রাত পেরিয়ে ভোরের ঝাপসা আলোয় পাহাড়ের উঁচু নিচু, আঁকাবাঁকা পথে ছুটে চলা এক বাসের যাত্রী আমরা। রাস্তার পাশেই শত ফুট গভীর পাহাড়ি খাদ আর কিছু দূরেই দেখা যায় পাহাড় ও মেঘের অসাধারণ মিথস্ক্রিয়া। এইভাবেই পৌঁছে যাই পাহাড়, নদী ও মেঘের জেলা বান্দরবানে। আজ থাকছে বান্দরবানের লামা উপজেলার গহিনে পাহাড়, ঝিরিপথ, মাতামুহুরী নদী ও দ্বিতীয় সাজেক নামে পরিচিত মিরিঞ্জা ভ্যালি ভ্রমণের গল্প।
প্রথম দিন : পাহাড়ি রিসোর্ট, গ্রাম, ঝিরি ও নিশুতি রাত
ঢাকা থেকে হানিফ বাসে করে সরাসরি লামা বাস টার্মিনালের উদ্দেশ্যে রওনা করি আমরা, প্রায় ১১ ঘণ্টা পর সকাল ১০টায় পৌঁছাই লামা বাস টার্মিনালে। সেখান থেকেই শুরু হয় আমাদের যাত্রা। গন্তব্য, লামা বাস টার্মিনাল থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার ভিতরে পাহাড়ের চূড়ায় একটা রিসোর্ট। প্রকৃতি যেন নিজ হাতে সাজিয়েছেন বান্দরবানকে, মৃদু বাতাস ও পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে পৌঁছে যাই আমাদের প্রথম গন্তব্যে। পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখে নিমিষেই দূর হয়ে যায় সব ক্লান্তি।
সকালের খাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়ি আশপাশের পাহাড় ও পাহাড়ি গ্রামের উদ্দেশ্যে। বেশ কিছু পথ হেঁটে পাহাড়ি গ্রাম ও তাদের জীবনযাপন উপভোগ করে চলে যাই এখানকার সবচেয়ে উঁচু একটা পাহাড়ে। সেখানে উঠার পর আমরা বৃষ্টির দেখা পাই, পাহাড়ের চূড়া থেকে এ দৃশ্য দেখার অনুভূতি অসামান্য। বৃষ্টির পর পাহাড় থেকে নামার রাস্তাটা দুর্গম না হলেও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এ সময়টাতে পাহাড়ি পথ অনেক পিচ্ছিল থাকে; তবে আমরা বেশ ভালোভাবেই নেমে আসি সেখান থেকে।
এরপর গন্তব্য শুরু হয় ঝিরি পথে, পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে বয়ে চলা ঝিরিপথ দিয়ে চলতে থাকি আমরা, দুইপাশে উচু পাহাড় ও অসংখ্য নাম না জানা গাছে ছেয়ে আছে পাহাড়ের উপরের অংশ। নিচে ছোট বড় পাথরের উপর দিয়ে বয়ে চলেছে ঝিরির পানি, কিছুক্ষণ হেঁটে যাওয়ার পর আমরা বিচ্ছিন্ন হই নেটওয়ার্ক থেকে। নেই নোটিফিকেশনের শব্দ, গাড়ির যানবাহনের হর্ন। চারিদিকে শুধু নিস্তব্ধ পরিবেশ, ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ ও পানির বয়ে চলা স্রোতের শব্দ। এই অনুভূতি প্রকাশ করার মতো নয়, কেবল অনুভব করা যায় ।
গিরিপথের কোথাও হাঁটু সমান পানি, কোথায় কোমর, আবার কোথাও বুক বরাবর। পাথরগুলো বেশ পিচ্ছিল। মাঝে ছোট ছোট নুড়ি পাথর আর সাথে বড় বড় পচতে শুরু করা গাছের গুঁড়ির দেখা পাওয়া যায়, যা প্রবল বর্ষায় এখানে ভেসে এসেছে। এই গুঁড়িগুলোর আকার দেখলেই বোঝা যায়- প্রবল বর্ষণে গিরিখাতের অবস্থা কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। এরকম বড়-ছোট গাছের গুঁড়ি পার হয়ে গিরিখাত ধরে এগিয়ে চললাম আমরা। শুরুতে বেশ চওড়া থাকলেও আস্তে আস্তে সরু হতে থাকে দুপাশের পাহাড়। পাহাড়ে ঢেকে থাকা অন্ধকার সরু পথ দিয়ে মাঝে মাঝে আলোর ঝলকানি আসে আবার কিছু জায়গায় অন্ধকার নেমে আসে। এভাবেই প্রায় ৩ ঘণ্টা নেটওয়ার্কবিহীন ট্র্যাকিং সম্পূর্ণ করে সন্ধ্যাবেলা ফিরে আসি রিসোর্টে ।
রাতে খোলা আকাশের নিচে বসে গান, আড্ডা ও বার্বিকিউ- সব মিলিয়ে জমে ওঠে আমাদের ভ্রমণ আসর। গভীর রাতে পাহাড়ের চূড়ায় রাতের চাঁদটাও যেন আমাদের সঙ্গে আসর জমিয়েছিল, এভাবেই কেটে যায় প্রথম দিন ।
দ্বিতীয় দিন : লামা বাজার ও মাতামুহুরী নদীর গল্প
দ্বিতীয় দিন বেরিয়ে যাই লামা বাজার, মাতামুহুরী নদী ও সাদা পাহাড়ের উদ্দেশ্যে, বাজার ঘুরে খাই কিছু পাহাড়ি ফল আর স্থানীয় খাবার। তারপর পাশের ঘাট থেকে নৌকা করে নদীপথে যাত্রা শুরু করি। দুইপাশে খাড়া পাহাড়, মাঝখানে আঁকাবাঁকা নদী। নৌকায় বসেই উপভোগ করি প্রকৃতির জাদুকরি সৌন্দর্য। দুইপাশে খাড়া উঁচু পাহাড় আর মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে আঁকাবাঁকা নদী। নৌকায় বসে পাহাড় ও নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে সাদা পাথরের পথে এগোতে থাকি। তবে হঠাৎ করেই এক দুঃখজনক ঘটনা আমাদের ভ্রমণ থমকে দেয়— এক পর্যটক সাদা পাথরের পাশে নদীতে নামার পর নিখোঁজ হয়ে যান। উদ্ধার তৎপরতা শুরু হলে পর্যটকদের যাত্রা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। মাঝপথ থেকেই ফিরে যাই ‘রিভার হিল রিসোর্টে’ এবং সেখান থেকেই উপভোগ করি নদী ও পাহাড়ের নৈসর্গিক সৌন্দর্য।
তৃতীয় দিন : মেঘের দেশ মিরিঞ্জা ভ্যালি
আমাদের তৃতীয় দিনের গন্তব্য ছিল মিরিঞ্জা ভ্যালি। লামা উপজেলার অন্যতম প্রধান পর্যটনকেন্দ্র ও নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরপুর মিরিঞ্জা ভ্যালি দ্বিতীয় সাজেক নামেও ইতোমধ্যে পরিচিতি লাভ করেছে । নৌকায় আবার ফিরে যাই লামা বাজারে। সেখান থেকে স্থানীয় সাংবাদিক ফোরামে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে দুপুরের খাবার শেষে সিএনজিতে রওনা হই মিরিঞ্জা ভ্যালির দিকে। আমাদের উদ্দেশ্যে ছিল সর্বোচ্চ উপরে যাওয়ার, যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৮০০ ফুট উচ্চতায়। সেখানকার প্রধান আকর্ষণ সবুজ পাহাড়ের ভাজে ভাজে শুভ্র মেঘের লুকোচুরি। সেখানে গেলে মনে হবে আকাশ ও মেঘ আপনার হাতের মুঠোয়। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার জন্যও এই চূড়া উপযুক্ত একটি স্থান।
অন্য মৌসুমে গাড়ি নিয়ে উঠা গেলেও বৃষ্টির কারণে পুরো পথটুকু আমাদের ট্র্যাকিং করে উঠতে হয়। সন্ধ্যা বেলায় ঝাপসা আলোয় খাড়া পাহাড়ি পথ আর কাদা মাড়িয়ে ঘণ্টাখানেক হেঁটে যখন রিসোর্টে পৌঁছাই, তখন শরীর ক্লান্ত হলেও মন ভরে যায় পাহাড়ি বাতাস আর নিস্তব্ধতায়। পাহাড়ের চূড়ায় কাটানো রাত যেন কল্পনার মতো সুন্দর। রাতে ভিউ পয়েন্টে বসে গিটারের গানের সুর আর পাহাড়ের নীরবতার সুর মিলে যেন এক ছন্দ তৈরি করে, এভাবেই কেটে যায় রাত।
শেষ দিন : মেঘ ছুঁয়ে, ঝরনায় ভিজে
ভোরের আলোয় চোখ মেলতেই দেখি মেঘ এসেছে আমার দুয়ারে। সত্যি, হাত বাড়ালেই যেন মেঘ ছুঁয়ে ফেলা যায়? আমার জীবনের সেরা মুহূর্ত ছিল এটা। ছোটবেলা থেকেই আমি অনেকটা কল্পনাবিলাসী। মায়ের কোলে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে কল্পনায় মেঘের রাজ্যে ঘুরে বেড়াতাম। আজ যেন আমার কল্পনা সত্য হলো। কিছুক্ষণ পর সকালের নাস্তা খেয়ে আমরা হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যাই পাহাড়ি ঝরনার দিকে। ৩০ মিনিটের পথ হাঁটার পর দেখা পাই কাঁচা পানির ঝরনা। পাহাড় বেয়ে নেমে আসা সেই ঠান্ডা জলের ছোঁয়ায় মুহূর্তেই মুছে গেল শরীরের ক্লান্তি, ঘাম আর মনের ভার। মনে হলো, যেন প্রকৃতি নিজেই আমাদের এ যাত্রার পুরস্কার তুলে দিল তার কোমল স্পর্শে। ফেরার পথে পাহাড়ি ফল— ডাব, কলা, পেয়ারা— সবই আমাদের পথের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়।
রিসোর্ট থেকে পিছু হাঁটি মেঘ ছুঁয়ে দেখা সেই পাহাড়ি পথ ধরে। ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর পৌঁছাই মিরিঞ্জা বাজারে, সেখান থেকে ‘চাঁদের গাড়ি’ চেপে নামি চকরিয়া বাসস্ট্যান্ডে। এখানেই শেষ হয় প্রকৃতির গভীরে ডুবে থাকা আমাদের কয়েকটা চিরস্মরণীয় দিনের যাত্রা। পাহাড়ের নীরবতা, নদীর কুলুকুলু স্রোত আর মেঘের হাতছানিকে হৃদয়ের পাতায় গেঁথে আমরা রওনা দিই কক্সবাজারের পথে— আবারও ফিরে আসি পরিচিত নগরীতে, সঙ্গে নিয়ে এক অচেনা প্রকৃতির মুগ্ধতা।
লেখা : জান্নাতুল আলো ফরিদা
মন্তব্য করুন