মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমেই একা হয়ে পড়েছে ইরান। একসময় হিজবুল্লাহ, হামাস ও হুতি গোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে যে ‘প্রতিরোধ বলয়’ তেহরান গড়ে তুলেছিল, ইসরায়েলের ধারাবাহিক আঘাতে তা প্রায় ভেঙে পড়েছে। সিরিয়া, লেবাননের মতো এক সময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্ররাও এখন আর আগের মতো পাশে নেই।
ইরাকের সঙ্গে সম্পর্ক যতটা না আন্তরিক, তার চেয়ে বেশি কৌশলগত—স্বার্থকেন্দ্রিক। সেখানকার ইরানপন্থী গোষ্ঠীগুলোও এখন অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। ইয়েমেনে ইরান সমর্থিত হুতিদের শক্ত অবস্থান ছিল, এখন আন্তর্জাতিকভাবে একটি ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ হিসেবে বিবেচিত। দক্ষিণ এশিয়ায় ইরানের প্রভাব প্রায় নেই বললেই চলে, আর মধ্য এশিয়ায় তুর্কিভিত্তিক দেশগুলোর ওপর তুরস্কের প্রভাব অনেক বেশি।
এক সময় তেহরান লাতিন আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে চেয়েছিল, তবে সে চেষ্টাও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ভেনেজুয়েলা ও কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক থাকলেও তা এখন নিস্তেজ। ফলে, রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত ইরান এখন আফ্রিকার দিকে নতুন করে হাত বাড়াচ্ছে—বন্ধুত্বের আশায়।
গত ২৬ এপ্রিল বন্দর আব্বাসের শাহিদ রাজাঈ বন্দরে ভয়াবহ বিস্ফোরণে বহু হতাহতের পরদিনই তেহরানে শুরু হয় তৃতীয় ইরান-আফ্রিকা অর্থনৈতিক সহযোগিতা সম্মেলন। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে এই আয়োজন তেমনভাবে জায়গা না পেলেও, আফ্রিকার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে এটি ছিল তেহরানের কৌশলগত পদক্ষেপ।
চার দিনব্যাপী এই সম্মেলনে আফ্রিকার ৩৮টি দেশ থেকে ৭০০-র বেশি ব্যবসায়ী অংশ নেন। সঙ্গে ছিলেন ৫০ জনের বেশি উচ্চপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা। তেহরানে প্রাথমিক আলোচনা শেষে অতিথিদের নিয়ে যাওয়া হয় ইস্পাহানে, যেখানে ইরানের শিল্প, খনিজ ও প্রযুক্তি খাতের সক্ষমতা তুলে ধরা হয়। অংশগ্রহণকারীরা তাদের আগ্রহ অনুযায়ী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্প ঘুরে দেখেন।
সম্মেলনের শেষে খনিজ, কৃষি, পেট্রোকেমিক্যাল এবং চিকিৎসা যন্ত্রপাতি—এই চারটি খাতে আফ্রিকা ও ইরানের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি হয়। আয়োজকরা জানান, এটি আগের দুই সম্মেলনের চেয়ে অনেক বেশি ফলপ্রসূ, কারণ এবারের প্রতিনিধিরা ছিলেন খাতভিত্তিক বিশেষজ্ঞ ও সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি।
সম্মেলন শেষে অনেক অতিথি ইরানের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা সরেজমিনে দেখতে অতিরিক্ত সময়ও থেকে যান। আগামী সম্মেলনে তাদের কেরমান ও তাবরিজ প্রদেশে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে, যেখানে যথাক্রমে খনিজ এবং কার্পেট-ট্রাক্টর শিল্পের খ্যাতি রয়েছে।
ইরানের শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ আতাবেক জানিয়েছেন, বর্তমানে আফ্রিকার সঙ্গে ইরানের বার্ষিক বাণিজ্য ৮০০ মিলিয়ন ডলারের মতো, যা আগামীতে ১০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্য রয়েছে। তিনি আকাশ ও জলপথে যোগাযোগ বাড়ানোর ওপরও গুরুত্ব দেন।
তেহরান টাইমসের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, আফ্রিকার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের পেছনে শুধু অর্থনৈতিক নয়, কৌশলগত যুক্তিও আছে। পশ্চিমা ঔপনিবেশিক ইতিহাস আফ্রিকার সঙ্গে অনেক দেশের সম্পর্কে তিক্ততা তৈরি করেছে, সেখানে ইরান নিজেকে ‘সম্মানজনক বিকল্প’ হিসেবে তুলে ধরতে চায়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আফ্রিকা বিষয়ক প্রধান জাভেদ দেগঘান বলেন, ইরান ও আফ্রিকার সম্পর্কের ভিত্তি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ।
তবে বাস্তবতা হলো—চীন ও ভারত ইতোমধ্যে আফ্রিকায় ব্যাপকভাবে পুঁজি বিনিয়োগ করছে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পশ্চিমা চাপের মুখে রাশিয়াও সেখানে সামরিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টায় আছে। এই প্রতিযোগিতার মধ্যে ইরান কতটুকু জায়গা করে নিতে পারে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
এটা পরিষ্কার, মধ্যপ্রাচ্যে কোণঠাসা ইরান নতুন বন্ধু ও বাজার খুঁজছে আফ্রিকায়। আর সেই চেষ্টার ফল কতটা দৃশ্যমান হয়, তা নির্ভর করবে আগামী দিনগুলোর কূটনৈতিক বাস্তবতার ওপর।
মন্তব্য করুন