সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার অন্যতম পর্যটনস্পট টাঙ্গুয়ার হাওর। হাওরটি প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিশাল বিস্তৃত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠাপানির জলাভূমি। স্থানীয় লোকজনের কাছে হাওরটি ৯ কুড়ি কান্দা, ৬ কুড়ি বিল নামেও পরিচিত। সুন্দরবনের পরে এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট।
বর্ষা মৌসুমে পর্যটকদের পছন্দের জায়গা এখন টাঙ্গুয়ার হাওর। দেশি নৌকা বা হাউজবোটে হাওরে ভ্রমণ দিন দিন পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আর প্রতি বছর হাওরকে কেন্দ্র করে বর্ষা মৌসুমের প্রতি সপ্তাহে ছুটির দিনে হাজারো পর্যটক আসেন টাঙ্গুয়ার হাওরে।
এবার জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রথম দিকে হাওরে পানি না থাকলেও বর্তমানে টাঙ্গুয়ার হাওর পানিতে পরিপূর্ণ। একদিকে পাহাড় আর তার পাশে সারি সারি হিজল-করছ গাছে সমাদৃত বিশাল জলরাশির এ হাওর। এ যেন অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি।
ঈদুল আজহার আগমনের সঙ্গে সঙ্গে হাওর যেন তৈরি হয়েছে তার আপন মহিমায়। শুকনো মৌসুমে দীর্ঘ ছয়মাস হাওরে পর্যটকদের আনাগোনা কম থাকলেও এ বছর বর্ষার শুরুতেই হাওরে পর্যটকদের আগমন ঘটবে ঈদকে ঘিরে।
ঈদের লম্বা ছুটিতে হাওর ঘুরতে ১৫-২০ দিন আগ থেকেই হাওরগামী ছোট বড় হাউজবোট নৌকা বুকিং করে রেখেছেন পর্যটকরা। পর্যটকদের এমন সাড়া পেয়ে আনন্দিত হাউজবোট মালিক, মাঝি, কর্মচারী ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
জানা গেছে, এ উপজেলায় টাঙ্গুয়ার হাওর ছাড়াও আরো বেশ কয়েকটি দর্শনীয় স্থান রয়েছে। যেমন, ট্যাকেরঘাট নিলাদ্রী লেক, সীমান্ত ঘেঁষা ৩০০ ফুট উচ্চতার বারেক টিলা, এর সঙ্গেই রূপের নদী জাদুকাটা, এশিয়ার সর্ব বৃহৎ জয়নাল আবেদীন শিমুল বাগানসহ সৌন্দর্যপূর্ণ কয়েকটি ঝর্ণা। সারা বছর এসব জায়গায় পর্যটকের আগমন ঘটলেও বর্ষায় হাউজবোটে হাওর হয়ে এসব জায়গায় ঘুরতে বেশি পছন্দ করেন পর্যটকরা। বর্ষায় এ উপজেলা হয়ে উঠে পর্যটকদের জন্য অন্যতম দর্শনীয় স্থান।
হাউজবোট মালিকরা জানান, মৌসুমের শুরুতেই ঈদের লম্বা ছুটি পেয়ে পর্যটকরা একমাস আগে থেকেই হাউজবোট বুকিং করে রেখেছেন। হাওরে ভ্রমণের জন্য আগে থেকেই নৌকা নির্ধারণ করে রাখা উত্তম। তা না হলে উপস্থিত মুহূর্তে নৌকা না পেয়ে পর্যটকরা বিপাকে পড়তে পারেন।
স্থানীয় পর্যটকবাহী মাঝারি হাউজবোটের মাঝি রুজেল মিয়া বলেন, ঈদে অনেক পর্যটকের আগমন ঘটবে। ঈদ উপলক্ষে বছরের শুরুতেই পর্যটকদের ভালো সাড়া পাচ্ছি। বোটের প্রস্তুতি শেষ। মাঝারি হাউজবোটে ১০ থেকে ১৫জন খুব আরামে থাকতে পারবে। ঈদে পর্যটকদের চাপ থাকায় মাঝারি বোট ভাড়া ২৫-৩০ হাজার টাকা নেওয়া হচ্ছে। এবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য কোন সমস্যা না থাকলে হাওরকে ঘিরে প্রচুর পর্যটকের আগমন ঘটবে।
সুনামগঞ্জ হাউসবোট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আরাফাত আকন্দ বললেন, আমাদের ৯০টি হাউসবোটের প্রায় সবকয়টির বুকিং শেষ। এবার সকল বোটেরই অন্যান্য প্রস্তুতির পাশাপাশি অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা, পর্যটকদের জন্য লাইফ জাকেট ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা সন্তোষজনক করেই বোট ঘুরবে টাঙ্গুয়ার হাওরে। সমিতির পক্ষ থেকে কঠোর মনিটরিং থাকছে। পরিবেশ দূষণের বিষয়টিও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। প্রশাসনেরও সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।
তাহিরপুর নৌ-পর্যটন শিল্প সমবায় সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ রব্বানী বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরকে ঘিরে ছোট, বড় ও মাঝারি হাউজবোট নৌকা রয়েছে প্রায় পাঁচ শতাধিক। বড় বড় হাউজ বোট ছাড়াও মাঝারি ও ছোট বোটগুলোতেও মানসম্মত থাকা খাওয়ার পরিবেশ রয়েছে। নিরাপত্তা নিশ্চিতে সবাই সচেতন ভূমিকা পালন করবে। তাছাড়া আমাদের সমিতির পক্ষ থেকেও তদারকি করা হবে। ঈদের প্রচুর চাপ পড়েছে স্থানীয় নৌকা ছাড়াও বাহির থেকেও অনেক নৌকা আসতে পারে।
তাহিরপুর থানার ওসি দেলোয়ার হোসেন বলেন, ধারণা করা যাচ্ছে ঈদে এবার অসংখ্য পর্যটক হাওরে ঘুরতে আসবে। তাই আমরা তাহিরপুর বাজার নৌকা ঘাট, থানার ঘাট, আনোয়ারপুর নৌকা ঘাটে পুলিশ মোতায়েন থাকবে। এছাড়াও হাওরে ও ট্যাকেরঘাট নিলাদ্রীর পাড়ে থানা পুলিশ, নৌ-পুলিশ ও ট্যুরিস্ট পুলিশ কাজ করবে। পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য প্রতিটা পয়েন্টে মোবাইল নাম্বার টানানো হবে।
তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবুল হাসেম বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটক আসতে কোনো বাধা নেই। তবে হাওরে প্রবেশকারী সকল বোটকে প্রশাসনের নীতিমালা মানতে হবে। পর্যটকদের সবাইকে হাওরের পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ করা যাবে না। তাহিরপুরে আগত পর্যটকদের সার্বিক সহযোগিতায় উপজেলা প্রশাসন সার্বক্ষণিক কাজ করবে।
যেভাবে যাবেন : তাহিরপুরে আসতে হলে ঢাকা থেকে সড়ক পথে সুনামগঞ্জ জেলা শহরে আসতে হবে। ফকিরাপুল, সায়দাবাদ থেকে শ্যামলী পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, এনা পরিবহন ও মামুন পরিবহনের বাসগুলো সুনামগঞ্জ আসে। নন এসি বাসের ভাড়া পড়বে ৬৫০-৮৫০ টাকা। বাসে সুনামগঞ্জ পৌঁছাতে ৬/৭ ঘণ্টার মতো সময় লাগবে।
সুনামগঞ্জ নেমে সুরমা নদীর ওপর নির্মিত আব্দুজ জহুর ব্রিজের কাছে লেগুনা, সিএনজি অথবা মোটরবাইকে করে তাহিরপুরে আসা যায়। সময় লাগবে প্রায় এক ঘণ্টা। তাহিরপুরে নৌকা ঘাট থেকে আকার ও সামর্থ্য অনুযায়ী ইঞ্জিন চালিত নৌকা বা হাউজবোট ভাড়া করতে হবে। তবে হাউজবোট ভাড়া করতে হলে আগে থেকেই বুকিং করতে হয়।
হাউজবোটে ভ্রমণ করতে চাইল আপনার কাজ হবে শুধু সুনামগঞ্জ বা তাহিরপুর পৌঁছানো। এরপর ভ্রমণের সব দায়িত্ব হাউজ বোটের। হাউজবোট সুনামগঞ্জ শহরের সাহেব বাড়ি ঘাট থেকে ছাড়বে নাকি তাহিরপুর থেকে ছাড়বে তা আগে থেকেই জেনে নিতে হবে। সুনামগঞ্জের ঘাট থেকে হাউজবোটে উঠলে টাঙ্গুয়া যেতে দুই-তিন ঘণ্টা হাউজবোটে জার্নি করতে হবে।
মন্তব্য করুন