টেলিভিশন নাটকে মিহি আহসানকে দেখা যায় নানা রূপে—কখনো প্রেমে মগ্ন স্ত্রী, কখনো বঞ্চিত নারী, কখনো বা প্রতারিত ভালোবাসার শিকার। কিন্তু পর্দার বাইরে এই অভিনেত্রী বাস্তব জীবনে ঠিক কতটা ভিন্ন বা কতটা কাছাকাছি তার স্ক্রিন চরিত্রের সঙ্গে? ‘তারাবেলা’ অনুষ্ঠানে বসে মিহি নিজের জীবনের অজানা গল্পগুলো খুলে বলেন, খোলামেলা, কিছুটা ব্যথা আর কিছুটা হাসির সঙ্গে মিশিয়ে। লিখেছেন রাজু আহমেদ
আপনাকে দেখে মনে হয় খুব আত্মবিশ্বাসী, দৃঢ়চেতা একজন নারী। সত্যিই কি তেমন?
“মানুষ দেখে মনে করে আমি খুব শক্ত, কিন্তু বাস্তবে আমি ভীষণ নরম। নিজেকে শক্তিশালী মনে করলেও ভেতরে আমি খুব দুর্বল। একটু কষ্ট পেলেই কেঁদে ফেলি। আমি চাই না কেউ আমার দুর্বল দিকটা দেখুক, তাই সবসময় হাসি দিয়ে সেটা ঢেকে রাখি। এই হাসিটা অনেক সময় ভেতরের ব্যথা লুকানোর একটি মাধ্যম। হয়তো এ কারণে মানুষ আমাকে ‘সাইলেন্ট স্ট্রং’ বলে—নীরবে শক্তিশালী। তবে সত্যি বলতে, আমি খুব সংবেদনশীল। আমার মনের ভেতরে অনেক ভাঙন, অনেক দুঃখ, কিন্তু আমি তা প্রকাশ করি না। নিজের ভেতরের শান্তি রাখাটাই আমার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।”
আপনার বিয়ে নিয়ে অনেক গুঞ্জন আছে। আসলে কী হয়েছিল?
‘আমি বিয়ের পরে জানতে পারি, আমার প্রাক্তন স্বামী এরই মধ্যে আরেকজনকে বিয়ে করেছে। তখন মনে হয়েছিল পৃথিবী থেমে গেছে। আমি কাউকে কিছু না বলে চুপচাপ সরে যাই। কোনো নাটক করি না, কোনো সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট করি না। শুধু চেয়েছি নিজেকে সামলে নিতে। মানুষ বুঝতে পারে না, সে সময় কতটা ভেতরে কষ্টে ভেঙে পড়েছিলাম। কিন্তু আমি জানতাম, নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ আমার হাতেই থাকতে হবে।’
সত্যি কি? আপনার কাবিন কত ছিল?
‘হ্যাঁ, সত্যি। আমার বিয়ের কাবিন ছিল ১৮ টাকা। তখন আমি ছোট, বুঝিনি কিছু। এখন মনে হয়—এটাও ছিল এক ধরনের অসম্মান। ভালোবাসা থাকলে কাবিনের মূল্য টাকা দিয়ে মাপা যায় না, তা বিশ্বাস দিয়ে হয়।’
যদি কখনো কাউকে কোনো উপহার দিতে বলা হয়, আপনি কার জন্য কী দিতে চাইবেন?
‘আমি আমার প্রাক্তন স্বামীকে হ্যান্ডকাফ দিতে চাই। ওর জন্য একেবারেই পারফেক্ট গিফট। কারণ ও সবকিছু বাঁধতে চেয়েছিল—আমার স্বাধীনতা, আমার হাসি, আমার জীবন। সে যে পথ বেছে নিয়েছিল, আমি সেই বাধা ভাঙতে শিখেছি।’
শুটিংয়ে নায়করা কেমন আচরণ করেন?
‘নায়করা সবসময় দেরি করে আসে। আমি সবসময় সময়মতো পৌঁছে যাই, কিন্তু তারা আসে ঘণ্টাখানেক পর। অনেকেই মনে করে নায়িকারা দেরি করে, কিন্তু বাস্তবে উল্টো। আমি কাজের সময় নিয়ে খুব সিরিয়াস। আমার কাছে পেশাদারিত্ব মানে সময়ের মূল্য বোঝা।’
আপনি বলেছিলেন, এক প্রযোজক আপনাকে একটি প্রস্তাব দিয়েছিল!
‘হ্যাঁ, ও বলেছিল, যদি ওর মতো করে চলি, ও প্রতি মাসে আমার পাঁচটা নাটক বানাবে। আমি সরাসরি না বলে দিই। আমি কাজ হারিয়েছি, কিন্তু আত্মসম্মান হারাইনি। কেউ আমাকে দিয়ে নিজের ইচ্ছামতো কিছু করাতে পারবে না। এ সিদ্ধান্তটা আমার জন্য বড় শিক্ষা—নিজের মূল্য জানা আর অন্য কারও ইচ্ছার জন্য নিজেকে হারানো নয়।’
আপনার শরীরে ট্যাটু আছে?
‘একসময় ইমোশন থেকে করেছিলাম। তখন মনে হয়েছিল, সুন্দর লাগবে। এখন দেখি, এগুলো শুধু কষ্টের চিহ্ন। তাই মুছে ফেলতে চাই। এটা একটা সময়ের ভুল সিদ্ধান্ত, এখন আর সেটার স্মৃতি রাখতে চাই না। জীবনও কিছুটা এরকম—ভুল সিদ্ধান্ত হয়, কিন্তু তা শুধুই শেখার জন্য।’
বিয়ের পরের সময়টা কেমন কেটেছিল?
‘খুব কঠিন। একদিকে কাজের চাপ, অন্যদিকে মানসিক চাপ। পরিবারকেও কিছু বলতে পারিনি। একসময় মনে হতো—সব শেষ। কিন্তু না, সবকিছু হারিয়েও আবার শুরু করেছি। এখন আমি নিজের মতো আছি, নিজের শর্তে বাঁচি। এ সময় আমাকে শেখিয়েছে, জীবনের সবচেয়ে বড় শক্তি নিজের ভেতরে লুকিয়ে থাকে।’
এক কথায় নিজেকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করবেন?
“আমি খুব লক্ষ্মী মেয়ে, কিন্তু সহজ নই। আমি হাসিখুশি, কিন্তু কারও মুখের ওপর অন্যায় মেনে নিই না। মানুষ আমাকে ‘সাইলেন্ট স্ট্রং’ বলে—আমি সেটাকেই সত্যি মনে করি। নিজের প্রতি বিশ্বাস হারালে মানুষ অনেক কিছু হারায়, আর আমি সেটা চাই না। নিজের ভেতরের শক্তিটাই আমার পথ দেখায়।”
আবার বিয়ের ইচ্ছে আছে?
‘এখন না। ভালোবাসা শব্দটাই এখন ভয় লাগে। আমি এখন নিজের প্রতি ভালোবাসা ফেরত পেতে চাই। মানুষ বদলে যায়, কিন্তু নিজের ভেতরের বিশ্বাস যেন না বদলায়, সেটাই চাই। কোনো সম্পর্ক যদি আসে, তবে হবে নিজের শর্তে, নিজের মূল্যবোধে।’
মিহি আহসানের কথায় যেন জীবনরস মেশানো বাস্তবতা। কখনো রোমান্টিক, কখনো কষ্টে জড়ানো, আবার কখনো বিদ্রোহী। তার হাসি দিয়ে ঢাকা পড়ে থাকে ভেতরের ব্যথা। বিদ্রুপ, অপবাদ, প্রতারণা—সবকিছুর পরও তিনি দাঁড়িয়ে আছেন নিজের শর্তে। এক বাক্যে তার জীবনসংগ্রামের সারমর্ম প্রকাশ পায়: ‘আমি খুব শক্ত, কিন্তু ভেতরে নরম।’
মন্তব্য করুন