বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় (বাউবি) ১৯৯২ সালে যাত্রা শুরু করে। ইতোমেধ্যে তিন দশকের বেশি সময় সফলতার সাথে অতিক্রম করেছে। শিক্ষার সঙ্গে কর্মসংস্থানের সমন্বয়ের মাধ্যমে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগ্রহণের নির্ভরযোগ্য একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাউবি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম দেশের ভৌগোলিক সীমারেখা ছাড়িয়ে বিদেশেও ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি নানা শ্রেণিপেশার মানুষের জন্য অ্যাকাডেমিক ডিগ্রি অর্জন সহজতর করেছে। কর্মক্ষেত্রে থেকেও খুব সহজে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে ডিগ্রি অর্জন করেছে লাখ লাখ শিক্ষার্থী। এখানে রয়েছে পাঠের অন্তহীন সুযোগ। শিক্ষার্থীরা নিজেদের সুবিধামতো নিকটস্থ টিউটোরিয়াল সেবা, সাশ্রয়ী খরচে পাঠসামগ্রী প্রাপ্তিসহ পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ এবং অনলাইনে সব পাঠ সুবিধা পেয়ে থাকে। দেশজুড়ে ক্যাম্পাস, দূরশিক্ষণ আর উন্মুক্ত শিক্ষায় শিক্ষার সুবিধা নিয়ে নানা পর্যায়ের শিক্ষা প্রোগ্রামে বাউবির রয়েছে বহুমাত্রিকতা। এটি দেশের একমাত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যার পাঠ ব্যবস্থাপনা সব মানুষের জন্য সবসময় অবারিত।
যারা ক্যারিয়ার প্রত্যাশী- যাদের নানাবিধ কারণে পাঠ বিরতি ঘটেছে তাদের জন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন অপার সুযোগ সৃজিত হয়েছে তেমনি নিয়মিত শিক্ষার্থীরা এখানে পাঠে আগ্রহী হলে তাদের জন্যও এখানে রয়েছে চমৎকার সব ব্যবস্থা। এসএসসি হতে পিএইচডি, মানবিক, বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা, আইন, ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা, কম্পিউটার, প্রযুক্তিবিদ্যাসহ সার্টিফিকেট, ডিপ্লোমা, পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা, প্রাজুয়েশন, অনার্স, মাস্টার্স লেভেলে শিক্ষাগ্রহণের জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থার সকল সুবিধা এখানে বিদ্যমান রয়েছে। ৭৭টি আনুষ্ঠানিক প্রোগ্রাম, ১৯টি অনানুষ্ঠানিক প্রোগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়টিতে চালু রয়েছে। লার্নার্স সাপোর্ট, স্টাডি মেটেরিয়েলস, মিডিয়া সাপোর্ট, এডু রিসার্চ, প্যাডাগজি, নলেজ ম্যানেজমেন্টে এখানে অগ্রাধিকার রয়েছে। বর্তমান মূল ক্যাম্পাসে ৬টি স্কুলের মাধ্যমে ১৩৯ জন শিক্ষক অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমে নিবিড়ভাবে যুক্ত আছেন।
দেশের বাইরে মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ কোরিয়া, দুবাই, কুয়েত, সৌদি আরব, ইতালিসহ কয়েক দেশে বাউবির মানবসম্পদ উন্নয়নমুখী শিক্ষা কার্যক্রম চলমান আছে। বিওইউ টিউব, ই-বুক, ওইআর রিপোজিটরি, ইউটিউব, আইসিটি, মিডিয়া বেইজড এডুকেশনের অন্যতম শিক্ষা সহায়ক সুবিধাদি। শিক্ষার্থীরা সময়মতো নিজস্ব সুবিধা নিয়ে এর সঙ্গে সংযুক্ত হয়। বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার একাডেমিক কার্যক্রম উন্নয়নের পাশাপাশি জাতীয় দিবসগুলোতে বেশ কিছু মিডিয়া কন্টেন্ট তৈরি করে শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন একটি মাত্রা যোগ করতে সক্ষম হয়েছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় ও কর্তৃপক্ষের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় বাউবির মিডিয়া বিভাগের মাধ্যমে নির্মিত এ কনটেন্টগুলো বিটিভি, সংসদ বাংলাদেশ টিভি ও বেসরকারি টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও কর্ম, শহিদ বুদ্ধিজীবীদের অবদান, মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত কন্টেন্টগুলো শিক্ষার্থী ও দেশবরেণ্য ব্যক্তিদের অংশগ্রহণে নির্মিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু কর্নারটিতে ১৯৫২ সাল হতে ১৯৭৫ পর্যন্ত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের সংগ্রামী আত্মত্যাগের মহিমান্বিত অধ্যায়ের সচিত্র প্রকাশনা শিক্ষার্থীদের জন্য এক অনন্য প্রদর্শনী। বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রের উদ্যোগে দেশবরেণ্য গুণী মানুষের স্মারক বক্তৃতা ও প্রকাশনা বাউবির জাতির প্রতি এক মণীষাদীপ্ত উপস্থাপন। মূল ক্যাম্পাসে নির্মিত মক ভিলেজ যেন আবহমান বাংলার প্রতিচ্ছবি। পাবলিক পরীক্ষাগুলো প্রশাসনের সহযোগিতায় বিদ্যমান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেখানে একই মানের পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়, সেখানেই শুক্র ও শনিবার দিনগুলোতে নেওয়া হয়। সমমানের সাধারণ শিক্ষার অনুরূপ মানে ও গুণে এ পরীক্ষা নেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনায় অ্যাকাডেমিক শৃঙ্খলায় এর শিক্ষা মানে কোনো ব্যত্যয় নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পরীক্ষা গুণগত উৎকর্ষ বজায় রেখে নেওয়া হয়। পরীক্ষা কক্ষ নকলমুক্ত রাখা, পরীক্ষার ফলাফল নির্ভুলভাবে প্রণয়ন করা, যথাসময়ে ফল প্রকাশ করার বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। বোর্ড ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমমানের পরীক্ষাগুলো নিয়ে অনেকে না জেনে যে মতামত বিভিন্ন জায়গায় ব্যক্ত করেন, তা অনেকাংশেই সঠিক নয়। কেননা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এসব পরীক্ষার সর্বস্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা যথাযথভাবে নিশ্চিত করে থাকে। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ মুদ্রণ কাজ যেখানে হয়ে থাকে বাউবি সেখান থেকেই প্রশ্নসংক্রান্ত গোপনীয় কাজ সম্পন্ন করে থাকে। মাঠপর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রমের উৎকর্ষ সাধনে সর্বমোট সাড়ে ৯ লাখ শিক্ষার্থীর ১২টি আঞ্চলিক কেন্দ্রে ৮০টি উপআঞ্চলিক কেন্দ্র, ১৫৬২টি স্টাডি সেন্টারের ২৪ হাজারের অধিক সংযুক্ত শিক্ষকদের শিক্ষাসেবায় নিয়োজিত কর্মকর্তারা দূরশিক্ষণ ও উন্মুক্ত শিক্ষায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। টিউটর ও সমন্বয়কারীদের নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাব্যবস্থায় শিখন কৌশলে দক্ষতাভিত্তিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইকিউএসি বিভাগ শিক্ষা সুবিধার সব কিছু মূল্যায়ন করে থাকে। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতারের নেতৃত্বে বর্তমান প্রশাসন মাঠপর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থাপনাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এ ছাড়াও তার অক্লান্ত শ্রমে খুব সম্প্রতি বহির্বিশ্বে শিক্ষা সুযোগ বঞ্চিতদের কাছে বাউবি এখন আলোচিত একটি নামে পরিণত হয়েছে। অনলাইন মনিটরিং, আকস্মিক পরিদর্শন, টার্গেট গ্রুপের সাথে নিয়মিত মতবিনিময়, শিক্ষার্থী সেবায় মানবিক উদ্যোগ, ক্যাম্পাস পরিষেবায় ইনোভেশন, শুদ্ধাচার, স্টাডি মেটেরিয়াল বিতরণ, ই-বুক, মিডিয়া, ওয়েব এডুকেশন, ওপেন টিভি, পরীক্ষা পরিদর্শন, বিশেষ পরিদর্শক, সময়মতো নির্ভুল ফল প্রকাশ এসবের অংশ।
কোয়ালিটি এডুকেশন, কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট এই ব্রত বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাউবির দীক্ষা সবার জন্য উন্মুক্তমুখী- গণমুখী জীবনব্যাপী শিক্ষা বিতরণে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় তিন দশক ধরে কাজ করে চলেছে। মিডিয়া বেজড ম্যানেজমেন্ট এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষক প্রযুক্তিবান্ধব কার্যক্রম গ্রহণ করে পেপারলেস ইউনিভার্সিটিতে রূপান্তর করে চলেছেন। এ কারণে সবাইকে দিনে রাতে সর্বদাই প্রযুক্তি সংযোগে শিক্ষাসেবায় নিয়োজিত রয়েছেন। যুগোপযোগী শিক্ষাদর্শনে সবাইকে সম্মীলিত উদ্যোগে এটি এখন তাই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম সেরা আইকনিক উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় উন্নীত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। ৩১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের পক্ষ থেকে রইল প্রাণঢালা অভিনন্দন ও শুভকামনা।
লেখক : বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য ও চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আলমগীর।
মন্তব্য করুন