বহু বছর ধরে আপনি সুন্দরবন নিয়ে কাজ করছেন—বনে যাওয়া-আসাও আপনার বহুদিনের। সুন্দরবন নিয়ে আপনার ভাবনা সম্পর্কে জানতে চাই।
সুন্দরবন বা ম্যানগ্রোভ এমন একটা ইকোসিস্টেম, যেখানে সমুদ্র এবং বন একসঙ্গে মেশে। সাধারণত যেখানে পলিবাহিত বড় নদীগুলো সাগরে মেশে, তখন সেখানে পলি জমে অল্প গভীরতার পলি বা সেডিমেন্ট শেলফ তৈরি হয়। নদীবাহিত পানি সেখানে সমুদ্রের পানির সঙ্গে মেশে। সাগরের জোয়ার-ভাটার জন্য এই ম্যানগ্রোভ এমন একটা বন, যার গাছগুলোর শিকড় দিনের অনেকটা সময় পানির নিচে থাকতে পারে। সেই পানিটা মিষ্টি পানি নয়, নদী এবং সাগরের পানি মিশে একটা মাঝামাঝি লবণাক্ততা তৈরি হয়। অর্থাৎ ম্যানগ্রোভের বৈশিষ্ট্য হলো পলিবাহিত পানিতে নিমজ্জিত মূল নিয়ে বাঁচতে পারে, এমন কিছু প্রজাতি; যারা আধা মিষ্টি, আধা লবণ পানিতে জীবন ধারণ করতে পারে তেমন জীববৈচিত্র্যের সন্নিবেশ। এ পরিস্থিতিতে সব উদ্ভিদ বেঁচে থাকতে পারে না। দেখা যায় মোটামুটি ৫০-৬০ রকমের গাছ এখানে টিকে থাকতে পারে। এ উদ্ভিদরা কিন্তু বিশেষ কোনো উদ্ভিদ না; এদের কোনো একটাকে ঢাকা শহরে নিয়ে এসে রোপণ করলেও হয়তো সেটা বেঁচে থাকবে। কিন্তু দেখা যায় যে, অন্যান্য অভ্যন্তরীণ উদ্ভিদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তারা বেশি দিনে টিকে থাকতে পারে না। ম্যানগ্রোভ প্লান্টগুলো অন্যান্য অভ্যন্তরীণ গাছের থেকে দুর্বল। কিন্তু ম্যানগ্রোভ এলাকায় যেহেতু অন্য গাছ টিকতে পারে না লবণাক্ততার কারণে, সেখানে ম্যানগ্রোভ জন্য সেই প্রতিযোগিতাটাই অনুপস্থিত।
তবে আমরা যাকে সুন্দরবন বলি, আমাদের মধ্যে একটা ভুল ধারণা আছে যে, বন বা ফরেস্ট মানেই শুধু দৃষ্টিলব্ধ একটা ব্যাপার, যেখানে অনেক গাছ থাকবে, ঘন জঙ্গল থাকবে, বড় বড় গাছে ভেতরটা অন্ধকার হয়ে যাবে, ভেতরে গেলে বাঘ-হরিণ ঘরে থাকবে এরকম কিছু। এটা বন সম্পর্কে খুবই ভিজুয়াল একটা কনসেপ্ট। একটা বন মানেই কিন্তু শুধু তার গাছপালা বা রাজকীয় ও উপকথায় বর্ণিত প্রাণীরা নয়। বন মানে একটা ভাইব্রান্ট ও ডাইভার্স একটা ইকোসিস্টেম, মানে প্রাণবন্ত ও প্রাচুর্যে ভরা একটা বাস্তুতন্ত্র। আপনি যদি আমাদের লাউয়াছড়া বনে যান, খুবই ছোট একটা বন, কিন্তু সেখানকার জীববৈচিত্র্য দেখলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন। সেখানকার অনেক পোকামাকড়, প্রাণী আছে, যেগুলোর হয়তো এখনো নামকরণই করা হয়নি। সেটা কয়েক মিলিয়ন বছরের প্রাণবন্ত ও প্রাচুর্যে ভরা একটা বনভূমি।
মানে, মিলিয়ন বছরের প্রজাতি-পরম্পরা এখনো নিরবচ্ছিন্ন আছে সেখানে!
হ্যাঁ, মিলিয়ন বছরের সেই পরম্পরা এখনো আছে। যদিও সেখানে প্লান্টেশন হয়েছে—মানে নতুন করে নির্বাচিত কিছু গাছ লাগানো হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের ফরেস্টগুলোর মধ্যে এটা একটা অরিজিনালি একটা ন্যাচারাল ফরেস্ট ছিল। প্রাকৃতিক বনগুলোতে একদিকে যেমন উদ্ভিদ বৈচিত্র্য বিদ্যমান থাকে, অন্যদিকে এর প্রাণীবৈচিত্র্যও থাকে সক্রিয়। একটা হেলদি ফরেস্ট মানে তার বায়োডাইভার্সিটি সমৃদ্ধি এবং শুধু সমৃদ্ধি না, সেই বায়োডাইভার্সিটিটা হতে হবে হাইলি ডায়নামিক। এর একটা গতি থাকে।
আমাদের সুন্দরবনের ক্ষেত্রে যদি আসি—প্রথম কথা হচ্ছে, এটা একটা ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। সর্বশেষ আইস এজ যখন ছিল, তখন পুরো এই বঙ্গোপসাগর, উপমহাদেশ বা আমাদের এলাকার ভূমি একেবারেই অন্যরকম ছিল। এখন থেকে প্রায় বিশ-বাইশ হাজার বছর আগে একটা ক্লাইমেট চেঞ্জ বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং হয়েছে। যার ফলে বরফ যুগ চলে যেতে থাকে। সর্বশেষ আইস এজ চলে যাওয়ার কারণ কিন্তু ওই গ্লোবাল ওয়ার্মিং। সে সময়টাতে মেরুর বরফ গলে গলে সারা পৃথিবীতেই সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়তে থাকে। গত পনেরো বা বিশ হাজার বছরে এই সমুদ্রপৃষ্ঠটা প্রায় ৪৫০ ফুট বেড়েছে। এই ৪৫০ ফুট সমুদ্রপৃষ্ঠ বাড়ার আগে কী ছিল? বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতির দিকে যদি দেখেন—এর উত্তর এবং পূর্বদিকে কিন্তু হিমালয়ান মাউন্টেন রেঞ্জ। অর্থাৎ হিমালয়ের বড় বড় পর্বত এবং তার সঙ্গে লেগে থাকা আরও ছোট ছোট পর্বতসারি। আমাদের পূর্বে সিলেট-চট্টগ্রামের যে পাহাড়সারি, সেটাও কিন্তু এ হিমালয়ান ট্র্যাক্টেরই অংশ। অন্যদিকে রাজশাহীর যে বরেন্দ্র এলাকা—এ দুই এলাকার ভূমি মিলিয়ন মিলিয়ন বছরের পুরোনো এবং এ দুয়ের মাঝখানের যে এলাকাটুকু, অর্থাৎ পূর্বে চট্টগ্রাম-সিলেট, উত্তরে ভারতের মেঘালয় এবং পশ্চিম উত্তরবঙ্গ, এর মাঝখানের যে জায়গাটুকু, এটা ছিল ৪৫০ ফুট নিচু প্রস্তর ভূমি এবং আমাদের যে পদ্মা নদী, যেটা গঙ্গা—সেটাও কিন্তু ছিল ওই ৪৫০ ফুট নিচে। বঙ্গোপসাগরে সুন্দরবনের মাঝ বরাবর যে সমুদ্র তলদেশের সোজাসুজি সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডের কথা আমরা জানি, যেটা আসলে সাগরের নিচে একটা এক কিলোমিটার গভীর, কয়েক কিলোমিটার চওড়া একটি ডুবো গিরিখাত। এই সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডটিই প্রাক্তন পদ্মা বা গঙ্গা নদী যেটা আমাদের রাজশাহী পর্যন্ত বিস্তৃত। পঁচিশ হাজার বছর আগে ক্লাইমেট চেঞ্জ শুরু হয়েছে, বছরের পর বছর প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছে। একদিকে বৃষ্টির পানিতে বাহিত হয়ে আসা এই পলি জমেছে, বাংলাদেশের মধ্যবর্তী ভূমি উত্তরপ্রান্ত থেকে ধীরে ধীরে ৪৫০ ফুট উঁচু হয়েছে। অন্যদিকে সি লেভেল রাইজ হয়ে এগিয়ে এসেছে সমুদ্র। আমাদের ৮৫ ভাগ পলি আসে কিন্তু ওই গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র রিভারসিস্টেম থেকে। এই যে সমুদ্রের পানি ও পলি—এ দুটোর সংযোগস্থলটাই কিন্তু সুন্দরবন। এটা আগে অনেক উত্তরে ছিল। সমুদ্রের পানি একসময় হিমালয়ান রেঞ্জের পাহাড়গুলোর কাছাকাছি ছিল। তারপর যতই পলি পড়েছে, ততই পিছিয়েছে দক্ষিণে এখনকার অবস্থানের দিকে। মাটি বেশি উঁচু হলে আবার ম্যানগ্রোভ কিন্তু সার্ভাইভ করতে পারে না। শুকনো মাটিতে ম্যানগ্রোভের জীবন টেকে না। ম্যানগ্রোভটা তাই সবসময়ই সাগর আর মাটির সংযোগস্থলের দিকে যেতে থাকে।
সম্ভাব্য গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণে আবার যদি সমুদ্রপৃষ্ঠ বেড়ে যায়, তাহলে সুন্দরবনটা কি দুদিক দিয়ে উভয় সংকটের মধ্যে পড়ে যেতে পারে?
এটা একটা সহজ প্রশ্ন কিন্তু উত্তরটা জটিল—কারণ সি লেভেল এখন আবার দ্রুত বাড়ছে। সমুদ্রের পানি এখন প্রতিবছরে বাড়ছে প্রায় ৩ থেকে ৪ মিলিমিটার করে এবং এটাও খুব একটা স্থিতিশীল সংখ্যা না। জোয়ার-ভাটা, চন্দ্রের কলা, ঋতু পরিবর্তন ও আবহাওয়ার কারণে এ অঞ্চলের পানির লেভেলের হ্রাসবৃদ্ধির তুলনায় এ মাত্রাটা খুবই কম। এর সঙ্গে আরও অনেক ফ্যাক্টর জড়িত আছে যেমন—আমাদের হিমালয়ও কিন্তু প্রতিবছর প্রায় ১ সেন্টিমিটার করে ওপরে উঠছে। হিমালয় যে শুধু একাই ওপরে উঠছে তা না—আমাদের এই পুরো টেকটনিক প্লেটসহ কিন্তু ওপরে উঠছে। অর্থাৎ হিমালয়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ভূমিও কিছুটা ওপরে উঠছে। হয়তো অতটা না, তবু কিছুটা হলেও ওপরে উঠছে প্রতিনিয়ত। সেই সঙ্গে প্রতিবছর নতুন করে যে পলি পড়ছে, এটাও কিন্তু প্রায় ৮ মিলিমিটার থেকে ১ সেন্টিমিটারের বেশি এবং কোথাও কোথাও এটা ৪-৫ সেন্টিমিটারের মতো। আবার পলি তার নিজের ভরেও একটু দেবে যাচ্ছে। এসব ওঠানামা মিলেই এটা কিন্তু একটা কমপ্লিকেটেড ক্যালকুলেশন; যেখানে ইতিবাচক হারটাই বেশি প্রকৃতিগতভাবে। সুতরাং যেসব জায়গায় অবাধে পলি পড়তে পারছে, সেসব জায়গা খুব একটা সংকটে বলে আমি মনে করি না। গত ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছরে আমার যে অভিজ্ঞতা, তাতে কোথাও দেখিনি যে, একটা এলাকা উঁচু ছিল, এখন তলিয়ে গেছে। আমরা সব জায়গায় দেখছি যে, ল্যান্ড গেইনই হচ্ছে। আলটিমেটলি আমাদের হিসাবও বলে যে গেইনই হবে। এমনকি সি লেভেল রাইজিং বর্তমান হারে যদি হয়ও।
দারুণ ব্যাপার। আমরা সুন্দরবন নিয়ে আলাপ করছিলাম।
হ্যাঁ, এটা প্রকৃতির রক্ষাকবচ। ম্যানগ্রোভ এলাকায় খোলা উপকূল থেকে পলি জমে বেশি। কারণ এখানকার গাছের শ্বাসমূলগুলো পানির গতি কমিয়ে দেয়। পানির গতি যত কমে, পলি তত স্থিত হয়। সে কারণে আমাদের অন্য কোস্টগুলোতে পলি পড়ে যতটুকু উঁচু হয়, ম্যানগ্রোভে উঁচু হয় তার চেয়েও অনেক বেশি।
এটা কি সুন্দরবনের প্রাকৃতিক চ্যালেঞ্জ?
না, প্রধানত মানবসৃষ্ট চ্যালেঞ্জ। এই যে আমাদের নদীগুলোর বুকে পলি জমে যাচ্ছে দেখে কোনো কোনো রিভার সিস্টেমের পানি প্রবাহের গতি কমে যাচ্ছে। এর কিছুটা প্রাকৃতিক। মানবসৃষ্ট হচ্ছে শুষ্ক মৌসুমে নদী থেকে যথেষ্ট পানি টেনে নেওয়া ও নানাভাবে নদী দখল ও নদীর প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করা। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো আমরা অনেক ক্ষেত্রে যে ইচ্ছামতো বাঁধ দিচ্ছি, যেমন পোল্ডার কিংবা বেড়িবাঁধ ইত্যাদি। এই বেড়িবাঁধ দেওয়ার ফলে, যে কোনো রিভার সিস্টেমে যাকে বলে ফ্লাডপ্লেইন—এটা এমন একটা জায়গা, যখন বন্যা বা জোয়ারের পানি, কিংবা প্রচণ্ড বৃষ্টি বা স্লাইকোনের পানি আসবে, এই পানিটা নদীর কূল ছাপিয়ে একটা সমতলে ছড়িয়ে পড়ে। যার ফলে পানির গতি কমে সেই পানির সঙ্গে যে পলিগুলো আছে সেগুলো মাটিতে অধঃক্ষিপ্ত হতে পারে। কিন্তু এ বাঁধগুলোর কারণে পানি যখন ফ্লাডপ্লেইনের এলাকা খুব কমে যায় বা পানি প্রবাহিত হতে বাধাপ্রাপ্ত হয়, তখন পলিগুলো ভূমিতে অধঃক্ষিপ্ত হতে না পেরে সেগুলো নদী বা খালের বুকে গিয়ে জমা হয় এবং তাই হচ্ছে। আমরা সব জায়গায় বাঁধ দিয়ে দিচ্ছি। এর ফলে পলি জমে প্রকারান্তরে নদী-খালই ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এতে মিষ্টি পানির প্রবাহ কমে সুন্দরবন এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে, এটা একটা ডিজাস্টার।
সুন্দরবন নিয়ে আপনার দুশ্চিন্তাগুলো কী?
বন বা ফরেস্ট বলতে আমরা সাধারণত গাছপালাঘন একটা পরিবেশকে বুঝি, বন মূলত কিন্তু শুধুই তা নয়। একটা ফরেস্ট বা একটা ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট ইকোসিস্টেমে যে বায়োটিক বা অ্যাবায়োটিক প্রসেস যেমন তার জিওফিজিক্যাল সিস্টেম, বায়োলজিক্যাল সিস্টেম, এর যে একটা খাদ্যশৃঙ্খলা বা ফুডওয়েব সিস্টেম আছে—এ সবকিছু নিয়েই একটা ভাইব্রান্ট ফরেস্ট। এখন যদি এমন একটা অবস্থা হয় যে, সুন্দরবনের ইকোসিস্টেমের এসব ডায়নামিক মেকানিজমগুলো ব্যাহত হয়ে গেল বা অনেক জায়গায় মরে গেল, তখনো কিন্তু দেখবেন যে বেশ কিছু বাড়ন্ত গাছপালা আছে, কিন্তু তখন আমরা একে আর হেলদি ফরেস্ট বা হেলদি ম্যানগ্রোভ বা হেলদি ইকোসিস্টেম বলতে পারব না। কারণ এর যে আরও অনেক উপাদান, যেটা প্রাকৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ, মানুষ ও সমাজের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ—সেগুলো কিন্তু তখন সে দিতে পারবে না। শুধু বাংলাদেশেই তো ম্যানগ্রোভ আছে সেটা নয়, পৃথিবীর অনেক দেশেই ম্যানগ্রোভ আছে এবং ছিল। আমেরিকাতে আছে এভারগ্লেডস ম্যানগ্রোভ, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়শিয়াতেও বিশাল এলাকাজুড়ে ম্যানগ্রোভ আছে। ভারতের পশ্চিম ও দক্ষিণের অনেক এলাকায় ম্যানগ্রোভ আছে। দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর প্রায় সব ম্যানগ্রোভ ইকোসিস্টেমই অলরেডি ডেড বা খুব দুর্বল স্বাস্থ্য নিয়ে বেঁচে আছে। অর্থাৎ তাদের যে ডায়নামিক হেলদি ইকোসিস্টেম ছিল, তার ৮০-৯০ ভাগ ধ্বংস হয়ে গেছে। প্রজাতির সংখ্যা অনেক কমে এসেছে। এটি পুরো এলাকার ইকোসিস্টেমে যে অবদান রাখত, সেটি আর রাখে না। ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের ক্ষেত্রে একটা কথা প্রচলিত—ফ্র্যাগমেন্টেশন। আমাদের সুন্দরবন কিন্তু মোটামুটি পুরোটাই একটা বন। এজন্য এটাকে পৃথিবীর বৃহত্তম সিঙ্গেল ম্যানগ্রোভ বলা হয়, অর্থাৎ এটা সম্পূর্ণ একটা ইউনিট। এখন এটা যদি টুকরো টুকরো হয়ে যায়, তাহলে কিন্তু এটা একটা দুর্বল ইকোসিস্টেমে পরিণত হয়ে যাবে। যেমন লাউয়াছড়া বন—এটার ইকোসিস্টেম প্রথমে খুবই স্বাস্থ্যবান ছিল। আমরা করলাম কি, এর মাঝখান দিয়ে একটা রেললাইন নিয়ে গেলাম। এটা বনটাকে দুভাগে ভাগ করে ফেলল। এটাকেই বলা হয় ক্যানোপি ফ্যাগমেন্টেশন। মানে বনের গাছগুলোর ছাউনি একটার সঙ্গে যে একটা লেগে থাকে, ওটাকে যখন আমি রেললাইন বসিয়ে বিচ্ছিন্ন করে দিলাম, তখন একদিকের উল্লুক-হনুমান এরা আর অন্যদিকের প্রাণীদের সঙ্গে মিশতে পারছে না। তাদের স্বাভাবিক জীবনগতি কিন্তু ব্যাহত হয়ে গেল। আবার মাঝখান দিয়ে আরেকটা রাস্তা বানিয়ে একই বনকে আবার তিন ভাগ করে ফেলা হয়েছে। কাপ্তাইয়ের ফরেস্টকেও আমরা একইভাবে তিন ভাগ করে ফেলেছি। সুন্দরবনেও এমন হতে পারে। শুধু কাঁকড়া প্রাণীটি যদি নিঃশেষ হয়ে যায়, তাহলে এটা সুন্দরবনও ফ্র্যাগমেন্টেড হয়ে দুর্বল ইকোসিস্টেমে পরিণত হয়ে যাবে। আসলে হেলদি ফরেস্ট মানে এটা দেখতে কেমন, ছবি তোলার মতো খুব সুন্দর বন কি না, সেটা নয়। পৃথিবীতে অনেক ফরেস্ট আছে যেমন ইউরোপিয়ান ফরেস্টগুলোর কথাই যদি ধরি—দেখলে মনে হবে অসাধারণ একটা বন, কিন্তু বায়োডাইভার্সিটি হিসাব করলে ওর ভেতরে সেটা নেই। আমেরিকার এভারগ্লেডস ম্যানগ্রোভ কিন্তু একসময় খুবই স্বাস্থ্যবান একটা ম্যানগ্রোভ ছিল। শুধু আখচাষ করে ওরা এটাকে নষ্ট করে ফেলেছে। আখচাষ করতে গিয়ে ওখানে যে হিউম্যান প্রেশার, কেমিক্যাল, সার ইত্যাদি প্রয়োগ হয়েছে; তার ফলেই এমন হয়েছে। চিংড়ি চাষ করে যেমন পুরো থাইল্যান্ডের ম্যানগ্রোভ নষ্ট করা হয়েছে। আমাদের ম্যানগ্রোভেরও কিন্তু সেই মৃত্যুটা শুরু হয়ে গেছে।
পৃথিবীর ৮০ ভাগ ম্যানগ্রোভ যে এরই মধ্যে ধ্বংস হয়ে গেছে, বেশিরভাগই তাহলে মানবসৃষ্ট কারণে?
হ্যাঁ, বেশিরভাগই মানবসৃষ্ট কারণে।
গ্লোবাল ওয়ার্মিং কি এর একটা কারণ নয় তাহলে?
না। যেগুলো ধ্বংস হয়েছে, সবই গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের আগে। কারণ ১৯৮০ সালের পূর্বে গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের রেট কিন্তু বেশ কম। তা ছাড়া গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের সরাসরি প্রভাবটা অতটা তাৎক্ষণিক না। এটা খুবই স্লো একটা প্রসেস। দুই-তিন মিলিমিটার কতটুকু! আর সুন্দরবনে যে প্রতি গোনে জোয়ার-ভাটা হচ্ছে, সেখানে পানির উচ্চতা কত? সেটা তো অলরেডি ১২ থেকে ১৫ ফুট। এই ১২-১৫ ফুটের জায়গায় সমুদ্রপৃষ্ঠের দুই-তিন মিলিমিটার বৃদ্ধি কতটুকু? এই প্রভাবটা আপনি এত সহজে বুঝবেন? এটা একদমই বোঝা যাবে না। গেলেও সেটা হয়তো একশ বছর পর আমরা দেখব যে, একটা বড় আকারের পরিবর্তন হয়েছে। হয়তো দেখব তখন জোয়ারের উচ্চতা ১৫ ফুটের থেকে ১৬ ফুট হয়ে গেছে। কিন্তু এটা হতে একশ বছর তো লাগবে। তা ছাড়া সেই কমপ্লেক্স মেকানিজমের ক্ষেত্রে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির বিপরীতে সুন্দরবন একটা ভালো অবস্থানে আছে। ম্যানগ্রোভে যে পলি পড়ে, সেটার হার অন্য জায়গায় পলি পড়ার চেয়ে বেশি। কারণ এখানকার গাছের শ্বাসমূলগুলো পানির গতিকে কমিয়ে দিয়ে পলি পড়ার মাত্রাটাকে বাড়িয়ে দেয়।
অর্থাৎ এই পলি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার বিপরীতে ভালোভাবেই কাজ কর—
হ্যাঁ। সে ক্ষেত্রে এই পলি উপকারী ভূমিকা পালন করে। মূলত আমাদের সুন্দরবনের এখনকার যে আশু বিপদ, সেটা প্রধানত মানবসৃষ্ট আর সামান্য কারণ প্রাকৃতিক, যদি আমরা গ্লোবাল ওয়ার্মিংকে প্রাকৃতিকও ধরে নিই, যদিও তার আংশিক দায় আবার মানুষের। প্রাকৃতিক কারণগুলো হলো—বড় ধরনের যখন সাইক্লোন হয়, যেমন আমাদের এখানে সিডর হয়ে গেল। এই দুর্যোগগুলো একটা ম্যানগ্রোভের ওপর বড় ধরনের স্ট্রেস বা চাপ তৈরি করে। আমি নিজেই সুন্দরবনে গিয়েছি সিডরের পরপর। দেখেছি ১ কিলোমিটার গাছই নেই, সব ভেঙে পড়ে গেছে। তারপর দেখেবেন সব পাতা ঝরে গেছে। এরপর মাইলের পর মাইল সব গাছের পাতা মরে গেছে। তারপর আবার ৫-৬ কিলোমিটার দেখবেন সব গাছের পাতা বাতাসে টুইস্ট হয়ে গেছে। এখন ওই ফরেস্টের যে ইকোসিস্টেম—এ পাতাগুলোকে কেন্দ্র করে ফটোসিনেথেসিস থেকে শুরু করে পচে সারে পরিণত হওয়া পর্যন্ত যেই কেমিক্যাল প্রসেস, সেগুলো তখন আর হচ্ছে না। তারপর এই গাছ ও পাতাকে কেন্দ্র করে যে লক্ষ-কোটি পোকামাকড় বাস করত, তারা তো ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তখন।
একেকটা ঘূর্ণিঝড়ের পর তো তাহলে সুন্দরবনের আবার সোজা হয়ে দাঁড়াতে বহু সময় লেগে যায়?
হ্যাঁ। এটা যেমন ফিজিক্যাল সিস্টেমের ক্ষতি করে, তেমনি খাদ্যশৃঙ্খলার মূলে আঘাত হানে এই দুর্যোগগুলো। একটা বনের ইকোসিস্টেমের স্বাস্থ্যরেখার যে নিয়মিত সামান্য তারতম্য—এ ধরনের বড় সাইক্লোনের পর সেটা হঠাৎ করেই পড়ে যায়। সেটা পুনরুদ্ধার করতে আবার দীর্ঘ একটা সময় লেগে যায়। এখন এই রিকভারের আগেই যদি আবারও বড় একটা ঝড় আসে, তখন কিন্তু আরও বেশি ক্ষতি হয়ে যায়। তখন আরও দীর্ঘ সময় লেগে যায় সেটা ঠিক হতে। কিন্তু সমস্যাটা আরও ব্যাপক অন্য জায়গায়। এই যে বনের ইকোসিস্টেমটার অবস্থাটা পড়ে গেল—এর সঙ্গে সঙ্গে যদি মানবসৃষ্ট সমস্যাগুলোও আঘাত হানতে থাকে, তখন এই দুটো প্রভাব মিলে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে, যেটাকে আর পুনরুদ্ধার করা যাবে না এবং এর সঙ্গে তৃতীয় একটা জিনিস যেটা আমি যোগ করতে চাই, সেটা হলো আমাদের বন রক্ষা ও ব্যবস্থাপনার সরকারি দপ্তরগুলো ও দায়িত্বপ্রাপ্ত যারা আছেন, তাদের অপরিকল্পিত নিয়মনীতি পরিবর্তন। যখনই একটা বন চাপের মধ্যে থাকে, সেই চাপ থেকে বের হতে তার হয়তো দশ বা বিশ বছর লাগবে; কিন্তু পরিকল্পনাহীন নিয়মনীতি পরিবর্তনের জন্য সেটা আরও বেশি পিছিয়ে যেতে পারে বা একেবারে নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে। বড় দুর্যোগগুলোর এ চাপটা যে শুধু বনের ওপরই পড়ে তা তো নয়, বনের আশপাশে যারা বাস করে, তাদের ওপরও সেই চাপটা পড়ে। এখন বনের পাশের কমিউনিটির ওপর যখন আঘাত আসে, তারা কিন্তু তখন তাদের ক্ষতিটা বন থেকেই পুষিয়ে নিতে চেষ্টা করে। তারা আগে যতটা সময় মাছ ধরত, তখন হয়তো আরও দুই ঘণ্টা বেশি মাছ ধরে। দুর্যোগের কারণে এমনিতেও তখন তারা মাছ পাচ্ছেও কম। তখন সে অতিরিক্ত সময় মাছ ধরে সেটা পুষিয়ে নিতে চাইছে। কিন্তু আমাদের বন রক্ষা ও ব্যবস্থাপনার দিক থেকে তখন দেখা গেল যে, ওই সময়ই এমন নিয়ম পরিবর্তন করা হলো, যেটা বনের উপকারের বদলে ক্ষতিই করছে বেশি। গত কয়েক বছরের খুবই বিপজ্জনক একটা নীতি পরিবর্তন হচ্ছে, বনের সংরক্ষিত বা স্যাংচুয়ারি এলাকা বৃদ্ধি। স্যাংচুয়ারি এলাকাটা হচ্ছে যেখানে যে কোনো ধরনের বনদ্রব্য আহরণ বা মাছ, প্রাণী ধরা নিষেধ। এর বাইরের বন এলাকায় আপনি পারমিট নিয়ে মাছ বা অন্য বনজদ্রব্য আহরণ করতে পারেন। আমাদের সুন্দরবনের কিন্তু প্রায় ভূসীমানায় প্রচুর মানুষ বাস করে। এই মানুষদের জীবনযাত্রা অনেকটাই বননির্ভর এবং তাদের বন থেকে বিচ্ছিন্ন করাটা খুব সহজ কাজ নয়। পূর্বে শরণখোলা থেকে শুরু করে একেবারে পশ্চিমে সাতক্ষীরা পর্যন্ত বিশাল এলাকার মানুষ বনের ওপর কোনো না কোনোভাবে নির্ভরশীল। এখানে একটা ঘটনা ঘটে, যেটাকে বলা হয় ট্র্যাজেডি অব দ্য কমনস। এটা আসলে ইকোনমিকসের একটা থিওরি। সেটা হচ্ছে, এই যে সুন্দরবনের ধারের মানুষ যারা বনের ওপর নির্ভরশীল এবং এই যে বন এলাকাটুকুতে বনজদ্রব্য সংগ্রহের অনুমতি আছে—সেখান থেকে এরা প্রতিদিনই তো মাছ ধরে, কাঁকড়া ধরে, মৌসুমে মধু, গোলপাতা আহরণ করে। যে হারে তারা বনজদ্রব্য সংগ্রহ করছে আর যে হারে এই বন বা ইকোসিস্টেমটা সেসব উৎপাদন করছে—এর মধ্যে একটা ইকুইলিব্রিয়াম বা ভারসাম্য থাকে, সেটা প্রাকৃতিক।
সেটা কি এই মানুষরা টের পায় বা অনুমান করতে পারে?
আমার ধারণা তারা অবচেতনভাবে বোঝে। সচেতনভাবে কাউকে জিজ্ঞেস করলে সে হয়তো বলতে পারবে না। কিন্তু সে কেন আট ঘণ্টা না ধরে চার ঘণ্টা মাছ ধরে, বংশপরম্পরায় তাদের মধ্যে এ সংক্রান্ত একটা নৈতিক অভিজ্ঞতা এবং বিশ্বাস ও মূল্যবোধ তৈরি হয়ে আছে। অবচেতনভাবেই তারা এ ভারসাম্যটা রক্ষা করে। যদি রক্ষা না করত, তাহলে তো এতদিনে সব শেষ হয়ে যেত। কারণ যে হারে উৎপাদন হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি হারে যদি তারা সংগ্রহ করত, বনসম্পদ তাহলে এতদিন টিকে থাকত না। তবে এখন সেটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কারণ আমার দেখায় গত বিশ বা পনেরো বছর আগে পর্যন্ত এই ইকুইলিব্রিয়ামটা ছিল। মানুষের মধ্যে অতটা শক্ত ধারণা ছিল না যে, সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। মানুষ এখনকার মতো এত বলত না যে, এখন আর আগের মতো পাচ্ছি না। এখন আমি হঠাৎ করে স্যাংচুয়ারি এরিয়া বা সংরক্ষিত অঞ্চল বাড়িয়ে দিয়ে এ মানুষদের বিভিন্ন জিনিস আহরণের ক্ষেত্রকে ছোট করে দিলাম—তাহলে কী হবে? তারা তো এর জন্য প্রস্তুত ছিল না। তার সংস্কৃতি, তার প্র্যাকটিস, সবকিছুই তো আগের মতো রয়ে গেছে। আমি হঠাৎ করেই একদিন বন বিভাগ থেকে একটা অফিস অর্ডার সই করে দিলাম যে, আজকে থেকে স্যাংচুয়ারি এরিয়া এতটুকু। তাতে করে কমনস এরিয়াটা কমে গেল। মানুষগুলো তো এর জন্য প্রস্তুত নয়। তারা ছয় মাস পরের জন্য প্রস্তুতি নিতে পারে, কিন্তু কালকের জন্য তো সে প্রস্তুত নয়। সে যখন দেখছে যে, গতকাল আমি যতক্ষণ ধরে যে মাছ পেয়েছিলাম, আজকে তো সে পরিমাণ পাচ্ছি না, তখন সে মাছ ধরার সময় বাড়িয়ে দেবে। কারণ মাছ ধরার জায়গা তো হঠাৎ করেই কমে গেছে। তখন আগের একই বিশাল জনগোষ্ঠীর চাপ নতুন অপেক্ষাকৃত ছোট জায়গার ওপর গিয়ে পড়ছে। তখন সেই জায়গাটুকু সেই চাহিদা পূরণ করতে না পারার কারণে অনেক কিছুই সমূলে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আগে হয়তো অত ছোট মাছ বা যে মাছ ধরত না, এখন সেটাও ধরে। আগে অত ছোট ছিদ্রওয়ালা জাল ব্যবহার করত না, এখন তাও করে। এটা আবার এমন সময় করা হলো, যখন প্রাকৃতিক ধকল থেকে সুন্দরবন ও তার ধারে বাস করা মানুষরা সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে ওঠেনি। তখন খুব দ্রুতই অনেক কিছু সমূলে ধ্বংস হয়ে যেতে শুরু করে। আর এটাকেই বলে ট্র্যাজেডি অব দ্য কমনস। এখন এটাই শুরু হয়েছে সুন্দরবনে। অনেক জায়গায় আমার শুনি যে আর কিছু পাওয়া যায় না। একই ঘটনা ঘটেছে আমাদের হাওর অঞ্চলেও। এখন হাওরে আর মাছটাছ বলতে কিচ্ছু নেই। সেখানে কারণ অন্য। সেটা অন্য আরেক দিন বলা যাবে।
একেবারে বীজ নষ্ট করে ফেলা যাকে বলে—
হ্যাঁ, সবকিছু, একেবারে পাম্প লাগিয়ে পানি সেচ দিয়ে সবকিছু উঠিয়ে নিয়ে চলে গেছে মানুষ।
এই গেল একটা সমস্যা। দ্বিতীয় সমস্যাটা হলো, কভিডের পর থেকে একটা নতুন নিয়ম করেছে সরকার। সেটা হচ্ছে—তিন মাস সুন্দরবন পুরোটাই বন্ধ। জুলাই-আগস্ট-সেপ্টেম্বর। সেই তিন মাস সংরক্ষিত এলাকার বাইরের জায়গাতেও মাছ-কাঁকড়া ধরা যাবে না। তাহলে এই তিন মাস তারা কীভাবে জীবন ধারণ করবে? আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, এ তিন মাস বন্ধের সময় দেখা যাচ্ছে যে, ঘুষ খেয়ে, পয়সা নিয়ে ওই সংরক্ষিত এলাকাতেও কিছু মানুষকে ফিশিং করতে দেওয়া হচ্ছে। সাধারণত কী হয়? আপনি মাছ মারতে গেলে, আপনার বাড়ির কাছের অন্য জেলেও যায়, প্রত্যেকেই প্রত্যেকের পরিচিত। কেউ একজন বিষ দিয়ে মাছ মারতে গেলে অন্য জন্য তো স্বাভাবিকভাবেই বলে যে, তুমি এটা কী করছ? কিন্তু প্রবেশ বন্ধের সময় যখন কেউ টাকার বিনিময়ে বনের ভেতর প্রবেশ করে খালের মুখ আটকে বিষ দিয়ে মাছ ধরে, কেউ তাকে নিষেধ করার নেই। তখন যে হয়তো সাধারণভাবে দশ হাজার টাকার মাছ ধরত, এখন এই কৌশলে সে দুই লাখ টাকার মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এই সুযোগটা সে পাচ্ছে কারণ দেখার কেউ নেই। সামাজিক বাধাটাও নেই। আর দ্বিতীয় হচ্ছে, সে ঘুষ দিয়ে ঢুকছে। আর তৃতীয় হচ্ছে, সে যখন দেখছে যে, এখানে গেলে আমি দুই লাখ টাকার মাছ ধরে নিয়ে আসতে পারব, তার তো তখন সেখানে বিশ-ত্রিশ হাজার টাকা দিয়ে দিতে সমস্যা নেই এবং এটা কিন্তু বনের ওপর নির্ভরশীল দরিদ্ররা করছে না। যেহেতু লাভের অঙ্ক অনেক বড়, তাই এটা ব্যবসায়ী ও ক্ষমতাশালী শ্রেণি করছে। উদ্দেশ্য যাই হোক, বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে এদের জন্যই স্যাংচুয়ারি এলাকা বাড়ানো হয়েছে এবং এদের জন্যই সুন্দরবন তিন মাস বন্ধ করা হয়েছে। এ বিষয়টাই এখন সুন্দরবনকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
সেখানকার সামাজিক সংস্কৃতি-বিশ্বাসও কি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে?
নষ্ট হয়ে গেছে শুধু না, এই যে বিষ দিয়ে যে খালে মাছ মারা হলো, এর ফলে তো ওই খালে শুধু মাছ না, অন্যসব প্রাণীও শেষ এবং শুধু এ মৌসুমের জন্য নয়, সেটা দীর্ঘদিনের জন্য শেষ। এর ফলে পুরো সুন্দরবনটা প্রাণিশূন্য হয়ে যাচ্ছে।
সুন্দরবনে এটা কি এখন স্পষ্ট দৃশ্যমান ব্যাপার?
হ্যাঁ, একদম দৃশ্যমান। আপনি গিয়ে দেখবেন সবাই এ কথাই বলবে। এটা এখন সেখানে ওপেন ট্রুথ। আপনি গিয়ে পাঁচজনের সঙ্গে কথা বললে, চারজনই বলবে এবং এই পুরো জিনিসটা হয়তো শুরু করা হয়েছে ভালো উদ্দেশ্যে, কিন্তু এ ধরনের ঘটনার কী প্রভাব পড়বে, কে লাভবান হবে সেটা না বুঝেই। এখন যখন ক্ষতি হচ্ছে, যারা করতে বলেছিল তারা আর এটাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সাহস করছে না। আর এদের সবাই হচ্ছে স্থানীয় ক্ষমতাশীল গোষ্ঠী। তাদের লোকজনইবা তাদের ছত্রছায়াতেই এ পয়জন ফিশিংটা হয়। তারা লাভবান হচ্ছে, সুতরাং এখন আর এ দুটো নিয়ম পরিবর্তনের ব্যাপারে তাদের কারও আগ্রহ নেই। এ কথাগুলোই আমি সংসদীয় কমিটির মিটিংয়ে বলেছি এবং এর সঙ্গে এটাও বলেছি যে, এই যে পরিবর্তনগুলো হচ্ছে, এগুলোর কিন্তু কোনো পরিমাপ নেই। আপনার যদি একটা পরিমাপ থাকত যে, সুন্দরবনের মাছের রিজার্ভ কী, কাঁকড়ার রিজার্ভ কী বা অন্যান্য নির্দেশক প্রজাতিগুলোর পরিমাপ যদি থাকত, তাহলে না হয় আপনি বলতে পারতেন যে পরিবর্তনটা হচ্ছে। কিন্তু সুন্দরবন নিয়ে আমাদের এ ধরনের কোনো পরিমাপ নেই, কোনো স্টাডি নেই। রাষ্ট্রীয়ভাবে নেই কোনো ইনস্টিটিউশন। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়কে আমরা মনে করি যে, সুন্দরবনের ওপর তাদের একটা বিশেষ দায়িত্ব আছে—সেখানেই নেই। পরিমাপ করাই হয় না, যাতে লুটপাটের ফল ভোগ করা যায়।
অথচ সুন্দরবন সবার বহু দরদ লক্ষ করা যায়—
দরদটা সত্যি থাকলে তো মানুষ এগিয়ে আসত। আমি তো বহুদিন ধরেই এ বিষয়ে লিখছি, বলছি। কই কাউকে তো তেমন কোনো আগ্রহ দেখাতে দেখিনি। কেউ আসেনি জিজ্ঞেস করতে।
তার মানে কি সুন্দরবন নিয়ে এই যে মায়াকান্না, দরদ—সব ছদ্মবেশী?
সব ছদ্মবেশী। এটা আমি ওপেনলি বলছি। এই যে আপনি দরদটা দেখেছেন, এটা ভুয়া দরদ। সুন্দরবন আজকে যদি সম্পূর্ণ মরে যায়, কিচ্ছু যায়-আসবে না কারও। উল্টো আমার এসব কথাকেই কটাক্ষ করা হবে। কারণ বিষয়টা হচ্ছে, এসব কথা বিশ্বাস করলে হয়তো যে লোকটা সুন্দরবনে অতি উৎসাহ নিয়ে বেড়াতে যেত, সেটা এখন আর যাবে না। গেলেও আগে সে যেমন এটাকে বিশাল কিছু মনে করত, সেটা ভেঙে যাবে। আসলে এটা দরদ নয়, কোনো কিছুকে বিশাল একটা তকমা দিয়ে নিজেকে তার সঙ্গে যুক্ত করে আনন্দ পাওয়া। এই মিথ ভেঙে গেলে ট্যুর কোম্পানির ক্ষতি হবে, মিডিয়ার ক্ষতি হবে, ন্যাশনাল ইগো ক্ষতিগ্রস্ত হবে, বিজ্ঞানী, গবেষকদের ক্ষতি হবে, সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্তদের ক্ষতি হবে, সংরক্ষণ প্রকল্প করছে যারা, তাদের ক্ষতি হবে, ডোনার এজেন্সিগুলো বিশাল কিছুর জন্য দান করছে, এটা দেখাতে পারবে না। সত্য প্রকাশ হয়ে গেলে আসলে সবারই ক্ষতি, শুধু বনের উদ্ভিদ-প্রাণিকুল ও বনের ধারে বাস করা বননির্ভর মানুষরা ছাড়া। তাই সবাই সেই ছদ্মবেশী দরদটাকেই পুষে রাখতে চায় নিজের সুবিধার জন্য। সত্য প্রকাশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আগ্রহ দেখানোর কথা, তাদেরই দেখেছি সবচেয়ে বেশি উল্টো কথা বলতে। কারণ তাদের হয়তো মনে হচ্ছে যে, আজকে যদি আমরা সুন্দরবনের খারাপ অবস্থার কথা বলি, তাহলে সরকারি যে লোকজন এটাকে পরিচালনা করছে, তাদের নীচু করা হবে। তাদের নিচে নামালে তারা তো আমাকে বিভিন্ন প্রজেক্টের জন্য ডাকবে না। সবার নিজের স্বার্থটাই প্রধান, বনকে নিয়ে এখানে আসলে কোনো ভালোবাসা নেই। এটা আমি প্র্যাকটিকালি দেখেছি, দেখছি। আমরা সবাই এ আত্মকেন্দ্রিক ভ্রান্তির ফাঁদে পড়ে গেছি। এই চক্র থেকে বের না হয়ে আসতে পারলে, আমরা সুন্দরবনকে রক্ষা করতে পারব না।