ড. মোর্শেদ হাসান খান
প্রকাশ : ০৫ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৫ আগস্ট ২০২৫, ১২:৩৮ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

অংশীজন শিক্ষক সমাজও

অংশীজন শিক্ষক সমাজও

বাংলাদেশের আন্দোলন-সংগ্রামের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। যুগে যুগে জাতিকে পথ দেখিয়েছে। দুর্যোগ-দুর্বিপাকে, ক্রান্তিকালে দেশের হাল ধরেছে। এখান থেকে গড়ে ওঠা কোনো আন্দোলন কখনো ব্যর্থ হয়নি। চব্বিশের গণবিপ্লব তার আরেকটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ আঙিনায় যে বীজ উপ্ত হয়েছিল চব্বিশের জুলাইয়ে, আগস্টের ৫ তারিখ তা এক ফুলে-ফলে সুশোভিত বৃক্ষে রূপ নেয়। দীর্ঘ দেড় দশকের ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্তি পেয়ে সেই বৃক্ষের বক্ষ থেকে ছুটে আসা নির্মল বাতাসে যেন বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয় এ দেশের মুক্তিকামী ছাত্র-জনতা।

সরকারি চাকরিতে অযৌক্তিক কোটাপ্রথা সংস্কারের দাবিতে ১ জুলাই থেকেই রাজপথে গড়ে ওঠে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তবে তখন নিশ্চয়ই কেউ জানত না এর মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে ফ্যাসিস্ট পতনের বীজ। এ আন্দোলনই হবে হাসিনা খেদাও আন্দোলন। এ কোটা সংস্কারই একসময় রূপ নেবে রাষ্ট্রসংস্কার আন্দোলন নামের এক অনবদ্য অভিযাত্রায়। শিক্ষার্থীদের এই যৌক্তিক আন্দোলন শুরু থেকেই অত্যন্ত গোছালো ও পরিকল্পিত ছিল। তাদের প্রত্যেকটি দিনের কর্মসূচিতে ছিল ভিন্নতা। ছিল দূরদর্শী নেতৃত্বের ছাপ। সে কারণে এ

আন্দোলনের ওপর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নজর ছিল, ছিল আন্দোলন ঘিরে ব্যাপক আগ্রহও।

বলা যায়, বিপ্লবের সূচনাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে সক্রিয় ছিল শিক্ষকসমাজ। এরপর তা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গড়ে ওঠা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে শিক্ষকদের একটি বড় অংশই ছিল সরাসরি জড়িত। তারা কখনো রাজপথে থেকে সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের সাহস জুগিয়েছেন। কখনো বুদ্ধি-পরামর্শসহ নানাভাবে হয়েছেন আন্দোলনের সারথি। এ ক্ষেত্রে ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ইউট্যাবের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে সরব ও সুসংগঠিত।

ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ইউট্যাব দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে দীর্ঘদিন ধরেই জোরালো ভূমিকা পালন করে আসছিল। বিএনপিসহ বিরোধীমত দমনে হাসিনা সরকারের দমনপীড়নের কঠোর সমালোচনা, প্রতিবাদ এবং রাজপথে নানা কর্মসূচি নিয়ে দেশব্যাপী শিক্ষকরা আন্দোলন গড়ে তোলেন। যার সর্বশেষ পর্যায় ছিল চব্বিশের জুলাই-আগস্ট।

মধ্য জুলাইয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর যখন ছাত্রলীগ-যুবলীগ নামধারী সন্ত্রাসীরা হামলে পড়ে, তখন গর্জে ওঠেন ইউট্যাবের শিক্ষকরা। ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে সংগঠিত হয়ে তারা দাঁড়িয়ে যান রাজপথে, শিক্ষার্থীদের পাশে। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ এবং চট্টগ্রামে ছাত্রদল নেতা ওয়াসিম আকরাম হত্যার পর ১৬ জুলাই থেকেই দেশের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে যায়। আন্দোলন দমাতে সরকারের নজর যায় রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর।

২০ জুলাইয়ের পর সরকার ভয়ংকরভাবে রাজনৈতিক দমনপীড়ন শুরু করে। রাজনৈতিক নেতাদের বাসায় বাসায় গিয়ে তাদের ধরে নিয়ে আসতে থাকে। ব্লক রেইড দিয়ে পুরো রাজধানীতে এক ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে হাসিনার পালিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ অবস্থায় রাজপথেও দুর্বল হয়ে আসে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন।

পরিস্থিতি মোকাবিলায় পেশাজীবী সংগঠনগুলোকে সামনে নিয়ে আসে বিএনপি। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সংগঠন ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ইউট্যাবকে আরও সক্রিয় হতে নির্দেশ দেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। যদিও আন্দোলনের শুরু থেকেই ইউট্যাব সক্রিয় ছিল। তবে দলীয় প্রধানের ওই নির্দেশের পর সরকারি-বেসরকারি ক্যাম্পাসগুলোতে সব ধরনের সহযোগিতা নিয়ে ইউট্যাব আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিদিনই বিক্ষোভ মিছিল ও কর্মসূচি পালন করতে থাকে সংগঠনটি।

পৃথিবীর আদিকাল থেকেই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক একে অন্যের পরিপূরক। একটি আত্মিক সম্পর্ক। পৃথিবীর সব যুগে, সব দেশে এ সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি একইরকম। সক্রেটিস থেকে শুরু করে শেখ সাদি কিংবা আধুনিককালের শিক্ষকরাও সম্পর্কের এ রসায়ন রপ্ত করেন। বলা যায় অনেকটা চুপিসারে, মনের অজান্তেই এ মধুর অথচ শক্তিশালী একটি সম্পর্ক সৃষ্টি হয়।

চব্বিশের উত্তাল দিনগুলোয়ও সম্পর্কের সেই পুরোনো রসায়ন চোখে পড়ে। কেননা, শ্রেণিকক্ষে যে শিক্ষার্থীকে সততা, ন্যায় কিংবা দায়িত্বের প্রতি সজাগ-সচেতন করার সবক দেন শিক্ষকরা; সেই শিক্ষার্থীরা যখন রাজপথে অরক্ষিত হয়ে পড়ে, তখন তাদের সুরক্ষার বিষয়টি প্রধান হয়ে দাঁড়ায় শিক্ষকদের কাছে। সমাজ সংস্কারের প্রধান গুরু শিক্ষকদের দায়িত্ব শুধু শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে পথ বাতলে দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; তাদের ন্যায্য-অন্যায্য বুঝতে সাহায্য করা। তাদের জীবনে একটি পরিপূর্ণ গাইডলাইন দেওয়া। সত্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। চব্বিশের আন্দোলন একটি ধ্রুব সত্যকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। সে কারণে শিক্ষক হয়ে এ আন্দোলন এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগই ছিল না। ইউট্যাব এ কঠিন সত্যকে উপলব্ধি করেই পাশে ছিল সাধারণ ছাত্র-জনতার। সংকটে তাদের একা করে যায়নি। সংঘাতে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে বুলেটের মুখোমুখি হয়েছে। তাদের এ সাহসী উপস্থিতি শিক্ষার্থীদের মনোবল বাড়িয়েছে। একটি দানবীয় শক্তির বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়ার প্রেরণা জুগিয়েছে।

আন্দোলনের একেকটি দিন যেন একটি বিভীষিকাময় অধ্যায় সামনে আসতে থাকে। ইউট্যাব তার পুরো শক্তি দিয়ে রাজপথে সোচ্চার ভূমিকা পালন করতে থাকে। অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার কিংবা শাহবাগ থেকে ভিসি চত্বর সবখানে পুলিশের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়াতে দেখা যায় শিক্ষকদের। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আগলে রেখে তাদের শক্তি-সাহস আর অনুপ্রেরণা হয়ে লক্ষ্যে স্থির থাকে ইউট্যাব।

৫ আগস্ট। সারা দেশে কারফিউ বলবৎ রয়েছে। সকাল থেকেই থমথমে রাজধানী। হাজার হাজার নিরাপত্তারক্ষী। আগ্রাসী পুলিশের হাতে মারণাস্ত্র। সেনাবাহিনী-বিজিবির সাঁজোয়া যানে তাক করা রাইফেল। কালো পোশাকি র্যাবের ভয়ানক মহড়া। সব মিলে এক ভীতিকর পরিবেশ। কোথাও জনমানুষের অস্তিত্ব তখনো নেই। এরই মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে জড়ো হন ইউট্যাবের শিক্ষকরা। ইউট্যাব প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ড. এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম এবং মহাসচিব অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খানের নেতৃত্বে সেদিন শিক্ষকরা প্রথম কারফিউ ভাঙেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাদা দলের সব নেতৃবৃন্দ। তারা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শাহবাগ পর্যন্ত এগিয়ে গেলে পুলিশি বাধার মুখে পড়েন। কিন্তু শিক্ষকদের সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে সেদিন দাঁড়াতে পারেনি হাসিনার পুলিশ।

ইউট্যাবের সেদিনের সেই কারফিউ ভাঙার দৃশ্য মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো রাজধানীতে কারফিউ ভাঙার হিড়িক পড়ে যায়। গুটিয়ে যায় হাসিনার নিরাপত্তা বেষ্টনী। অলিগলিতে থাকা লাখ লাখ মানুষের লক্ষ্য ফ্যাসিবাদের ক্যান্টনমেন্ট গণভবন। জনস্রোত সেদিকেই ছুটতে থাকে। এরপর একটি কাঙ্ক্ষিত বিজয়। দুপুরের পরপরই হেলিকপ্টারে করে দিল্লি পালিয়ে যান চব্বিশের গণহত্যাকারী শেখ হাসিনা। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘ আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে ইউট্যাবের। যেই আন্দোলন ছিল এ দেশের সাধারণ মানুষের জন্য। যেই আন্দোলন ছিল একটি বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থার জন্য। সাধারণ শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অংশ হতে পেরে ইউট্যাবের প্রতিটি সদস্য গর্বিত। এই গর্ব দেশের প্রতিটি বোধবুদ্ধিসম্পন্ন শিক্ষকের। কেননা, শিক্ষকরাই তো একটি সমাজ, একটি দেশ গড়ার সত্যিকারের সৈনিক।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক এবং সাদা দলের আহ্বায়ক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ঘষা দিলেই উঠে যাচ্ছে ‘অমোচনীয়’ কালি

ভোটগ্রহণের আগেই স্বতন্ত্র প্রার্থীর অভিযোগ

৩৪৫ প্রতিষ্ঠানে সবাই পাস

অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার গুঞ্জনে মুখ খুললেন সোনাক্ষী

এইচএসসি: কোন বোর্ডের ফল পেতে কীভাবে এসএমএস পাঠাবেন

মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৭৫.৬১, জিপিএ-৫ কত?

এইচএসসি পরীক্ষায় কোন বোর্ড এগিয়ে, পিছিয়ে যে বোর্ড

২০২ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সবাই অকৃতকার্য 

‘জীবনের প্রথম ভোট, খুবই ভালো লাগছে’

এইচএসসিতে জিপিএ ৫-এর সংখ্যা কমলো অর্ধেকেরও বেশি

১০

তিন ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে নাম লেখালেন সাকিব

১১

এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, কোন বোর্ডে পাসের হার কত

১২

ভারতে চিকিৎসা নিতে গিয়ে মারা গেছেন কেনিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী

১৩

‘যেভাবে আমাদের প্রতি ঘৃণা, গাড়িতে আক্রমণ করা হয়েছে তা কষ্ট দেয়’

১৪

সাবেক এমপি শিবলীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা

১৫

এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাসের হার ৫৮.৮৩ শতাংশ

১৬

চুলা তৈরির সময় মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেল ৭১ রাউন্ড গুলি

১৭

বিশ্বকাপের ফাইনালে আর্জেন্টিনা

১৮

যমুনা ব্যাংকে চাকরি, বয়স ৪৫ হলেও আবেদন

১৯

রাকসু নির্বাচনে ভোটগ্রহণ শুরু

২০
X