চট্টগ্রাম নগরীর কাপাসগোলায় হিজড়া খালে পড়ে ছয় মাসের শিশু সেহরিশের মৃত্যুর জন্য ৮টি কারণ চিহ্নিত করেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) গঠিত তদন্ত কমিটি।
এসব কারণের মধ্যে রিকশাচালকের অদক্ষতা, সেবা সংস্থাগুলোর অব্যবস্থাপনা, গাফিলতি এবং দীর্ঘদিনের সমন্বয়হীনতা রয়েছে। তদন্ত কমিটি মৃত্যুর কারণ উদঘাটনের পাশাপাশি ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে এজন্য বেশকিছু সুপারিশ করেছে।
সোমবার (২৮ জুলাই) চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেনের কাছে ২৯ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনটি হস্তান্তর করা হয়।
গত ১৮ এপ্রিল রাতে কাপাসগোলায় নবাব হোটেল সংলগ্ন সড়কে ব্যাটারিচালিত একটি রিকশা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাশে হিজড়া খালে পড়ে যায়। রিকশাটিতে ছিলেন সেহরিশ, তার মা ও দাদি। মা ও দাদি রক্ষা পেলেও পানির স্রোতে তলিয়ে যায় শিশুটি। প্রায় ১৪ ঘণ্টা পর সকালে চাক্তাই খাল থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরবর্তীতে ২২ এপ্রিল একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
চসিকের গঠিত তদন্ত কমিটিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও চুয়েটের শিক্ষক, স্থপতি, নগরপরিকল্পনাবিদ, প্রকৌশলী, জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধি এবং বিভিন্ন সেবা সংস্থার কর্মকর্তারা ছিলেন। সাত কর্মদিবসে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা থাকলেও তিন মাস পর তা জমা দেওয়া হয়।
রিকশাচালক যাত্রীদের না তুলে পালিয়ে যান : তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, রিকশাটি যে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল তার ডানপাশে ভবন ও বামপাশে খাল থাকায় নিহত সেহরীশের মা নিরাপত্তার স্বার্থে রিকশাচালককে রাস্তার ডানপাশ ঘেঁষে গাড়ি চালানোর জন্য তিনবার অনুরোধ করেন। কিন্তু রিকশাচালক তাতে কর্ণপাত করেননি।
আবার রাস্তাটির ঢালু অংশে গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য চালক তার আসন থেকে নেমে রিকশাটি হাতে টানার কথা থাকলেও অনুরোধ অগ্রাহ্য করে তিনি তা আসনে বসেই চালাচ্ছিলেন। ফলে রিকশার গতি নিয়ন্ত্রণ তার জন্য সহজ ছিল না। চালকের অদক্ষতা এবং অসচেতনতার কারণে হিজড়া খালের শুরুতে যে অংশটিতে নিরাপত্তা বেষ্টনী ছিল না, ওই অংশের শেষ প্রান্ত দিয়ে রিকশাটি খালে পড়ে যায়।
রিকশাটি খালে পড়ে যাওয়ার পর অর্ধ-ডুবন্ত থাকলেও তৎক্ষণাৎ চালক যাত্রীদের তোলার চেষ্টা করেননি। বরং রিকশার উপর ভর দিয়ে তিনি রাস্তায় উঠে পালিয়ে যান। চালকের ভরে রিকশাটি খালে সম্পূর্ণরূপে ডুবে যায়। এ সময় মা অজ্ঞান হয়ে গেলে শিশু সেহরীশ তার হাত থেকে ছুটে যায়। এক পর্যায়ে স্রোতের কারণে শিশু, মা ও দাদি ভেসে যান।
দুর্ঘটনার পেছনে ৮ কারণ : তদন্ত কমিটির সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও বিশ্লেষণ করে ৮টি কারণ চিহ্নিত করেন। সেগুলো হলো- অদক্ষ রিকশাচালক ও অনিয়ন্ত্রিত গতি, অরক্ষিত খাল, সংকীর্ণ সড়ক, ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিত না থাকা, বৃষ্টিপাত, বর্জ্যে পূর্ণ খাল-নালা, উদ্ধার সামগ্রী ও জনবলের অভাব এবং জনসচেতনতার ঘাটতি।
সমন্বয়হীনতায় ব্যর্থ মাস্টারপ্লান : প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ১৯৯৫ সালে ইউএনডিপি ও ইউএনএইচসিআরের সহায়তায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) নগরীর ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করেছিল। বাস্তবায়নের দায়িত্বে ছিল চসিক আর মেয়াদ ছিল ২০১৫ পর্যন্ত। এতে শহরকে ১২টি ড্রেনেজ এলাকায় ভাগ করে তিনটি নতুন খাল খননের সুপারিশ করা হয়। তবে অর্থ সংকট ও সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে পরিকল্পনাটি ব্যর্থ হয়। সিডিএ, চসিক, পানি উন্নয়ন বোর্ড, ওয়াসা ও বন্দর কর্তৃপক্ষকে একসঙ্গে কাজ করার কথা থাকলেও গত ১৫ বছরেও তাদের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় হয়নি।
৮ বছরে ১৬ জনের মৃত্যু : প্রতিবেদনের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত চট্টগ্রামে নালা বা খালে পড়ে ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ১০ পুরুষ ও ৬ নারী। মৃত্যুগুলোর কারণ হিসেবে উঠে এসেছে- উন্মুক্ত ও অরক্ষিত খাল, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত না থাকা, আলো স্বল্পতা, জলাবদ্ধতা, জরুরি সাড়া টিমের অভাব, জনসচেতনতার ঘাটতি, ইউটিলিটি লাইন দ্বারা ড্রেন-খালে প্রতিবন্ধকতা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ঘাটতি, পুকুর বা জলাশয়ের ধারে সুরক্ষা না থাকা, ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন, খালঘেঁষা অপ্রশস্ত গলিপথ।
সুপারিশ : চারস্তরের পরিকল্পনা
তদন্ত কমিটি এ ধরনের দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে তাৎক্ষণিক, স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথা বলেছে। তাৎক্ষণিক পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে, মনিটরিং বডি গঠন, কুইক রেসপন্স টিম গঠন, নিরাপত্তা বেষ্টনী স্থাপন ও খাল-নালা সংক্রান্ত প্রকল্প।
স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপে রয়েছে- নিরাপত্তা বিধানে প্রকল্প গ্রহণ করা, কঠিন বর্জ্য আটকানোর জন্য নালার সংযোগস্থলে নেট লাগানো, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় জনবল ও আধুনিক যন্ত্রপাতি ক্রয় করা, আইন ও নীতিমালার কার্যকর প্রয়োগ করা, নাগরিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে বলা হয়।
মধ্যমেয়াদি পদক্ষেপে বলা হয়েছে- খালকে জলপথ হিসেবে ব্যবহার, সিল্ট ট্র্যাপ নির্মাণ, ফুটপাতে ঢালাই স্ল্যাব বসানো এবং রাস্তার পাশের নালার গভীরতা বাড়ানো।
দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে- নগর সরকার গঠন, সমন্বিত নগর পরিকল্পনা, খাল ও রাস্তার পুনঃনকশা, খাল সার্ভে, সড়ক আলোকায়ন, পাহাড় কাটা বন্ধ, কালভার্ট উঁচু করা এবং ইউটিলিটি লাইন সরিয়ে নেওয়া।
তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও চসিক সচিব মো. আশরাফুল আমিন কালবেলাকে বলেন, আমরা মেয়রের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। কী কারণে এ মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে, তা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। পাশাপাশি ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা রোধে বাস্তবসম্মত সুপারিশ করা হয়েছে। যাতে বিভিন্ন ধরনের নকশাও করে দেওয়া হয়েছে।
মন্তব্য করুন