কয়রা (খুলনা) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০২:০৫ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

আ ব ম আব্দুল মালেক, একজন আদর্শ শিক্ষকের প্রতিচ্ছবি

শিক্ষক : আ ব ম আব্দুল মালেক। ছবি : সংগৃহীত
শিক্ষক : আ ব ম আব্দুল মালেক। ছবি : সংগৃহীত

শিক্ষা যদি হয় জাতির মেরুদণ্ড, তবে শিক্ষককে বলা হবে শিক্ষার মেরুদণ্ড। শিক্ষক হলেন ন্যায়নীতি আর আদর্শের প্রতীক। মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে কাজ করেছেন প্রায় ৪০ বছর ধরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর ডিগ্রি থাকার পরও প্রত্যন্ত গ্রামের মাটি ও মানুষের কল্যাণ এবং সব শিক্ষার্থীকে তিনি সন্তানের মতো মমতা ও ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখেন এখনও। তার চলাফেরা ও জীবনযাপনও একেবারে সাদামাটা। বলছিলাম খুলনার কয়রা উপজেলার কপোতাক্ষ মহাবিদ্যলয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আ ব ম আব্দুল মালেক স্যারের কথা।

নানা প্রতিকূল অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে খুলনার সর্বদক্ষিণের জনপদ কয়রা উপজেলার উপকূলীয় অঞ্চলে শিক্ষার বিস্তারে যে কয়েকজন ব্যক্তির অবদান অনস্বীকার্য, তাদের অন্যতম মালেক স্যার। জীবন সায়াহ্নে এসে এ আদর্শ শিক্ষক এখনও স্বপ্ন দেখেন দেশে প্রকৃত শিক্ষার বিস্তার ঘটবে। সঠিক মূল্যবোধ ও দেশপ্রেম নিয়ে শিক্ষার্থীরা বেড়ে উঠে দেশসেবায় আত্মনিয়োগ করবে।

মালেক স্যারের শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি নিজ গ্রামের মক্তব পাঠশালায়। এখানে তিনি দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করে ভর্তি হন ৪নং কয়রা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এরপর ১৯৭২ সালে উপজেলা সদরে অবস্থিত কয়রা সদরের মদিনাবাদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন তিনি। এ বিদ্যালয়ে তিনি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। পরে উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের বেদকাশী বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৭৮ সালে এসএসসি এবং পাইকগাছা মাধ্যমিক মাহাবিদ্যলয়ে হতে ১৯৮০ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় কৃতকার্য হন। এরপর তিনি দক্ষিণবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলনা দৌলতপুর সরকারি বিএল কলেজ থেকে ১৯৮৪ সালে বাংলা বিভাগে স্নাতক ডিগ্রি এবং ১৯৮৫ সালে এ কলেজ থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। শিক্ষাজীবনে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েও ফিরে আসেন নিজের জন্মস্থান কয়রা উপজেলায়। আ ব ম আব্দুল মালেক তার শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করে কর্মজীবনের শুরুতে কয়রা সিদ্দিকিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার বাংলা বিভাগে ৪ বছর প্রভাষক থাকার পর কয়রা উপজেলা সদরে অবস্থিত কপোতাক্ষ মহাবিদ্যালয় প্রভাষক পদে যোগদান করেন। এখানে তিনি দীর্ঘ বছর চাকরি করার পর ২০২১ সালের ৬ মে অবসর গ্রহণ করেন।

দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে মালেক স্যার কয়রা উপজেলায় একজন আদর্শ শিক্ষকের ভূমিকা পালন করেন। একজন ছাত্রের সত্যিকারের অভিভাবক হয়ে ওঠেন। অত্যন্ত মেধাবী এই শিক্ষকের ক্লাসে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ক্লাস করতেন শিক্ষার্থীরা। কপোতাক্ষ কলেজের শিক্ষার্থীসহ পুরো উপজেলায় এমনকি খুলনা শহরেও মালেক স্যারের সুনাম ছড়িয়ে পরে অনেক ক্ষেত্রে।

দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে নীতির প্রশ্নে তিনি বরাবরই অটল ছিলেন। ফলে তার সব ছাত্রছাত্রীর কাছে ছিলেন আদর্শ ও নীতির মূর্তপ্রতীক। প্রতিষ্ঠানের নিয়ম-শৃঙ্খলা থেকে শুরু করে প্রতিটি কর্মকাণ্ডে তার ওপর কলেজ প্রশাসনের ছিল গভীর আস্থা ও নির্ভরতা। ছাত্রছাত্রীদের ছিল অগাধ ভক্তি ও শ্রদ্ধা। শিক্ষকতা জীবনে তিনি এ অঞ্চলের গরিব ও মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্নভাবে সাহায্য ও সহযোগিতা করেছেন। সাহিত্য সাধন : প্রতিভাবান ব্যক্তি ছিলেন বাল্যকাল থেকে বিভিন্ন লেখালেখি শুরু করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি যখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র তখন খুলনার দাউদ প্রেস কর্তৃক প্রকাশিত মাসিক দিশারী পত্রিকায় তার প্রথম লেখা সুন্দরবন নামক একটি প্রবন্ধ প্রকাশ হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় যেমন- দিশারী, কালান্তর, নাবারুন, শতদল, ছাড়াও অন্যান্য পত্রপত্রিকায় তার অনেক লেখা প্রকাশিত হয়। ২০০২ সালে থেকে তার নিজ উদ্যোগে একটি সাহিত্য পত্রিকা (কপোতাক্ষ) নামে প্রকাশিত হয়ে আসছে। তার প্রতিষ্ঠিত কপোতাক্ষ সাহিত্য পরিষদ ২০০০ সাল থেকে আজ অবদি দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের সাহিত্যের খোরাক। তিনি এলাকায় কবি সাহিত্যিক ও গবেষক হিসেবে পরিচিত। তার প্রকাশিত গ্রন্থ, মাওলানা এ এফ এম হাবিবুল্লাহ শামীম (র.) এর জীবন ও কর্ম, কয়রা উপজেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য, কবি এবাদল্লাহ ও তার কাব্য, মাওলানা তমিজ উদ্দিনের জীবনী লেখা চলমান। শিক্ষকতার পাশাপাশি অনেক আগে থেকে বিভিন্ন সমাজকল্যাণ ও জনসেবামূলক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৯৮ সালে কপোতাক্ষ কলেজ সংলগ্ন পূর্ব পাশে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন কপোতাক্ষ শিশু একাডেমি নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

স্যারের ১৯৯৬-৯৭ শিক্ষা বর্ষের ছাত্র উত্তম মন্ডল বলেন, আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ও গুরুজন আমার জীবনের একটা অধ্যায়ের নাম আব্দুল মালেক স্যার। স্যারের ক্লাস করার জন্য আমরা আগ্রহে বসে থাকতাম। আমাদের ক্লাসে ৭২টা বেঞ্চ ছিল, স্যারের (বাংলা) ক্লাসের সময় বেঞ্চগুলো পুরো ভরে যেত। তার আচরণে কেউ কখনো কষ্ট পেয়েছে এমন কোনো নজির নাই। তার প্রাপ্য সম্মানটুকু আমরা এখনো দিতে পারিনি। আমার চোখে দেখা কয়রার সেরা শিক্ষকদের মধ্যে তিনি একজন। তিনি অনন্য এবং পরোপকারী। বিনা স্বার্থে কাউকে উপকার করতে তিনি কখনো পিছপা হননি।

একই শিক্ষাবর্ষের ছাত্র অজিয়ার রহমান বলেন, কলেজ জীবনে এমন অনেক দিন গেছে শুধু স্যারের মুখের কথা শোনা এবং স্যারের ক্লাস করার জন্য কলেজে গিয়েছি। কোনো সমস্যায় পড়ে গেলে আগে স্যারের কাছে শুনেছি। স্যার সঠিক পরামর্শ দিয়ে আমাদের অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছে।

শিক্ষক দিবস উপলেক্ষ আ ব ম আব্দুল মালেক বলেন ৪০ বছর ধরে শিক্ষকতা করেছি। পিছিয়ে পড়া এ জনপদের প্রতিটি সন্তানকে নিজের সন্তানের মত ভালোবেসেছি। তাদেরকে লেখাপড়ার পাশাপাশি মানুষের মত মানুষ বানাতে নিজের সাধ্যমতো সবটুকু করেছি। অনেক ছাত্রজীবনে সফল হয়েছে, আবার কেউ কেউ পারিপার্শ্বিক নানান কারণে বেশি লেখাপড়া করতে পারেনি। কিন্তু সবার মধ্যে সঠিক মূল্যবোধ দেয়ার চেষ্টা করেছি। একজন আদর্শ মানুষ বানাতে একজন শিক্ষক হিসাবে অভিভাবকের ভূমিকা পালন করতে হয়। আল্লাহর উপর ভরসা করে সেই কাজটি করে গেছি সব সময়। জীবন এখন পশ্চিম আকাশে অস্ত যাওয়ার অপেক্ষায়। এখনও স্বপ্ন দেখি এ দেশের প্রতিটি ছাত্র সঠিক মূল্যবোধের শিক্ষা নিয়ে দেশ ও মানুষের সেবায় জীবন আত্মনিয়োগ করবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উত্তরা ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি বিভাগের 'অ্যালামনাই রিইউনিয়ন ২০২৫' অনুষ্ঠিত

ব্লকেডের আওতায় গুলিস্তান, বন্ধ যান চলাচল

১৪ দলীয় জোটের দলগুলোর কার্যক্রম নিষিদ্ধ চেয়ে আইনি নোটিশ

মায়ামিতে থাকার ব্যাপারে জানেন না মেসি

আমি বিশ্বাস করি ফারিয়া আইনি প্রতিকার পাবে : ফারুকী

নুসরাত ফারিয়াদের গ্রেপ্তার করে গণহত্যার বিচারকে হালকা করা হচ্ছে : রাশেদ 

দুই ঘণ্টার মধ্যেই ‘ভারতের কান্না পৌঁছে গিয়েছিল ওয়াশিংটনে’

ব্লকেডে আটকা নগরভবন, বন্ধ সেবা কার্যক্রম

কাঠগড়ায় মলিন মুখে চুপচাপ ছিলেন নুসরাত ফারিয়া

আবারও বড় পরাজয়ের মুখে মেসির মায়ামি

১০

ফারিয়ার পাশে দাঁড়ালেন বাঁধন

১১

নুসরাত ফারিয়া কারাগারে

১২

ঝিনাইদহে সংঘর্ষে আহত ২ শতাধিক

১৩

আদালতে নুসরাত ফারিয়া

১৪

বদলে দেওয়া ইরাকি এক ‘নারীবাদীর’ গল্প

১৫

গৃহকর্মী মরিয়ম বিবিকে উদ্ধার করল পুলিশ

১৬

দিনাজপুরে ট্রাক-মাইক্রোবাস সংঘর্ষে নিহত ৪

১৭

খেলাধুলার উন্নয়নে সকল পদক্ষেপ নেওয়া হবে : তারেক রহমান

১৮

বিশ্বে সবচেয়ে গরম এখন কোথায়?

১৯

ভক্তদের অপেক্ষা করতে বললেন রাশমিকা

২০
X