বাজারে বিক্রি হওয়া অধিকাংশ আনারস টক স্বাদের হয়ে থাকে। এর অন্যতম কারণ—একসঙ্গে বিপুল আনারস হারভেস্ট করতে গিয়ে ব্যবসায়ীরা ফল দ্রুত পাকাতে কৃত্রিম রাসায়নিক এজেন্ট ব্যবহার করেন। এতে আনারসের প্রাকৃতিক স্বাদ, গন্ধ ও গুণগত মান অনেকাংশেই হারিয়ে যায়।
এ সমস্যা সমাধানে আনারস চাষে উন্নত প্রযুক্তি প্রয়োগ করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) এগ্রোনমি অ্যান্ড এগ্রিকালচার এক্সটেনশন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. গিয়াসউদ্দিন আহমেদ।
এ গবেষণায় আনারসের গুণগতমানসম্পন্ন চারা উৎপাদনের জন্য টিস্যু কালচার পদ্ধতি ব্যবহার করছেন। এর মাধ্যমে একই সঙ্গে অসংখ্য চারা উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে, যা ফলকে করে তুলছে আরও বড়, সুমিষ্ট এবং রোগবালাইমুক্ত। এতে খরচের পরিমাণও কমবে। গবেষণায় সহযোগী হিসেবে আরও ছিলেন রাবি এগ্রোনমি অ্যান্ড এগ্রিকালচার এক্সটেনশন বিভাগের এমএস শিক্ষার্থী শারমিন সুলতানা ও পিএইচডি ফেলো মাকসুদা পারভিন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের ড. গিয়াসউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন এগ্রোটেকনোলজি ল্যাবের গ্রোথ চেম্বারে আনারসের কেলাস থেকে ‘সোমাটিক এমব্রায়ো’ বা অণু চারা তৈরি করা হয়। পরে এ অণু চারা থেকে ৩-৪ মাসে একটি সুস্থ ও পরিপক্ব চারা তৈরি হয়। এরপর অভিযোজন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে স্থানান্তর করা হয়।
স্থানান্তরের জন্য ল্যাবের সামনের একটি সংরক্ষিত ও নিয়ন্ত্রিত প্লট ব্যবহার করা হয়, যেখানে পরীক্ষামূলকভাবে এই চারাগুলোর চাষাবাদ চলছে। সেখানে দেখা যায় যে কিছু গাছে ইতোমধ্যে আনারস ধরেছে। আনারস গাছগুলো টবে রোপণ করা হয়েছে এবং প্রতিটি টবের নিচ দিয়ে পাইপের মাধ্যমে পিএইচ নিয়ন্ত্রিত ড্রিপ সেচ দেওয়া হয়।
গবেষণায় দেখা যায়, একটি আনারস গাছে সাধারণত তিনটি অংশ থাকে—সাকার, স্লিপ এবং ক্রাউন। এর মধ্যে গাছের উপরের অংশে থাকা ক্রাউন থেকে ছোট অংশ কেটে আর্টিফিশিয়াল গ্রোথ রেগুলেটর ও এমএস মিডিয়া ব্যবহার করে কেলাস তৈরি হয়। কেলাস হলো কোষের একটি পুঞ্জ, যা থেকে পরবর্তী ধাপে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে সাব-কালচার তৈরি করা হয়। পরে পুষ্টিমাধ্যমে রেখে নতুন কেলাস গঠন করে সেখান থেকে রিজেনারেশন পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন করা হয়।
এ বিষয়ে গবেষক অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ বলেন, আনারস বড় পরিসরে চাষ করতে হলে একসঙ্গে প্রচুর চারা প্রয়োজন হয়, যা সাধারণ উপায়ে তৈরি করা সম্ভব নয়। তাই আমরা টিস্যু কালচার পদ্ধতি নিচ্ছি। এটি মূলত মাইক্রোপ্রোপাগেশন ভিত্তিক, যার পর মাস প্রোপাগেশন প্রক্রিয়ায় হাজার হাজার চারা উৎপাদন সম্ভব।
তিনি আরও বলেন, পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে প্রায় তিন মাস সময় লাগে। চারার শিকড় গজালে ধাপে ধাপে তা উন্মুক্ত পরিবেশে অভিযোজন করানো হয়। এরপর অর্গানিক উপাদানে তৈরি মাটির মিশ্রণে, নির্দিষ্ট পিএইচ বজায় রেখে চারাগুলো রোপণ করা হয়। প্রথম কয়েকদিন হালকা রোদে রেখে অভিযোজনের পর তা মাঠে স্থানান্তর করা হয়।
অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন জানান, এই একই পদ্ধতিতে আলু ও স্ট্রবেরির চারা উৎপাদন হচ্ছে। টিস্যু কালচারে উৎপাদিত ফল সাধারণ ফলের তুলনায় আকারে বড়, স্বাদে মিষ্টি ও নিখুঁত হয়ে থাকে। পাশাপাশি রোগবালাই ও পোকার আক্রমণ তুলনামূলকভাবে অনেক কম হয়। যেখানে মাঠে একটি গাছ থেকে গড়ে মাত্র ৩–৪টি চারা পাওয়া যায়, টিস্যু কালচারে সেখানে একই সময়ে শত শত চারা উৎপাদন করা সম্ভব। এতে খরচের পরিমাণও কমবে।
মন্তব্য করুন