বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা। তিনি ২০২৪ সালের আগস্টে অর্থ মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হন। পরবর্তী সময়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পান। দায়িত্ব পালন করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে। জাতীয় অর্থনীতির বিভিন্ন সমস্যা ও সম্ভাবনা, আগামীর অর্থনীতি, ব্যাংক ও আর্থিক খাত, এসএমইর উন্নয়নসহ নানা বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে কথা হয় কালবেলার
সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন? স্থিতিশীল, অনিশ্চিত নাকি পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয় পর্যায়?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: আমি এখন বলব স্থিতিশীল। কারণ, সামষ্টিক অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ, ফরেন এক্সচেঞ্জ রেট, মূল্যস্ফীতি ইত্যাদি। এসব সূচকে স্থিতিশীলতা এসেছে। এনার্জি ক্রাইসিসের বিষয়টা আগের চেয়ে অনেক ভালো পর্যায়ে আছে। আর রপ্তানি আয় বেড়েছে। তৈরি পোশাক রপ্তানি বেড়েছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। রাজস্ব সংগ্রহ গত বছর প্রথম চার মাস একটু কম ছিল, এখন সেখান থেকে ওপরে উঠছে। স্বাভাবিকভাবেই আমি বলব অর্থনীতি স্থিতিশীল। ব্যবসায় গতি ফিরে আসছে। বাইরে থেকে বিনিয়োগকারীদের উৎসাহ দেখানোর একটা সম্ভাবনাও দেখা দিচ্ছে।
বর্তমানে মুদ্রানীতি ও রাজস্ব নীতির সঙ্গে সমন্বয় হচ্ছে কি?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: হ্যাঁ, সমন্বয় আছে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে মুদ্রানীতির ব্যাপারে
কোনো হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে না, বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের নিজস্ব ভঙ্গিতে মুদ্রানীতি করছে, মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য একটা শক্ত নীতি করেছে তারা। ব্যাংকগুলোকে উজ্জীবিত করার জন্য তাদের তারল্য সহায়তা দিচ্ছে, তাদের পুনর্গঠনের জন্য কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে। তবে আমরা একটা সমন্বয় রক্ষা করার চেষ্টা করছি। আর সার্বিকভাবে সংস্কার চলমান। রাজস্ব আর মুদ্রানীতির মধ্যে সমন্বয় আছে, আমরা একই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি।
এক বছরের বেশি সময় ধরে আপনি অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা কোনটি দেখেন—রাজস্ব কাঠামো, বিনিয়োগ পরিবেশ, নাকি প্রশাসনিক দক্ষতার ঘাটতি?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: দুর্বলতা আছে সব জায়গায়। যেমন রাজস্ব আহরণ কম আমাদের। এর একটা কারণ হলো আমাদের সংগ্রহটা একটু কম হয়, লিকেজ আছে, তারপর অনেকে আবার কর এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করে। আমি বলব যে, সংগ্রহের পদ্ধতিতে দুর্বলতা আছে। প্রশাসনিক দুর্বলতা আছে। আমরা দুর্নীতি দূর করতে চাচ্ছি—আগে পনেরো বছরে এক ধরনের অভ্যস্ততা ছিল, তাদের অনেক ব্যাপারে বাধা দেওয়া হতো, সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে, স্বাভাবিক হতে একটু সময় লাগবে। নীতিগত কিছু কাজ বাকি আছে, ট্যারিফের ব্যাপার আছে—এখন সেসব জায়গায় উন্নতি করতে হবে। এজন্যই সংস্কারের ব্যাপার আসছে। গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো, আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা। সব মিলিয়ে দুর্বলতাগুলো আছে—এর ভেতরেই আমরা চেষ্টা করছি। সংস্কারের মূল লক্ষ্য হলো শুধু আইনগত সংস্কার নয়, প্রক্রিয়াগত সংস্কার। একটার সঙ্গে আরেকটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
অনেকে অভিযোগ করেন আমাদের বাণিজ্যনীতি ‘অ্যান্টি এক্সপোর্ট বায়াজড’—এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: ঢালাওভাবে ‘অ্যান্টি এক্সপোর্ট বায়াজড’ বলা যাবে না। কিছু কিছু জায়গায় আমরা রপ্তানিকে উৎসাহিত করছি। রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য আরও যে সহায়তা দেওয়া—যেমন পলিসিগত, আর্থিক—এগুলোর চেষ্টা আছে। তাদের নতুন প্রযুক্তি, নতুন কৌশল আয়ত্ত করার জন্য চেষ্টা আছে। রপ্তানির ক্ষেত্রে আরেকটা বিশেষ ব্যাপার আছে, তা হলো জ্বালানি সরবরাহ। সেটাতে অনেক সময় আমরা সহায়তার চেষ্টা করছি। সুতরাং এটাকে বায়াজড বলব না—অনেক সময় আমাদের সম্পদের অপর্যাপ্ততাসহ নানা সমস্যা কাজ করে। আর পক্ষপাতিত্বের ব্যাপারটা হলো, আমরা চেষ্টা করি যে কিছু কিছু পণ্য আমাদের লোকেরা তৈরি করুক, আমদানি যাতে না করতে হয়। আর রপ্তানির ক্ষেত্রে যে পণ্যের চাহিদা দেশে আছে, সেগুলো থাকুক। নিজস্ব বাজারেরও চাহিদা পূরণ করতে হবে। সাড়ে সতেরো কোটি জনসংখ্যার দেশে সবকিছু রপ্তানিমুখী হতে পারে না।
আপনার দায়িত্ব নেওয়ার সময় ব্যাংক খাত পুরোপুরি ভঙ্গুর অবস্থায় ছিল। সেখান থেকে অনেকদূর উঠিয়ে নিয়ে এসেছেন। ব্যাংক খাতে অনিয়ম, ঋণখেলাপি এবং রাজনীতির প্রভাবে যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, এর মূল শিকড় কোথায় বলে আপনি মনে করেন?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: প্রথমেই হলো তদারকি এবং সুশাসনের অভাব। ব্যাংকের মালিক বা এমডিদের রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর একটা সংস্কৃতি তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সেটা ঠিক প্রকৃত ব্যাংক খাতের প্রতিনিধিত্ব হয়নি। রাজনৈতিক প্রভাবের পেছনে মূলত কাজ করেছে কিছু মানুষকে সন্তুষ্ট করা। সেটা ব্যাংকিং বিবেচনার বাইরে থাকে। ব্যাংকের মালিক যে, সে রাজনীতি করে, তার পরিচালক রাজনীতি করে। তার আরেকটা ব্যবসা আছে। তার অন্য ব্যাংক আছে। তার আবার শিল্প-কারখানা আছে। তার আবার সংবাদপত্র আছে, তার আবার টিভি চ্যানেল আছে। তার অন্য বন্ধুবান্ধব অন্যান্য ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। এভাবেই পুরো ব্যাংক খাতে দুর্নীতি হয়েছে। ব্যাংকের টাকা বাইরে পাচার করে দেওয়া হয়েছে। অদক্ষ লোকজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সব মিলে ব্যাংক খাত দুর্বল অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছিল।
এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা খুব গুরুত্বপূর্ণ—এটা আপনি বলে আসছেন। আপনি নিজেও এক সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক কেমন স্বাধীনতা ভোগ করছে এবং এ স্বাধীনতা পরবর্তীকালে কীভাবে সমুন্নত রাখা যাবে?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের যে স্বাধীনতা আছে, তা যথেষ্ট। এখনকার মনিটারি পলিসিতে আমরা কোনো তদারকি করি না। তাদের কাজটাই হলো মনিটারি পলিসি ম্যানেজমেন্ট। সেখানে যে স্বাধীনতা নেই তা নয়। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় থেকে কিছু কিছু জায়গায় মনিটর করা হয়ে থাকে। কারণ, একটা সার্বভৌম দেশে সার্বভৌম অস্তিত্ব হলো অর্থ মন্ত্রণালয়—বাংলাদেশ ব্যাংক সেখান থেকে আলাদা হয়ে একেবারে স্বাধীন থাকবে, এটা সম্ভব নয়। অতএব যা আছে, এটা যথেষ্ট। তবে কিছু কিছু অপারেশনাল ক্ষেত্রে যেমন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ওপর তাদের কোনো কর্তৃত্ব নেই, অনেক রাষ্ট্রমালিকানা প্রতিষ্ঠানের ওপর তাদের প্রভাব নেই। এদিকে দৃষ্টি দিতে হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা ফিssন্যান্সিয়াল ডিভিশন বিলুপ্তির কথা বলেছেন অনেকে। আপনার অভিমত কী?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: এখানে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি আছে, ক্যাপিটাল মার্কেট আছে, নন-ব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউটগুলো আছে, এখানে এমআরএ আছে। এফআইডি বন্ধ হয়ে গেলে চলবে না। রাষ্ট্রায়ত্ত কমার্শিয়াল ব্যাংক এবং স্পেশালাইজড ব্যাংক সরকারের আওতায় আছে—সেগুলোর ব্যাপারে একটা বিবেচনা করা যেতে পারে। এখানে প্রশ্ন হলো, এতগুলো প্রাইভেট ব্যাংককে তারা ঠিকভাবে সুপারভাইজ করতে পারেনি এখন পর্যন্ত। আবার এগুলো গেলে ওভার বার্ডেন হয়ে যাবে কি না। বাংলাদেশ ব্যাংকের লোক আছে। ইডি আছে প্রায় চল্লিশজন। আমার সময়ে ইডি ছিল সাতজন। হয়তো তারা একই কাজ করছে চারজন মিলে, অথবা নিচের স্তরের কাজ ইডিরা করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের স্ট্রাকচার পর্যবেক্ষণ করার সময় এসেছে।
বেসরকারি ব্যাংকগুলো সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সংস্কারের কোনো উদ্যোগ আছে কি?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: চিন্তা আছে, কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে চারটা বেশ বড়। এ ছাড়া আরও স্পেশালাইজড ব্যাংকগুলো আছে। আমরা এখনই ওগুলোতে হাত দিতে চাই না। এখন রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়েছে, দুর্নীতি বন্ধ হয়েছে। ভবিষ্যতে হয়তো কাজ করা হবে। আমরা কিছুটা শৃঙ্খলা আনতে পেরেছি। যতটুকু সময় আছে তার মধ্যে দেখা যাক আরও কতটুকু করতে পারি।
ব্যাংক একত্রীকরণের একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ উদ্যোগে আপনার মূল্যায়নটা কী?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: এই মুহূর্তে যে পাঁচটা ব্যাংক একীভূত করা হয়েছে তাদের প্রথমত ম্যানেজমেন্ট সমস্যা ছিল, ম্যানেজমেন্ট পরিবর্তন হয়েছে। তারপর ছিল তারল্যের সমস্যা। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, এসব ব্যাংকের ওপর আমানতকারীরা আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। টাকা নেই, তাদের কত সাপোর্ট দেওয়া যাবে? অতএব পাঁচটাকে এক করলে একটু শক্তিশালী হবে। মানুষের আস্থা ফিরে এলেই ব্যাংকগুলো আবার দাঁড়িয়ে যাবে।
আমরা দেখেছি যে, নন-ব্যাংক প্রতিষ্ঠানগুলোর দ্বারাও মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আমানতকারীদের ক্ষতিপূরণে আপনারা কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন কি?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: এখন সরাসরি তাদের ক্ষতিপূরণে আমরা কিছু করছি না। নন-ব্যাংকের ব্যাপারে আমাদের চিন্তাভাবনা আছে। আমার এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংককে বলেছি। সংখ্যার দিক দিয়ে এটা অনেক। ডিপোজিট বেইজও কম। এখন চিহ্নিত করতে হবে, কতগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। দ্বিতীয় ধাপে দেখতে হবে ওইগুলোকে মার্জ করব নাকি একেবারে বন্ধ করে দিতে হবে। গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে হবে, সেজন্য আবার টাকা লাগবে।
যেগুলো বন্ধ হয়ে গেছে, তাদের আমানতকারীদের কী হবে?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: সেগুলো রিভিউ করে অবশ্যই আমানতকারীদের টাকা দিতে হবে। তারা বিশ্বাস করে টাকা রেখেছিল। আর প্রতিষ্ঠানগুলোকে লাইসেন্স দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকই। সেই ভিত্তিতেই আমানতকারীরা টাকা রেখেছিল। অতএব এটা আমাদের একটা দায়বদ্ধতা। বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টা দেখবে।
বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে সমবায় সমিতি, এমএলএম কোম্পানি ইত্যাদির নামে গরিব মানুষের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ প্রবণতা বন্ধে কী উদ্যোগ নিচ্ছেন?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: এটা বাংলাদেশ ব্যাংককে বহু আগেই জানানো হয়েছে যে, কো-অপারেটিভ ব্যাংক ইজ নট অ্যা ব্যাংক। আর এমএলএম কোম্পানি একেবারেই কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান না। এগুলো শুধু বেচাকেনার একটা প্ল্যাটফর্ম। আমরা এগুলোকে যথাসম্ভব নিরুৎসাহিত করছি। এককালে কো-অপারেটিভের মাধ্যমে লোকজন টাকা জমা করত। আমরা এসব বিষয়ে কঠোর নীতি অবলম্বন করছি যাতে কেউ প্রতারিত না হন।
মাইক্রো-ফিন্যান্স সংগঠনগুলোর কাজেও সমস্যা তৈরি করছে কো-অপারেটিভ—
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: যে নীতিগুলোর মাধ্যমে এগুলো চলত সেই নীতিগুলোও এখন আর নেই। এখন লোকে মাইক্রো-ফিন্যান্স প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ পাচ্ছে, ব্যাংকগুলো থেকেও পাচ্ছে। যদিও কো-অপারেটিভে অডিট হয়, তবু নানা ঘাটতি রয়ে গেছে।
এজন্য কী করা উচিত? কো-অপারেটিভের সঙ্গে কি অর্থ মন্ত্রণালয়ের যৌথভাবে কাজ করা উচিত, নাকি এটা বন্ধ করে দেওয়া উচিত?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: এক লাখেরও বেশি কো-অপারেটিভ সোসাইটি আছে। তারা যেটা করতে পারে, বিশেষায়িত করে কোনগুলো শুধু মার্কেটিংয়ের কো-অপারেটিভ আর কোনগুলো ভোগ্য পণ্যের, ইত্যাদি চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু ফিন্যান্সিয়াল কো-অপারেটিভ যারা শুধু টাকা-পয়সা লেনদেন করে, তাদের ব্যাপারে মন্ত্রণালয় সার্ভে করতে পারে। যেগুলো ভালো আছে সেগুলো রেখে বাকিগুলো বন্ধ করে দিতে পারে বা রি-অর্গানাইজ করতে পারে, যেটা ব্যাংক খাতে হচ্ছে। পিওর ক্রেডিট কো-অপারেটিভ অনেক আছে, যারা শুধু টাকা-পয়সা লেনদেননির্ভর নয়। সেগুলোকে আলাদাভাবে বিবেচনা করতে হবে। মাংস প্রক্রিয়াকরণ কো-অপারেটিভ, দুগ্ধজাত পণ্যের কো-অপারেটিভ কিংবা বাস মালিকদের কো-অপারেটিভ—সেখানে মালিকরা মিলিত হয়ে তৈরি করে। অন্য যেগুলো শুধু টাকা লেনদেন করে, সেগুলোকে নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সমবায় মন্ত্রণালয়ের যৌথভাবে পদক্ষেপ নিতে পারে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রবৃদ্ধির গতি বৃদ্ধি পেলেও বৈষম্য বেড়েছে। গ্রোথ উইদাউট ইকুইটি—এর মূল কারণ কী?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: প্রবৃদ্ধি বা আয়ের সুবিধা সমাজের পিছিয়ে পড়াদের কাছে পৌঁছায়নি। প্রবৃদ্ধির সুবিধাগুলো যাচ্ছে যারা এরই মধ্যে সম্পদের মালিক, যাদের এরই মধ্যে কর্মসংস্থান আছে, দোকানপাট বা এরকম কিছু আছে, তাদের কাছে। যারা এর বাইরে তাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। পরোক্ষভাবে পৌঁছাচ্ছে, পরোক্ষভাবে বৈষম্যটা দূর হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত বাংলাদেশে শুধু আয়ে নয়, সুযোগেও বৈষম্যটা রয়ে গেছে। আমি শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছি না, বাসস্থানের সুযোগ পাচ্ছি না বা আমার সামর্থ্য দিয়ে আমি সম্পদের মালিক হতে পারছি না। সম্পদের বৈষম্য থাকলে অর্থাৎ যার সম্পদ কম তার আয়ও কমে যায়। তার জীবনযাত্রার মানটা বাড়াতে পারছে না। এ বৈষম্য আমরা দ্রুত কমাতে পারছি না। ধীরে ধীরে কমছে, কিন্তু দ্রুত কমাতে পারছি না।
আমাদের উন্নয়ন দিন দিন ভোগ ও ঋণনির্ভর হয়ে পড়ছে কি?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: আমাদের ঠিক ঋণনির্ভর নয়। আমরা চাপে আছি। নানা দুর্যোগে, অনেক সময় স্বাস্থ্যগত কারণে বা কোনো একটা জরুরি অবস্থায় বাধ্য হয়ে ঋণ করে মানুষ। জীবন নিয়ে সবাই চাপে থাকে, একটু এদিক-ওদিক হলেই অনেককে ঋণে পড়তে হচ্ছে।
বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে নীতি কাঠামো ও প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে কোনটি সবচেয়ে বড় বাধা?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: বৈদেশিক বিনিয়োগের জন্য আমাদের রেগুলেটরি সাপোর্ট বা সরকারের আইনকানুনগুলো বিনিয়োগবান্ধব হওয়া দরকার। দেশি এনার্জি ও অন্যান্য সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন। আরেকটা হলো জমি। জমি অধিগ্রহণ করে রেজিস্ট্রেশন করতে অনেক সময় লাগে। এসবই বাধা। অতএব বিদেশিরা আমাদের দেশে এলে এ সাপোর্টগুলো দিতে হবে। দ্বিতীয় হলো ট্যাক্স পলিসি। এটাতেও স্থিতিশীলতা থাকতে হবে। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এমনকি প্রতিষ্ঠান প্রধানের পরিবর্তনেও অনেক সময় আমাদের এখানে নীতির বদল হয়ে যায়। এটা অন্য দেশে হয় না। আরেকটা বিষয় হলো আমাদের স্থানীয় যারা বিনিয়োগ করতে পারছে না, তাদের কাউন্টার পার্ট লাগবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আসবে এখানে—তাদের এজেন্ট লাগবে, অন্যান্য লোকবল লাগবে। চট করে একটা বড় কোম্পানি এসে কাজ করতে পারবে না, যদিও বেশ বড় কোম্পানি সবকিছু নিজেরাই নিয়ে আসে। কিন্তু মধ্যমমানের কোম্পানিরা জয়েন্ট ভেঞ্চার করবে। আরেকটা কোম্পানির সঙ্গে তারা কাজ করবে—সেই কোম্পানি থাকতে হবে। এখানে কনফিডেন্সের ব্যাপার আছে। যে কোম্পানির সঙ্গে কাজ করবে তাদের গভর্নেন্সটা কী। এসব কিছুই বাইরের বিনিয়োগের জন্য দরকার।
তরুণদের জন্য টেকসই কর্মসংস্থান তৈরিতে কী ধরনের আর্থিক নীতি প্রয়োজন?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: তরুণদের জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার হলো, তারা যাতে নিজেরাই কিছু করতে পারে সে ধরনের সহায়তা তৈরি করা। খালি চাকরি তৈরি করলে হবে না। তাদের জন্য বহুমুখী অর্থনৈতিক কার্যক্রম দরকার। আমরা বড় বড় ব্যবসা দেখি—কিন্তু তারা এখন আর নতুন নতুন জায়গা যেমন আইটি সেক্টরে যাবে, তাদের নিজস্ব সার্ভিস আইডিয়া তৈরি হবে, এমনকি কৃষিসংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াজাতকরণ নানা কাজে তাদের কাজের সুযোগ তৈরিতে সহায়তা করতে হবে।
আপনি বরাবরই এসএমইকে গুরুত্ব দিয়ে আসছেন। এসএমইতে অগ্রগতি হলো কতটা?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: ব্যাংকগুলোর একটা সমস্যা হলো, তাদের ওরিয়েন্টেশন সেকেলে! তারা খালি টাকা দেবে, কোলাটেরল নেবে—এভাবেই চিন্তা করছে এখনো। কিন্তু ক্লায়েন্টকে বড় করতে হবে। তার ক্লায়েন্ট গ্রো করলে ব্যাংক গ্রো করবে। কিন্তু তাদের ধারণা, আমি এখানে বসে আছি আর টাকা দেব, ক্লায়েন্টরা টাকা ফেরত দিয়ে যাবে। ব্যাংকগুলো এখনো যেন আগেকার মহাজনের মতো গদিতে বসে আছে, টাকা দেবে আর টাকা নেবে। কিন্তু ব্যাংক তো মহাজন নয়। ব্যাংকগুলো উদ্যোক্তাদের গড়ে তুলবে, রিস্ক নেবে। সেটা করতে পারছে না। এটা এ ক্ষেত্রে একটা বড় সমস্যা। বাংলাদেশ ব্যাংকেও এসএমইর ফান্ড আছে। কিন্তু তাদেরও যথেষ্ট উদ্যোগের অভাব আছে।
আপনার দৃষ্টিতে এখন সবচেয়ে জরুরি তিনটি অর্থনৈতিক সংস্কার কী—যেগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতির স্থিতি ফিরে পেতে পারে?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: একটা অবশ্যই ব্যাংক অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সেক্টর। ব্যাংকের সংখ্যা না, ব্যাংকের সার্ভিস বাড়াতে হবে। দ্বিতীয় হলো আমাদের জ্বালানি, অতিসত্বর আমাদের নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয় হলো আমাদের রাজস্ব। রাজস্ব আদায় এবং রাজস্ব খাত সংস্কার করা। নিজস্ব আয় বাড়ালে আমাদের যেটা সুবিধা হবে, কারও মুখাপেক্ষী হতে হবে না, বাইরের ঋণও আনতে হবে না।
আগামীতে যে সরকার আসবে, তাদের জন্য আপনি কী পরামর্শ দেবেন?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: আমাদের যতদূর করার আমরা করেছি। কিছু কিছু পদ্ধতির আমরা সংস্কার করেছি। দ্বিতীয় হলো, প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও দক্ষ করা, আমলাতন্ত্রকে আরও জবাবদিহির মধ্যে আনা। দুর্নীতিকে যেভাবেই হোক কমিয়ে নিয়ে আসা। আর যারা উদ্যোগী ব্যবসায়ী—তাদের সহায়তা করা, শুধু বড় বড় ব্যবসায়ীকে নয়। অর্থাৎ সুযোগটা ছড়িয়ে দিতে হবে। কৃষকের জন্য বাড়াবেন, শ্রমিকের জন্য বাড়াবেন, গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির জন্য বাড়াবেন, নারীদের জন্য বাড়াবেন। তবেই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নত হবে।
মন্তব্য করুন