কেবল রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমেই দেশের চলমান বিদ্যুৎ সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব বলে জানিয়েছেন ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজের বক্তারা।
শনিবার (১৭ জুন) ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজের ‘চলমান বিদ্যুৎ সংকট: কেন তৈরি হলো? উত্তরণ কীভাবে?’ শীর্ষক ওয়েবিনারে তারা এ কথা বলেন।
বক্তারা বলেন, আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ও চাহিদা নিয়ে যে তথ্য দেওয়া হয়, সেগুলো বিভ্রান্তিমূলক। বাস্তবে সরকারি হিসাবের চেয়ে দেশে উৎপাদন কম এবং চাহিদা বেশি।
ওয়েবিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক গবেষক ও লেখক ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব।
লোডশেডিংয়ের প্রধানতম কারণ জ্বালানি হলেও অন্যতম প্রধান কারণ ত্রুটিপূর্ণ বিদ্যুৎকেন্দ্র উল্লেখ করে প্রবন্ধে বলা হয়, ১২ এপ্রিল প্রকাশিত হিসাব অনুযায়ী, জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা ২৩ হাজার ৩৩২ মেগাওয়াট। সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১৫ হাজার ১৫৪ মেগাওয়াট, অর্থাৎ সক্ষমতার তুলনায় ৮ হাজার ১৭৮ মেগাওয়াট কম। তথাপি সেদিন ৭৭৬ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হয়েছে। এ দিন ১৫৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র সক্রিয় ছিল, যার মধ্যে ৪৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের (৩১ দশমিক ৪ শতাংশ) ইঞ্জিন যন্ত্রপাতির সমস্যা ছিল, ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র (২২ দশমিক ২ শতাংশ) জ্বালানি সংকটে ভুগেছে এবং ১২টি বিদ্যুৎকেন্দ্র (৭ দশমিক ৮ শতাংশ) মেরামতের কাজ চলছিল। যন্ত্রপাতির সমস্যা ও জ্বালানির অভাব—এই দুটি কারণেই ৯৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র (৬১ দশমিক ৪ শতাংশ) ঠিকমতো চলেনি। এক চতুর্থাংশেই যন্ত্রপাতির সমস্যা।
দুর্নীতিবান্ধব ক্রয় প্রক্রিয়ায় সংস্কারের কথা উল্লেখ করে প্রবন্ধে বলা হয়, কারিগরি জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাহীন একদল ব্যবস্থাপক ভুল ও অদূরদর্শী পিপিএ বা পিপিআর নামক আইনি প্রক্রিয়ার দোহাই দিয়ে বাংলাদেশের বিদ্যুৎখাতকে অযোগ্য সরবরাহকারীদের পুনর্বাসনকেন্দ্র বানিয়ে ফেলেছে।
প্রবন্ধে আরও বলা হয়, ক্যাপাসিটি চার্জের চুক্তিগুলোয় পলিটিক্যাল ইনিশিয়েটিভে রি-নেগোসিয়েশনের উদ্যোগ নিলে অলস বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল কমে আসতে পারে। 'ডলার ড্রেনিং' ক্যাপাসিটি চার্জ কমিয়ে আনতে না পারলে বিদ্যুৎ খাতের পেমেন্ট সংকট কাটবে না।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব তার প্রবন্ধ উপস্থাপনায় বলেন, বিদ্যুৎখাতে বাংলাদেশের মূল সমস্যা প্রাথমিক জ্বালানির জোগান পরিকল্পনাকে সাস্টেইনেবল করতে ব্যর্থ হওয়া। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফুয়েল প্ল্যানিং না থাকা, অফশর ও অনশোরে গ্যাস কূপ খননে গড়িমসি, সর্বোপরি সবুজ বিদ্যুতে বিনিয়োগ এবং সবুজ বিদ্যুৎ বান্ধব নীতি কৌশলের অভাব।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের হিস্যা কমার কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, বিদেশি উৎস থেকে এলএনজি আমদানির চুক্তি যথাসময়ে না বাড়িয়ে, স্পট মার্কেট থেকে আমদানির ঝোঁক থেকে সমস্যার শুরু হয়েছে। অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—ইউক্রেন যুদ্ধ পরবর্তীতে স্পট মার্কেটে দাম বাড়ায় ডলার সংকটে গ্যাস কিনতে না পারা, কাতার ও ওমানের উৎপাদনকে ইইউ রাষ্ট্রগুলো বুক করে ফেলায়, নতুন করে আমদানি চুক্তির ব্যর্থতা এবং জ্বালানি কূটনীতিতে দুর্বলতা।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট কি ইউক্রেন যুদ্ধের একমাত্র কারণ?, এ বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক জ্বালানি মূল্যে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব শেষ হয়ে গেছে। বর্তমান মূল্য ২০১৮-১৯ সালের বেজ প্রাইসের সমান হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার মূল্য কমে ইউক্রেন যুদ্ধের আগের কাছাকাছিতে নেমে এসেছে। এলএনজি মূল্য ইউক্রেন যুদ্ধের আগে চেয়েও কিছুটা কমে এসেছে। তেল, গ্যাস ও কয়লার ক্ষেত্রে মূল সমস্যা বিশ্ববাজারের মূল্য পরিস্থিতি নয়, বরং মূল সমস্যা মোট আমদানির সম্মিলিত চাপ এবং ডলার রিজার্ভ পরিস্থিতি।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, আমার ডিমান্ড ফোরকাস্ট ঠিক করতে হবে। যেগুলোর উৎপাদন অনেক কম সেগুলো বসিয়ে না রেখে বন্ধ করে দিতে হবে এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে ঝুঁকতে হবে। তাহলেই বর্তমানে জ্বালানিখাতে যে সংকট সেখান থেকে কিছুটা বের হওয়া যাবে।
মন্তব্য করুন