আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ, নাসিরনগর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া)
প্রকাশ : ০২ জুন ২০২৫, ১১:৪৫ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

‘নদী আমার সব লইয়া গেছে’

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর মেঘনার ভাঙনের একটি চিত্র। ছবি : কালবেলা
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর মেঘনার ভাঙনের একটি চিত্র। ছবি : কালবেলা

‘অনেক আশা লইয়া এই গেরামে আইছিলাম। ৭৫ শতক জায়গা কিন্না পাঁচ ফুতেরে পাঁচটা ঘর বানাইয়া দিছিলাম। এর মইধ্যে চাইরটা ঘরই নদী লইয়া গেছে গা, নদী আমার সব লইয়া গেছে গা। আমি অহন কই যামু। আমার ফুতেরা অহন আর বাড়িত আইয়ে না। আইয়া কী করব? থাকব কই? কী কইরা খাইব? এর লাইগা আইয়ে না। আমার আর কিচ্ছু নাই, আমি সরকারের কাছে সাহায্য চাই।’

চোখের পানি মুছতে মুছতে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার চাতলপাড় গ্রামের ৬৮ বছর বয়সী বৃদ্ধা আওলিয়া খাতুন।

শুধু তিনি নন, এমন অনেকে ভিটেমাটি, বাড়িঘর, দোকানপাট হারিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। এ পর্যন্ত প্রায় শতাধিক স্থাপনা নদীতে বিলীন হয়েছে। বিলীনের অপেক্ষায় শ্মশান, গোরস্তান, চকবাজার, বসতভিটাসহ অনেক স্থাপনা।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর থেকে সড়ক পথে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরত্ব নাসিরনগরের। সেখান থেকে নৌকায় করে চাতলপাড় পৌঁছতে সময় লাগে প্রায় পৌনে দুই ঘণ্টা। রোববার সরেজমিন চাতলপাড়ের বিভিন্ন অংশে ভাঙনের দৃশ্য চোখে পড়ে। এর মধ্য বিলের পাড় ও চকবাজারের ভাঙন ছিল চোখে পড়ার মতো। চকবাজার চাতলপাড়ের একটি ঐতিহ্যবাহী বাজার। আশপাশের প্রায় ৩০টি গ্রামের মানুষ এখান থেকেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা করে। মেঘনার ভাঙনের মুখে বাজারটি এখন প্রায় বিলীনের পথে। পার্শ্ববর্তী ভলাকুট ইউনিয়নের দুর্গাপুর ও বালিখোলার কিছু অংশও মেঘনায় বিলীন হওয়ার পথে। ভিটেমাটি হারিয়ে কেউ কেউ চলে গেছেন এলাকা ছেড়ে। নদীতে বিলীনের অপেক্ষায় শ্মশান, গোরস্তান, চকবাজার, বসতভিটাসহ শতাধিক স্থাপনা।

বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে যত দূর চোখ যায় সেখানে অন্তত অর্ধশত কাঁচা-পাকা ভবনের অর্ধেকই নদীতে চলে গেছে। স্থানীয়রা জানালেন, আরও শতাধিক ভবন আগেই নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ঝুঁকিতে আছে আরো অর্ধশত ভবন। ২০২০ সাল থেকে ভাঙনের সূত্রপাত হলে এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। ভাঙনের কবলে পড়ে এরই মধ্যে গৃহহীন হয়ে পড়েছে নদীতীরবর্তী শতাধিক পরিবার।

স্থানীয়দের অভিযোগ, রাজনৈতিক নেতা আর প্রশাসনের পরিদর্শন আর আশ্বাসেই কেটেছে গত পাঁচ বছর! অচিরেই এ ভাঙন রোধ করা না গেলে পুরো বাজারটাই নদীতে বিলীন হয়ে যেতে পারে, ভিটেবাড়ি ছাড়তে হতে পারে আরও শতাধিক পরিবারকে।

সর্বশেষ নদীভাঙন রোধে গত ১২ ফেব্রুয়ারি এলাকাবাসীর পক্ষে চাতলপাড় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার কাছে নদীভাঙন রোধে স্থায়ী প্রতিরক্ষামূলক বাঁধ নির্মাণের জন্য লিখিত আবেদন করেন।

ভাঙনের বিষয়ে চাতলপাড় চকবাজার কমিটির সহসভাপতি নোয়াব আলী বলেন, প্রায় ৩০টি গ্রামের মানুষ এ বাজারের ওপর নির্ভরশীল। নদীভাঙন রোধে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে না পারলে অচিরেই এ বাজারটি বিলীন হয়ে যাবে। বাজারের অনেকেরই দোকানপাট নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়ায় নিঃস্ব হয়ে গেছে। আর কত বিলীন হলে সরকারের টনক নড়বে! এ সমস্যার স্থায়ী সমাধানে পাঁচ বছর ধরে আমরা শুধু পরিদর্শন আর আশ্বাসই দেখে আসছি। সমাধানের ব্যাপারে কোনো কার্যকর সমাধান এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি।

এ বিষয়ে নদী ও প্রকৃতির সুরক্ষা নিয়ে কাজ করা সংগঠন তরী বাংলাদেশের আহ্বায়ক শামীম আহমেদ বলেন, চাতলপাড় ভেঙে মেঘনা নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে, এভাবে ভাঙতে থাকলে মানুষজন ভূমিহীন হয়ে পড়বে। বহু মানুষের বাড়িঘর, বাজার, মসজিদ, কবরস্থান, শ্মশান নদীগর্ভে চলে গেছে। প্রতি বছর বর্ষা আসলেই রাজনৈতিক দলের নেতারা, উপজেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে পরিদর্শন শেষে কিছু বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হয়। যা মেঘনা নদীর স্রোতে টিকে থাকতে পারে না।

তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক স্থায়ী বাঁধের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের কথা শোনা গেলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি! এ প্রকল্পের ব্যাপারেও খোঁজখবর নেওয়া উচিৎ মানুষজনকে ঘুমে রেখে প্রকল্প লোপাট হয়েছে কিনা। চাতলপাড়ের ঠিক বিপরীতে একটি চর অপসারণের কথা থাকলেও তা করা হচ্ছে না। মূলত এ চরের কারণেই চাতলপাড় ভাঙছে। তরী বাংলাদেশ দাবি করছে চর অপসারণ ও স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান হোক।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মনজুর রহমান বলেন, আশা করছি নদীভাঙন রোধে আগামী সপ্তাহ থেকেই অস্থায়ীভাবে কাজ শুরু করতে পারব। তবে স্থায়ী সমাধানের জন্য পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে একটা প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষা রয়েছি। প্রকল্পটি পাস হলেই কাজ শুরু হবে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দিদারুল আলম বলেন, নদীর অন্যপাশে চর জাগায় পানির গতিপথ পরিবর্তন হয়েছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। তবে নদীভাঙন রোধে যেন দ্রুততম সময়ের মধ্যে সমাধান করা যায়, তার জন্য আমরা বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করছি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ২০ কিমি যানজট  / ‘সকাল থেকে যানজটে আছি, কতক্ষণে মুক্তি পাব বুঝতেছি না’

ডা. জুবাইদা ও জাইমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চলছে : রিজভী

কাপ্তাই হ্রদে নিখোঁজ সেই স্কুলছাত্রের মরদেহ উদ্ধার

প্লাস্টিক বর্জ্য দিয়ে তৈরি পোশাক পরে ব্যতিক্রমী প্রতিবাদ 

লন্ডনের পথে ডা. জুবাইদা

ফারিণকে শুভকামনা রাজের

যুক্তরাষ্ট্রে নতুন করে অভিযান, একদিনে গ্রেপ্তার ২ সহস্রাধিক অভিবাসী

ভয়ংকর কিছুর পরিকল্পনা করছেন পুতিন, সতর্ক করলেন কন্ডোলিজা

তিন দিনে রেমিট্যান্স এলো সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা

কুমিল্লায় বড় গরুর পাশে দর্শনার্থী, ছোট ও মাঝারি বিক্রি বেশি

১০

ধূমপান দেখে ফেলায় শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা

১১

নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা করা হচ্ছে : রিজভী 

১২

কক্সবাজারে ট্যুরে গিয়ে ইয়াশ-তটিনীর দেখা!

১৩

ঈদের ছুটিতে টানা ১১ দিন বন্ধ তামাবিল স্থলবন্দর 

১৪

খোলা ট্রাকে বৃষ্টিতে ভিজে টানা ১২ ঘণ্টা মহাসড়কে যাত্রীরা

১৫

ইউটিউব বন্ধ হচ্ছে যেসব ফোনে 

১৬

মুক্তিযুদ্ধের সময় কি ড. ইউনূসের নামে স্লোগান দিয়েছিলেন, ফারুক ই আজমকে রনি

১৭

ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে ৭ কিমিজুড়ে যানবাহনে ধীরগতি

১৮

পলিথিন বিপর্যয়ে রাষ্ট্র ও নাগরিক, কে এগিয়ে?

১৯

গান নয়, অঙ্গভঙ্গিতেই ভাইরাল ‘আশিকি’র জোভান

২০
X