বছরের শুরু থেকেই অর্থনীতির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সূচক ছিল ক্ষয়িষ্ণু। নির্বাচনী বছর ঘিরে সহিংসতা, নাশকতা এবং হরতাল-অবরোধ সেটিকে বানিয়েছে আরও পক্ষাঘাতগ্রস্ত। যুদ্ধ পরিস্থিতি, জাহাজের ভাড়া বৃদ্ধি, ডলার সংকট ও দ্রব্যমূল্যের অস্থিতিশীলতার কারণে বছর শেষে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা দাঁড়িয়েছে বিরাট প্রশ্নের মুখে।
নীতি নির্ধারণে ভুল, সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা এবং সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন না হওয়ায় বছর শেষে সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় চাপ আরও বেড়েছে। চরম আকার নিয়েছে দারিদ্র্য পরিস্থিতি।
এই বাস্তবতায় সরকার দেশের অর্থনৈতিক অনেক উচ্চাভিলাসী পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছে। যার ধারাবাহিকতায় চলতি অর্থবছর বাজেটে লক্ষ্যমাত্রার সাড়ে ৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশ অর্জন না হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। বাস্তবতা বুঝতে পেরে সরকার জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতির হার দুটিই পুনর্নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
অন্যদিকে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় না হওয়ায় প্রথমবারের মতো রেকর্ড সংশোধনী এনে ৫২ হাজার কোটি টাকা কাঁটছাঁটের মাধ্যমে ছোট করা হচ্ছে বাজেটের আকার। ডলারের ঘাটতি মেটাতে বছরজুড়েই আইএমএফর ঋণের বিভিন্ন শর্ত পূরণে সরকারকে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। ব্যয় সামলাতে বিদেশি ঋণে ঝোঁক থাকলেও টাকা ছাপিয়ে অভ্যন্তরীণ ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে এ বছর।
গ্যাস-বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ঘাটতি এবং কয়েক দফায় দাম বৃদ্ধির কারণে কৃষি, শিল্প ও সেবার দামও বেড়েছে। বিঘ্নিত হয়েছে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন। সংকুচিত হয়েছে কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগের ক্ষেত্র।
প্রণোদনা আড়াই শতাংশ বাড়িয়ে ৫ শতাংশে উন্নীত করার পরও প্রবাসী আয়ে ঊর্ধ্বগতির ধারা ধরে রাখা যায়নি। বছর শেষে সুখবর দিতে পারেনি শেয়ারবাজারও।
অগতানুগতিক নীতির কারণে বিদায়ী বছরের প্রতি মাসে গড়ে ১০০ কোটি ডলার করে রিজার্ভ কমেছে। দুর্বল নীতির কারণে বিদেশি রেটিং সংস্থাগুলো বাংলাদেশের ঋণমান স্থিতিশীল অবস্থা থেকে কমিয়ে নেতিবাচক করেছে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সভাপতি মো. মাহবুবুল আলম কালবেলাকে বলেন, ‘কভিড, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলার সংকটসহ নানা কারণে অর্থনীতি চাপে আছে। এটি সত্য। গ্যাস-বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সংকটও আছে। মুদ্রাবাজারে তারল্যের স্বল্পতা আছে। মূলধনি যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল আমদানিও কমেছে। এ কারণে গত দু-তিন বছর ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি কমেছে। ব্যবসায়ীরা এখন সুযোগের অপেক্ষায়। পরিস্থিতির উন্নতিই সেই সুযোগ দ্রুত এনে দিতে পারবে।’
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, ‘প্রবৃদ্ধির স্বাভাবিক ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।’ অর্থনীতিতে উৎপাদনশীলতা ও শ্রমিকের আয় বৃদ্ধি ঘটানোর পাশাপাশি প্রচুর বিনিয়োগ করার পরামর্শ দেন তিনি। বিনিয়োগ বাড়াতে আর্থিক খাতের দুর্বলতার সমাধানের তাগিদ দেন এ বিশেষজ্ঞ।
বাজারে লুটপাট
বিভিন্ন নিত্যপণ্যে শুল্কছাড়ের সুবিধা দিলেও তার প্রভাব দেখা যায়নি বিদায়ী বছরে। সব পণ্যই ছিল সিন্ডিকেটের দখলে। কাঁচামরিচের দাম এ বছর উঠেছিল হাজার টাকায়। ডেঙ্গু মৌসুমে একটি ডাব বিক্রি হতে দেখা গেছে ২০০ টাকায়। ৮০ টাকার স্যালাইন বিক্রি হয়েছে ৩০০ টাকায়। ২৫ টাকার আলু চলে গেছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়। ৪৫ টাকা কেজির পেঁয়াজ বছরের বেশিরভাগ সময় বিক্রি হয়েছে ১০০ টাকারও বেশি দামে। ৪০ টাকার ডিমের হালি বিক্রি হতে দেখা গেছে ৫৫ টাকায়। ব্রয়লার মুরগির দাম ঠেকেছিল ৩০০ টাকায়। শেষের দিকে আশা দেখায় গরুর মাংস। যার দাম এখন ৬০০ থেকে ৬৫০-এর ঘরে। গুটিকয়েক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কয়েক হাজার টাকা করে জরিমানাতেই সীমাবদ্ধ ছিল বাজার নিয়ন্ত্রণ।
লাগামছাড়া অর্থ পাচার
বছরজুড়ে অর্থনীতির টক অব দ্য টাউন ছিল অর্থ পাচার। আমদানি-রপ্তানির আড়ালে পাচারের সঙ্গে নতুন যোগ হয়েছে ডিজিটাল জুয়া ও ক্রিপ্টোকারেন্সি। ব্যাংকে ঋণ অনিয়মের ঘটনাও ঘটেছে। যার কারণে দেশে চলতি বছর ডলার সংকটও বেড়েছে।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার তথ্যে দেখা যায়, প্রতিবছর দেশ থেকে ৭ থেকে ৮ বিলিয়ন ডলার পাচার হচ্ছে। সেইসঙ্গে বিদেশে বাংলাদেশি নাগরিকদের সম্পদ বৃদ্ধির তথ্যও পাওয়া গেছে। বিদায়ী ২০২৩ সালে পাচার করা অর্থ উদ্ধারে দায়িত্বশীল ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আশ্বাস শোনা গেলেও এখনো কোনো টাকা ফিরিয়ে আনা যায়নি। অর্থপাচারকারীদের ধরতে সিঙ্গাপুর সরকার বড়সড় অভিযানে নামে। তাতে বিশ্বের অনেক দেশের পাচারকারী শনাক্ত হয়। বাংলাদেশি পাচারকারীদের কোনো তথ্য জানতে চায়নি দেশের দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলো।
পোশাকে বড় চাপ
বৈশ্বিক অস্থিরতার প্রভাবে কমেছে সবার কেনাকাটা। যার প্রভাব পড়েছে আমাদের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকে।
উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে পোশাক রপ্তানি কমেছে চলতি বছর। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নতুন শ্রমনীতির কারণে খাতটি আন্তর্জাতিক মহলের চাপ রয়েছে।
এ বছর শ্রমিক আন্দোলন ও সংঘাতের মধ্যে দিয়ে ৫৬ শতাংশ পর্যন্ত মজুরি বৃদ্ধি করে ৬২টি শ্রেণির শ্রমিককে চারটি গ্রেডে চূড়ান্ত হয়েছে নতুন মজুরি কাঠামো। শিক্ষানবিশ শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ধরা হয়েছে সাড়ে ১২ হাজার টাকা।
ন্যূনতম মজুরি ইস্যুতে অক্টোবর ও নভেম্বরে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়। সংঘাতে কয়েকজন শ্রমিকের প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। মজুরি বোর্ডে শ্রমিক পক্ষ ২০ হাজার ৩৯৩ টাকার প্রস্তাব দিলেও, তা আমলে না নিয়ে মালিকদের ইচ্ছায় মজুরি নির্ধারণ হয়েছে বলে দাবি করেন শ্রমিক নেতারা। সবশেষ গত ২০ ডিসেম্বর ন্যূনতম মজুরির চূড়ান্ত প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করে সরকার।