রো-পিপল এক্সপ্রেশনিস্ট সত্তা, তাই দেশে দেশে এই দৃশ্যই আমরা সর্বকালে দেখতে পাব যে, কিছু শিল্পী সরকারি শিল্পী হয়ে উঠলেও ‘মেজর আর্টিস্ট’ সবসময় সরকারবিরোধী হয়। কারণ, সরকারব্যবস্থা জনতার পক্ষে থাকলেও, থাকার কথা থাকলেও, অন্তত আমাদের দেশে, অন্তত এতদিন যে ব্যবস্থা ছিল পাঁচ দশকব্যাপী, কখনোই ঠিকঠাক জনতার অভিপ্রয়ের ধার ধারেনি। সেই পুরাতন ব্যবস্থার অচলায়তন ভাঙার আকাঙ্ক্ষা সবসময় কাজ করেছে সাধারণ মানুষের মধ্যে, কিন্তু তা ভাঙা কি অত সহজ? এই ব্রিটিশ ব্যুরোক্রেসির কলোনি তো একদিনে গড়ে ওঠেনি এবং বহু আকাঙ্ক্ষার সমাহার হয়ে তবু শেষ পর্যন্ত রক্তাক্ত শ্রাবণ এলো বাংলাদেশে। রেজিম পতন ঘটেছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর আমরা যে স্বাধীনতা লাভ করেছিলাম, চলতি প্রজন্ম সেই স্বাদ পেয়েছে ২০২৪-এর রক্তাক্ত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ছাত্র-জনতার মিলিত অভ্যুত্থানে ক্ষমতার পালাবদলের পর। নানারকম সমালোচনা তৈরি হয়েছে বা হচ্ছে এই পালাবদলের ব্যবস্থা নিয়ে। এটা তো হবেই। দেখতে হবে অভিযাত্রা কোন দিকে, তার জন্য একটু সময় তো দিতেই হবে। কারণ, একটি প্রতিষ্ঠিত রেজিম হটিয়ে দিলেও, রেজিমকেন্দ্রিক অনেক কিছুই এখনো প্রতিষ্ঠিত আছে। আশা করা যায়, সেগুলোও হটে যাবে। নতুন ব্যবস্থা পোক্ত করে প্রতিষ্ঠার স্বার্থেই এসব হবে।

মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ। সত্য। ছিল জুলাই ২০২৪-এর মতোই ছাত্র-জনতার যুদ্ধ। সত্য। তবে মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের হাতে যেমন অনেকের কাছেই অস্ত্র ছিল, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর ও পুলিশের কাছে তো অস্ত্র ছিলই। সত্য। মুক্তিযুদ্ধ ছিল পাকিস্তানি সেনা ও রাজনৈতিক শাসনের বিরুদ্ধে, সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার সংগ্রাম, সত্য। মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টর ছিল, সেক্টর কমান্ডাররা ছিলেন, জেনারেল ওসমানী ছিলেন সর্বাধিনায়ক। সত্য। মেজর জিয়া চট্রগ্রামের কালুর ঘাট থেকে রেডিওতে ‘অন বিহাফ অফ আওয়ার গ্রেট লিডার শেখ মুজিব’ বলে দুঃসাহসী ঘোষণা দিলেন, সত্য। পরিচালনায় গঠিত হয় মুজিবনগর সরকার। সত্য। সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীন, কামরুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন মনসুর ছিলেন। সত্য। মওলানা ভাসানী ছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে, ছিলেন সিরাজ সিকদার। সত্য। সত্য নানারূপে প্রকাশিত। সত্য কি একরৈখিক?

পঁচিশে মার্চ উনিশ একাত্তর। অপারেশন সার্চলাইট নাম দিয়ে ঢাকায় মাঝরাত থেকে গণহত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে পাকিস্তানি সেনারা। পরদিন সারা দিন কারফিউ বলবৎ থাকল। ঢাকা বা বিভিন্ন শহরে মানুষ নিজেদের জীবন বাঁচানোর জন্য দিশেহারা ছিল। পৃথিবীর নানান গণমাধ্যমে এ খবর ছড়িয়ে পড়ল। স্বাভাবিকভাবেই, পাকিস্তান সরকারের প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন শুরু হলো। পরদিন, ২৭ মার্চ। অর্ধবেলা কারফিউ শিথিল করেছে সরকার। যেন, শহরের মানুষ পালাতে চাইলে নিরাপদে পালাতে পারে। যদিও সেই পলায়নপর বাঙালির ওপরও গুলি করেছে পাকিস্তানি সেনারা, কারফিউ শিথিলের নিয়ম নিজেরাই রক্ষা করেনি। দেখেছি, সূত্রাপুর-ফরাশগঞ্জ বিহারিলাল জিউ মন্দিরে খোদাই করে লেখা আছে অনেক মানুষের নাম, যারা সেদিন পালাতে গিয়েও হত্যার শিকার হয়। সূত্রাপুর-ফরাশগঞ্জই শুধু নয়, বহু জায়গায় এরকম হয়েছে। ২০২৪ বা পঁচিশের দর্শকের কাছে এরকম একটা সিকোয়েন্স তুলে ধরি? ২৭ মার্চ পুরান ঢাকার ভূতের গলির বাসিন্দারা যখন পালাচ্ছিল, তখন তারা পুরান ঢাকার বিভিন্ন গলি ধরে ধরে নদীর দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। তো পলায়নপর মহল্লাবাসীদের কেউ কেউ তখন ফিসফাস করে কথাবার্তা বলছে। একজন বলছে, ‘শেখ সাহেবরে নাকি ধইরা লিয়া গেছে?’ আরেকজন উত্তর দিল, ‘হ।’ ‘কবে?’ ‘পরশু রাইতে।’ ‘কই লইয়া গেছে?’ ‘কয়া পারুম না।’ এই বাস্তবতা প্রায় প্রামাণ্য, একে অস্বীকার করার সুযোগ নিতে চাইলে সত্য সত্য থাকে না। মানুষ হিসেবে আমাদের যাপিত জীবনের ভুলত্রুটি থেকে ক্রমশ আমরা সত্যের কাছেই তো পৌঁছাতে চাইব। তাই না?

জনযুদ্ধ ছিল মুক্তিযুদ্ধ, তা সত্য। সেই যুদ্ধের নেপথ্যে বঙ্গবন্ধু উপাধি পাওয়া শেখ মুজিবুর রহমান নামটি ছিল বাঙালির জন্য সর্বোচ্চ প্রেরণাদায়ক, সত্য নয়? জীবনের অনেকটা সময় তিনি বাঙালির রাজনৈতিক মুক্তির জন্য জেলজীবন যাপন করেছেন, তা কি সত্য নয়? সত্য। যুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি শাসক হিসেবে পুরোপুরিই ব্যর্থ হলেন, সত্য। এখন একটি চিত্রনাট্যে যদি কেউ সাতাশ মার্চ উনিশ একাত্তর সালের মহল্লা থেকে পলায়নপর মানুষের ফিসাফিসানিতে ওই কথাবার্তাটুকু শুনতে পান বা দেখতে পান বা পর্দায় দেখানো হয়, তা কি সত্য নয়? সত্য স্বীকার করে আসার দায় তো শিল্পীর থাকবেই। সেই সত্য যার পক্ষেই যাক, যাবে। যেমন, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানিদের দোসর ছিল, অর্থাৎ জামায়াত মানাবতাবিরোধী অপরাধে জড়িয়ে গেল তখন, তা কি সত্য নয়? সত্য।

তো পলায়নপর মহল্লাবাসীরা হয়তো একটি নৌকায় চড়ে বসল, হয়তো ‘ঢাকায় থাকলে বাঁচন নাই’ মনে করে তারা দূরের গ্রামের দিকে চলে যেতে চায়। নৌকায় নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-আবাল-শিশু আছে। একজনের হাতে একটি রেডিও আছে। সে রেডিওর নব ঘুরিয়ে স্টেশন ধরার চেষ্টা করছে। হয়তো ঝাপসা শোঁ শোঁ শব্দের ভেতর থেকে আকাশবাণীর একটি খবর শেয়ার করে নৌকাযাত্রীদের সঙ্গে। সে বলে, ‘মিলিটারিরা সমানে মানুষ মারাতেছে, তয় হালাগো মেইন টার্গেট হিন্দু।’ সত্য।

পাকিস্তানি সেনারা গলির মধ্যে একদল বাঙালিকে ধরে ফেলেছে। প্রথমে তাদের নাম জিজ্ঞাসা করা হয় ও তারা কলেমা তৈয়ব মুখস্থ বলতে পারে কি না, সেই পরীক্ষা নেওয়া হয়। সে পরীক্ষায় সবাই উত্তীর্ণ হয়ে গেলে, তাদের পরনের কাপড় খুলতে বলা হয়। এরকম বাস্তবতা কি সত্য নয়? এরকম আলোকচিত্র আমরা দেখিনি? তাহলে আজ একটি পিরিওডিক্যাল চলচ্চিত্র যদি আমরা দেখতে বসি, মুক্তিযুদ্ধের সময়ের সেই ভয়াবহ দৃশ্যও স্বীকার করে নিতে হবে। কারণ, তা সত্য। সত্য প্রাথমিকভাবে বীভৎস দেখালেও, সত্যই সুন্দর।

তবে হ্যাঁ, পিরিওডিক্যাল হোক আর কনটেম্পোরারি হোক, কোনো একরৈখিকতা যেন বেঁধে না ফেলে শিল্পীকে, শিল্পীর চিন্তাকে, এটা বিবেচনায় রাখতে হবে। নানারকম রাজনৈতিক পরিস্থিতি অতিক্রম করে আজ বাঁকের মুখে বাংলাদেশ, রাজনৈতিক নেতৃত্ব যেমন বন্ধ্যত্ব ভেঙে এক নতুন দিনের আভা দেখাচ্ছে, সমগ্র শিল্পকলাতেও চিরাচরিত অচলায়তন ভাঙা পড়ুক, অনেকের মতোই তা আমিও চাই। সমকালীন গল্পের কাহিনি-চলচ্চিত্র, পিরিওডিক্যাল চলচ্চিত্র—তার বেলাতেও ‘ভাঙচুর’ কেন নয়? একটা চরম রিয়ালিটির কথা বা প্রশ্ন রেখে আজকের আলোচনা এখানে শেষ করি। সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রী হলেও, কোনো ফিকশনে সঙ্গম দূর কি বাত, সামান্য একটি বিলাভেড চুমুও দেখানো হয় না বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে, এই ২০২৪ সালেও, অথচ দেশের জনসংখ্যা এখানে ১৮ কোটি। হলো কী করে?

লেখক: কবি, চলচ্চিত্র নির্মাতা

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বৃষ্টিতে বাইক চালাতে সাবধান না হলে বিপদ

যুবকের কাণ্ডে ৫ ঘণ্টা বিদ্যুৎ বন্ধ

২০২৬ সালে রোজা শুরু হতে পারে যেদিন থেকে

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফেরাতে রিভিউ আবেদনের শুনানি ফের আজ

সকালে উঠে ভুলেও করবেন না এই ৫ কাজ

উন্নত ও গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার মূল প্রেরণা কাজী নজরুল : রিজভী

কাজী নজরুল ইসলামের ৪৯তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

সহপাঠীদের সঙ্গে খেলতে গিয়ে নিখোঁজ, কচুরিপানার নিচে মিলল লাশ

সপ্তাহের ব্যবধানে সাড়ে ৪ হাজার সেনা হারাল ইউক্রেন

অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার পদে নিয়োগ দিচ্ছে আড়ং

১০

রাজধানীতে আজ কোথায় কোন কর্মসূচি

১১

এসিআই-এ নিয়োগ, আবেদন করুন অনলাইনে

১২

ঢাকায় বৃষ্টি নিয়ে আবহাওয়া অফিসের বার্তা

১৩

বসতভিটা ছিনিয়ে নেওয়ার হুমকি, সন্তানের বিরুদ্ধে বাবার মামলা

১৪

ব্রাজিলের মন্ত্রীর মার্কিন ভিসা বাতিল, দায়িত্বজ্ঞানহীন বললেন লুলা

১৫

ভিপি প্রার্থীর বিরুদ্ধে রুমমেটকে ছুরিকাঘাতের অভিযোগ, কী বললেন প্রক্টর

১৬

শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে বৃদ্ধ আটক

১৭

২৭ আগস্ট : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৮

২৭ আগস্ট : টিভিতে আজকের খেলা 

১৯

আজ থেকে নতুন দামে বিক্রি হবে স্বর্ণ

২০
X