বেশ কিছুদিন ধরে চলছিল চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের কর্মকর্তাদের কলমবিরতি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্তির প্রতিবাদসহ বিভিন্ন দাবিতে এই কর্মসূচি পালন করছিল তারা। এরপর কোরবানির ঈদ, টানা ছুটির ফাঁদ। যে কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে জমে গিয়েছিল অতিরিক্ত ৮-১০ হাজার কনটেইনার।
ছুটির পর কনটেইনার ডেলিভারির গতি কিছুটা বাড়লেও গত বুধ ও বৃহস্পতিবার আবারও একই কর্মসূচিতে নামেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। সকাল ৯টা থেকে বিকেল পর্যন্ত চলে তাদের কর্মবিরতি। এরপর গত শনি ও রোববার ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ চলমান রাখেন তারা।
আমদানি-রপ্তানি পণ্যের শুল্কায়ন ও ডেলিভারি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দরে সৃষ্টি হয়েছে অচলাবস্থা। শনি ও রোববার, দুদিনে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে রপ্তানি হয়নি প্রায় সাত হাজারের ওপরে কনটেইনার। এতে আবারও দীর্ঘমেয়াদি কনটেইনার জটের কবলে পড়তে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর, যা চট্টগ্রাম বন্দরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক কনটেইনার রপ্তানি না হওয়ার পরিসংখ্যান।
এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন সেবাপ্রত্যাশীরা। বিশেষ করে, তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা রপ্তানি পণ্য জাহাজীকরণে বাধার মুখে পড়ায় আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন। পাশাপাশি এনবিআরের কর্মকর্তারা কাজে না ফেরায় জুন মাস শেষ হওয়ায় লোন পরিশোধ করতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। যে কারণে প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার শঙ্কায় ভুগছেন তারা।
শিপিং কোম্পানির কর্মকর্তারা জানান, রপ্তানি পণ্য প্রথমে কারখানা থেকে চট্টগ্রামের ১৯টি ডিপোতে আনা হয়। সেখানে শুল্কায়নের পর কনটেইনারে ভরা হয়। সব প্রক্রিয়া শেষে বুকিং অনুযায়ী বন্দরে এনে জাহাজে তুলে দেওয়া হয়। বেসরকারি কনটেইনার ডিপো সমিতির (বিকডা) মহাসচিব রুহুল আমিন সিকদার (বিপ্লব) বলেন, ডিপোতে প্রতিদিনই রপ্তানি পণ্যের স্তূপ বাড়ছে। তবে কাস্টমস কর্মকর্তারা না আসায় শুল্কায়ন কার্যক্রম হচ্ছে না। তাতে কোনো কনটেইনার বন্দরে পাঠানো যাচ্ছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রোববার বন্দর জেটিতে থাকা এএস সিসিলিয়া, এক্সপ্রেস নিলওয়ালা ও হং ডা জিন-৬৮ নামের তিনটি জাহাজ রপ্তানি কনটেইনার নিয়ে বন্দর ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কাস্টমসের কর্মসূচির কারণে শনি ও রোববার কোনো কনটেইনার ডিপো থেকে বন্দরে পাঠানো যায়নি।
কর্মসূচির আগে কিছুসংখ্যক কনটেইনার জাহাজে তোলা হলেও বুকিং অনুযায়ী সব কনটেইনার না আসায় তিনটি জাহাজ বন্দর ছেড়ে যেতে পারেনি। এএস সিসিলিয়া জাহাজ ৫৬৪ একক কনটেইনার নিয়ে সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে বন্দর ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। সেখান থেকে এসব কনটেইনার ইউরোপ-আমেরিকাগামী বড় জাহাজে তুলে দেওয়ার কথা। এক্সপ্রেস নিলওয়ালা নামে আরেকটি জাহাজে রপ্তানির কথা ছিল ১ হাজার ৪৬০ একক কনটেইনার। হং ডা জিন-৬৮ নামের অন্য জাহাজটিতে ১ হাজার ৬৬৬ একক কনটেইনার রপ্তানি হওয়ার কথা ছিল। রপ্তানি কনটেইনার না পেয়ে তিন জাহাজই এখন জেটিতে অলস বসে আছে।
এএস সিসিলিয়া জাহাজের মালিক মেডিটেরানিয়ান শিপিং কোম্পানির হেড অব অপারেশন অ্যান্ড লজিস্টিকস আজমীর হোসেন চৌধুরী বলেন, ডিপো থেকে রপ্তানি কনটেইনার আসতে না পারায় জাহাজটি বন্দর ছেড়ে যেতে পারেনি। এই জাহাজের কনটেইনারগুলো সিঙ্গাপুরে নেওয়ার কথা ছিল। সেখান থেকে ইউরোপ-আমেরিকাগামী বড় কনটেইনার জাহাজে তুলে দেওয়ার কথা। এখন সময়মতো ইউরোপ-আমেরিকাগামী বড় কনটেইনার জাহাজে তুলে দেওয়া যাচ্ছে না।
শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম সুজন বলেন, এনবিআর কর্মীদের শাটডাউন কর্মসূচির প্রভাব আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে পড়বে। এ কর্মসূচির কারণে বন্দরে কনটেইনার জট বাড়াবে। আমদানিকারকদের জন্য নেতিবাচক প্রভাব তৈরি হবে। কিছুদিন আগে এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কলমবিরতি পালন করেছেন। এতে করে বন্দরে ভয়াবহ কনটেইনার জট তৈরি হয়েছিল। আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে সংকট তৈরি হয়। এ সংকট কাটিয়ে ওঠার সময়ে আবারও এ আন্দোলন অনাকাঙ্ক্ষিত।
তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর পরিচালক রাকিবুল আলম চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, কাস্টমস কর্মকর্তাদের এমন কর্মসূচিতে ব্যবসায়ীরা তো ক্ষতিগ্রস্তই, সাধারণ মানুষও এর বাইরে নয়। শুল্কায়ন কার্যক্রম পরিচালনা করতে না পারায় কনটেইনার ডেলিভারি ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষ করে শেষ হতে যাওয়া জুলাই মাসে ব্যবসায়ীদের লোন পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু তাদের কর্মসূচির কারণে এটা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে অনেকগুলো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, কাস্টমসের কর্মসূচির কারণে বন্দরে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে প্রভাব পড়েছে। নতুন করে কোনো কনটেইনার খালাস হয়নি। রপ্তানি কনটেইনারও ডিপো থেকে আসেনি। কারণ, আমদানি-রপ্তানির শুল্কায়ন কার্যক্রম করে কাস্টমস।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের উপকমিশনার ও মুখপাত্র সাইদুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, এনবিআর কর্মকর্তাদের কর্মসূচিতে সমর্থন রয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের। এ কারণে চট্টগ্রাম কাস্টমসে কোনো ধরনের কাজ হচ্ছে না।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, কাস্টমসের কিছু কর্মকর্তা মার্চ টু এনবিআরে যোগ দিতে ঢাকায় অবস্থান করছেন। যেসব কর্মকর্তা চট্টগ্রামে আছেন, তারাও কাজ বন্ধ রেখেছেন। ফলে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস এখন লোকশূন্য বলা যায়।
এদিকে রোববার (২৯ জুন) সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, রাষ্ট্রের চাহিদার তুলনায় রাজস্ব আহরণ অপ্রতুল। এর মূল কারণ দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম ও দুর্নীতি। এসব দুর্বলতা কাটাতে সরকার সংস্কারের উদ্যোগ নিলেও তা ব্যাহত করছে কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর চলমান আন্দোলন। দুই মাস ধরে আমদানি-রপ্তানি, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং রাজস্ব সংগ্রহ কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করে তারা দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের আহ্বান জানানো হলেও আন্দোলনকারীরা তা প্রত্যাখ্যান করে অনমনীয় অবস্থানে রয়েছেন।
আন্দোলনকে ‘পরিকল্পিত, দুরভিসন্ধিমূলক ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী’ আখ্যা দিয়ে সরকার জানিয়েছে, জাতীয় স্বার্থে এনবিআরের আওতাধীন কাস্টমস হাউস, আইসিডি, বন্ড কমিশনারেট ও শুল্ক স্টেশনগুলোর সব চাকরি ‘অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সরকার আশা প্রকাশ করেছে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অবিলম্বে কর্মস্থলে ফিরবেন এবং দায়িত্ব পালন করবেন। তা না হলে দেশের জনগণ ও অর্থনীতির স্বার্থে সরকার কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।
মন্তব্য করুন