ঈদের ছুটিতে দেশের জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে যখন মানুষের ঢল, তখন ব্যতিক্রমী চিত্র দেখা গেল যশোরের কেশবপুর উপজেলার ঐতিহাসিক সাগরদাঁড়ির মধুপল্লীতে। মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মভূমি হওয়া সত্ত্বেও ঈদের দিনটিতে দর্শনার্থী প্রায় ছিল না বললেই চলে।
সাধারণত ঈদ বা সরকারি ছুটির দিনে সাগরদাঁড়িতে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সী দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখর থাকে গোটা এলাকা। কিন্তু এবারে ঈদের দ্বিতীয় দিন দুপুর পর্যন্ত মধুপল্লীতে ছিল স্তব্ধতা, যেন উৎসব নয়, বরং সময় থেমে গেছে।
মধুসূদনের স্মৃতি ঘেরা, তবুও উপেক্ষিত : ঐতিহাসিকভাবে মধুপল্লী বাংলাদেশের এক অনন্য সাহিত্যভিত্তিক দর্শনীয় স্থান। এখানেই জন্মগ্রহণ করেন উনিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ও নাট্যকার মাইকেল মধুসূদন দত্ত। রয়েছে তার স্মৃতিবিজড়িত জন্ম ভিটা, হাতে লেখা কবিতার পাণ্ডুলিপি, পুরাতন আসবাব, বইপত্র, লাইব্রেরি এবং তার ব্যবহার করা বিভিন্ন সামগ্রী।
এ ছাড়াও মধুসূদন একাডেমি, মুক্তমঞ্চ, স্মৃতি ফলক, কবির পৈতৃক আমবাগান ইত্যাদি ঘিরে তৈরি হয়েছে একটি সাহিত্য ও ইতিহাসনির্ভর সাংস্কৃতিক এলাকা। কিন্তু এসব ঐতিহাসিক সম্পদ আজ পর্যটনখাতে পর্যাপ্ত আগ্রহ ও উদ্যোগের অভাবে হারিয়ে ফেলছে আবেদন।
ঈদের দ্বিতীয় দিন (৮ জুন) দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, সাগরদাঁড়ি মধুপল্লীর মূল ফটক ছিল খোলা, কিন্তু দর্শনার্থীর সংখ্যা ছিল একেবারেই নগণ্য। কর্মচারীরা নিরুত্তাপ মুখে বসে ছিলেন।
মধুপল্লীর দায়িত্বে থাকা একজন গাইড আবুল কাশেম বলেন, ঈদে অন্তত কয়েক’শ দর্শনার্থী এসে ভিড় করে। বাসে করে দল বেঁধে মানুষ আসে। এবার মাত্র ২০-২৫ জন এসেছে, তাও একা একা। আগে যে চঞ্চলতা ছিল, এবার তা নেই।
সাগরদাঁড়ি বাজারের পাশের দোকানপাটেও ছিল একই চিত্র। চা, ঝালমুড়ি, ফুচকা, খেলনার দোকানগুলো খোলা থাকলেও বেচাকেনা ছিল একেবারে কম।
স্থানীয় দোকানি মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, সারা বছরের যে কয়টা দিন বেচাকেনা হয়, ঈদের সময়ই সবচেয়ে বেশি হয়। কিন্তু এবার একেবারে মানুষ আসেনি।
যশোর থেকে আসা দর্শনার্থী উম্মে সুমাইয়া বলেন, আমরা ইতিহাস ভালোবাসি, তাই এখানে এসেছি। কিন্তু ছোট বাচ্চা নিয়ে এসেছি, তার জন্য কোনো খেলার জায়গা নেই। চত্বরটা ফাঁকা, কিছুক্ষণ ঘুরেই চলে যেতে হলো।
দর্শনার্থী না আসার কারণ হিসেবে স্থানীয়রা জানান, কিছু যৌক্তিক কারণে ঈদে মানুষ সাগরদাঁড়ির মধুপল্লীতে আসেনি। এর মধ্যে অন্যতম হলো- পর্যটন সুবিধার অভাব, শিশুদের খেলার জায়গা, মানসম্মত খাবার হোটেল, বসার স্থান, গাইডেড ট্যুর এসব সুবিধা তেমন নেই। এ ছাড়া পর্যাপ্ত প্রচারণার অভাবও রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা গণমাধ্যমে তেমন কোনো প্রচার নেই।
তারা আরও জানান, আধুনিক বিনোদনের আকর্ষণ হিসেবে এখন মানুষ সি-বিচ, অ্যামিউজমেন্ট পার্ক, রিসোর্ট বা ওয়াটার ওয়ার্ল্ডে সময় কাটাতে বেশি আগ্রহী। তাই সময়ে সঙ্গে তাল মিলিয়ে পর্যটককে আকৃষ্ট করতে হলে সাগরদাঁড়িকে নতুন করে সাজাতে হবে।
উন্নয়নের সম্ভাবনা ও করণীয় : সাগরদাঁড়ির মধুপল্লী শুধু পর্যটন নয়, জাতিসত্তার সাহিত্যিক শিকড়। চাইলে এখানে গড়ে তোলা যেতে পারে শিশুদের উপযোগী সাহিত্য থিম পার্ক, মধুসূদনের জীবন ও কর্ম নিয়ে ইন্টার্যাকটিভ মিউজিয়াম, লাইভ থিয়েটার ও কবিতা পাঠের আয়োজন, ক্যাফেটেরিয়া ও বই বিপণি এবং সুপরিকল্পিত গাইডেড ট্যুর ব্যবস্থা।
যশোর জেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মধুপল্লীর উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সংস্কারের পাশাপাশি পর্যটকদের জন্য কিছু নতুন সুবিধা যুক্ত করার ভাবনা আছে।
মন্তব্য করুন