যশোরের অভয়নগর উপজেলার ডহরমশিয়াহাটি গ্রামের বাড়েদা পাড়া। ভবদহ অঞ্চলের বিলের মধ্যে এটির অবস্থান। পাড়াটিতে দোচালা টিনের বাড়িতে এক ছেলেকে নিয়ে বসবাস মহিতুল বিশ্বাস ও স্মৃতি বিশ্বাস দম্পতির। মতুয়া সম্প্রদায়ের এ বাড়িতে বৃহস্পতিবার রাতে চলছিল পূজা-অর্চনা।
হঠাৎই কয়েকজন লোক এসে বাড়িতে হামলা চালিয়ে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। আগুনে দুটি ঘরের সব জিনিস পুড়ে যায়। প্রাণভয়ে পরিবারের সদস্যরা পালিয়ে আশ্রয় নেন পাশের বিলে। সেদিনের ঘটনার পর স্মৃতি বিশ্বাস বাড়ি ফিরলেও স্বামী-সন্তান আতঙ্কে এখনো বাড়িতে আসেননি।
বৃহস্পতিবার (২২ মে) নওয়াপাড়া পৌর কৃষক দল সভাপতি তরিকুল ইসলামকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যার জেরে এ ঘটনা ঘটে।
ওই রাতে স্মৃতি বিশ্বাস ছাড়াও বাড়েদা পাড়ার ১৩ হিন্দু পরিবারের ১৮টি বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয়। তার আগে লুটপাট চালানো হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
স্মৃতি বিশ্বাস বলেন, তিন দিন ধরে আমার বাড়িতে পূজা চলছিল। বিভিন্ন দল ধর্মীয় কীর্তন করছিল। হঠাৎ ছয় থেকে সাতজন এসে বাড়িতে ভাঙচুর শুরু করে। গালাগাল করতে থাকে। তাদের হাতে অস্ত্র ছিল। আমাকেও মারধর করেছে। প্রাণ বাঁচাতে আমরা বিলের দিকে দৌড় দিই। দূর থেকে দেখি আমার বাড়িঘর আগুনে পুড়ছে। সকালে ফিরে দেখি কিছুই নেই। বাড়িতে দুটি মোটরসাইকেল ছিল, সেগুলোও পুড়ে ছাই। ঘরের ভেতরে বাক্স ভাঙা, ভেতরে কাপড়চোপড় আগুনে পুড়ে গেছে। তিনি অভিযোগ করেন, আগুন দেওয়ার আগে ওই লোকেরা লুটপাট চালায়।
স্থানীয়রা জানান, কৃষক দল নেতা তরিকুল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঘের লিজ নেওয়ার জন্য ডহরমশিয়াহাটির বাড়েদা পাড়ায় পিন্টু বিশ্বাসের বাড়িতে যান। সেখানে চুক্তিপত্র করার সময় হট্টগোল হয়। এ সময় অজ্ঞাত সাত-আটজন এসে তরিকুলকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যার পর পালিয়ে যায়। এ ঘটনার পর তরিকুলের সমর্থকরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন এবং তারা পিন্টু বিশ্বাসের তিনটি ঘরে আগুন ধরিয়ে দেন।
ক্ষতিগ্রস্তরা বলেন, অজ্ঞাত লোকজন দলবেঁধে এসে পিন্টু বিশ্বাসের প্রতিবেশীদের বাড়িতেও ভাঙচুর করে লুটপাট চালায় ও অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় ভয়ে তারা বাড়ি থেকে বেরিয়ে বিলে, ঝোপঝাড়ে আশ্রয় নেন। সকালে তারা বাড়ি ফিরে দেখেন ধানের গোলা, বসতঘর, রান্নাঘর, গোয়ালঘর, টিভি, ফ্রিজ, মোটরসাইকেল, বাইসাইকেল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
শুক্রবার বিকেলে বাড়েদা পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, ঘরবাড়ি পোড়া। কারও ঘরের শুধু দেয়াল আছে, ছাউনি, ঘরের জিনিস পুড়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িগুলোর বেশিরভাগই পুরুষশূন্য। ঘটনার দিন বৃহস্পতিবার রাত থেকেই বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন এসব বাড়ি। নিরাপত্তা দিতে এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে পুলিশ। মাঝে মাঝে সেনাবাহিনীর সদস্যদেরও টহল দিতে দেখা গেছে। কিন্তু তারপরও আতঙ্ক কাটেনি পাড়ার বাসিন্দাদের।
চন্ডিকা বিশ্বাস নামে একজন জানান, তাদের দুটি বাড়ি পুড়ে গেছে। তিনি বলেন, যারা অপরাধ করেছে, তাদের শাস্তি দিক। আমরা তো কোনো অপরাধ করিনি। তাহলে আমাদের ঘরবাড়ি কেন পোড়াল।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনায় তিনি বলেন, যখন হামলা হয় ভয়ে আমরা বিল পার হয়ে পাশের গ্রামে চলে যাই। হামলাকারীরা লুটপাট করে আগুন দিয়ে চলে যায়।
দুর্বৃত্তরা সবার আগে আগুন দেয় পরিতোষের বাড়িতে। তিনি বলেন, ‘কোনোরকমে জানডা নিয়ে পালিয়েছিলাম। বাড়িতে বুড়ো মা-বাবা ছিল, তাদের ফেলেই চলে যাই।’
তারা অভিযোগ করেন, বাড়িতে দুর্বৃত্তরা আগুন দেওয়ার পর পাড়ার লোকজন বিষয়টি ফায়ার সার্ভিসকে জানান। কিন্তু হামলাকারীরা ফায়ার সার্ভিসকে আসতে বাধা দেয়।
এদিকে পুলিশ সুপার রওনক জাহান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যশোরের নেতারা ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন যশোরের বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতারাও।
অভয়নগর থানার ওসি আব্দুল আলীম কালবেলাকে জানান, কৃষক দল নেতা হত্যাকে কেন্দ্র করে কিছু বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। খবর পেয়ে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস গিয়ে আগুন নেভায়। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে।
ওসি আরও জানান, হত্যা ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় শনিবার পর্যন্ত মামলা হয়নি। হত্যার ঘটনায় কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ।
মন্তব্য করুন