আতাউর রহমান, ব্রাহ্মণপাড়া (কুমিল্লা)
প্রকাশ : ১৮ আগস্ট ২০২৫, ০৩:০২ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

সুদিনের প্রত্যাশায় পৈতৃক পেশাতেই ঈশ্বরের ৭০ বছর

কাদামাটি দিয়ে মাটির নানারকম পণ্য তৈরি করছেন মৃৎশিল্পী ঈশ্বর চন্দ্র পাল। ছবি : কালবেলা
কাদামাটি দিয়ে মাটির নানারকম পণ্য তৈরি করছেন মৃৎশিল্পী ঈশ্বর চন্দ্র পাল। ছবি : কালবেলা

মৃৎশিল্প বাঙালি সংস্কৃতির একটি অন্যতম ঐতিহ্য। একসময় বাঙালির দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল মাটির তৈরি তৈজসপত্র বা মৃৎশিল্প। তবে সময়ের পরিক্রমায় এবং আধুনিক পণ্য প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়াম, স্টিল, কাচ ও সিরামিক পণ্যের সহজলভ্যতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাঙালি সংস্কৃতির এই ঐতিহ্য প্রায় বিলুপ্তির পথে। তবে পিছিয়ে পড়া এই ঐতিহ্যে সুদিন ফিরবে—এ প্রত্যাশায় পৈতৃক পেশাকেই আঁকড়ে ধরে আছেন ৭০ বছর বয়সী কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ার ঈশ্বর চন্দ্র পাল। তিনি কাদামাটি পুড়িয়ে মাটির তৈজসপত্র তৈরি করে যাচ্ছেন। ধরে রেখেছেন মৃৎশিল্পের ঐতিহ্য।

মৃৎশিল্পী ঈশ্বর চন্দ্র পাল উপজেলার মাধবপুর ইউনিয়নের ষাইটশালা গ্রামের পালপাড়া এলাকার মৃৎশিল্পী মৃত কুলক চন্দ্র পালের ছেলে। পৈতৃক পেশা হিসেবে এই পেশায় তিনি নিয়োজিত হয়েছিলেন কিশোর বয়স থেকেই। সেই থেকে চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এখনো এ পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন তিনি। এ পেশা ভাটার দিকে ধাবিত হওয়ায় তার সঙ্গে সে সময় এ পেশায় জড়িত হওয়া অনেকেই বেছে নিয়েছেন ভিন্ন পেশা। তবে এ পেশায় একদিন সুদিন ফিরে আসবে এমন প্রত্যাশা তার। তাই তিনি পৈতৃক এই পেশাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন বৃদ্ধ বয়সেও।

সরেজমিন উপজেলার মাধবপুর ইউনিয়নের ষাইটশালা গ্রামের পালপাড়া এলাকায় দেখা গেছে, কাদামাটি দিয়ে মাটির নানারকম জিনিসপত্র তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন মৃৎশিল্পের কারিগর ঈশ্বর চন্দ্র পাল। সাধারণত তিনি কাদামাটি দিয়ে তৈরি করছেন রান্নাবান্নার ও গৃহসজ্জার কাজে ব্যবহৃত নানারকম সরঞ্জাম। এসব সরঞ্জামের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন আকারের মাটির হাঁড়ি-পাতিলা, ঢাকনা, থালা-বাসন, তাওয়া, মালসা, কলস, ফুলদানি, শোপিস ও শিশুদের নানারকম খেলনা সামগ্রী।

মৃৎশিল্পী ঈশ্বর চন্দ্র পাল জানান, ভাটা পড়া এই পেশায়ও একসময় জোয়ার ছিল। তার পূর্বপুরুষদের সময়ে মাটির তৈরি সামগ্রীর ব্যাপক চাহিদা ছিল। সে সময় মাটির এসব সামগ্রী তৈরি করতে দিন-রাত পরিশ্রম করতেন পরিবারের সদস্যরা। পরে এসব পণ্য রোদে শুকিয়ে ও আগুনে পুড়িয়ে বিক্রয় উপযোগী করে তোলা হতো। সে সময় এতটাই ব্যস্ততা ছিল যে, কাজের চাপে দম ফেলার ফুরসত ছিল না কারিগরদের।

তিনি জানান, সে সময় বড় বড় পাইকার বাড়িতে এসে এসব তৈজসপত্র কিনে নিয়ে যেত। তখন মাটির পণ্য তৈরির কাঁচামালও সহজলভ্য ছিল। বিক্রি বেশি হতো বলে তখন তাদের লাভও হতো বেশি। তবে দিনদিন আধুনিক সরঞ্জাম সহজলভ্য হওয়ায় মাটির তৈরি জিনিসপত্রের চাহিদা হ্রাস পেতে শুরু করে। মৃৎশিল্পে ক্রান্তিকাল দেখা দিলে অভাব-অনটনের কারণে অধিকাংশ মৃৎশিল্পের কারিগর পেশা বদলালেও তিনি বংশপরম্পরায় পাওয়া পেশা ছেড়ে যাননি। তিনি বিশ্বাস করেন আদিকাল থেকে মানুষের প্রয়োজন মেটানো শিল্পটি একেবারেই বিলুপ্ত হবে না। তবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও বেসরকারি সহযোগিতা পেলে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পটি আবার ঘুরে দাঁড়াবে বলে মনে করেন তিনি।

তিনি আরও জানান, একে তো আধুনিক সরঞ্জামের যুগে বর্তমানে মাটির পণ্যের চাহিদা কম। এ ছাড়া মাটির তৈরি জিনিস বানানোর জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালেরও সংকট। একসময় মাটির জিনিস তৈরির প্রয়োজনীয় কাঁচামাল (মাটি) বিনামূল্যে পাওয়া যেত। তবে বর্তমানে এ শিল্পের কাঁচামাল অতিরিক্ত টাকায়ও সবসময় পাওয়া যায় না। মাটির পণ্য আগুনে পোড়াতে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা লাকড়ির দামও বেশি। যার কারণে মাটির জিনিসপত্র তৈরির ব্যয়ও বেড়েছে। এতে এ পেশায় এখন টিকে থাকা কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে এ শিল্পের অধিকাংশ কারিগরই ভিন্ন পেশায় জড়াচ্ছেন।

মৃৎশিল্পী ঈশ্বর চন্দ্র পাল বলেন, আধুনিক যুগের আধুনিক সরঞ্জামের প্রসারে আমাদের তৈরি মাটির পণ্য এখন অবহেলিত। আমি আমার বাবার হাত ধরে কিশোর বয়সে এ পেশায় এসেছি। আমার সময়ে আমার মতো আরও অনেকে এ পেশায় জড়িয়ে ছিল। তবে এ পেশায় সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে যাওয়ায় তারা অন্য পেশায় চলে গেছে। তবে আমি এখনো পৈতৃক এই পেশা আঁকড়ে ধরে আছি সুদিনের আশায়।

তিনি আরও বলেন, এই পেশায় এলাকার ৪০০টির বেশি পরিবার একসময় কাজ করত। তবে এখন এই পেশায় ৪০টি পরিবার অনিয়মিতভাবে কাজ করছে। আমাদের সন্তানরাও এ পেশায় আসতে চাচ্ছে না। এ পেশার উপার্জন দিয়ে এখন আর সংসার চালানো যায় না। পৈতৃক এই পেশায় আকাল দেখা দেওয়ায় পেশা বদল করেছেন অধিকাংশ কারিগর। ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে ও নতুন প্রজন্মের মধ্যে এই শিল্পটি তুলে ধরতে সরকারের কাছে সহযোগিতার আবেদন জানান এই প্রবীণ এই মৃৎশিল্পী।

এদিকে মাটির হাঁড়িতে রান্না এবং মাটির পাত্রে খাবার খাওয়ার উপকারিতার কথা উল্লেখ করে চিকিৎসকরা জানান, মাটির তৈরি হাঁড়িতে রান্না করা খাবারের স্বাদ অক্ষুণ্ণ থাকে। মাটির পাত্রের রান্না স্বাস্থ্যকর ও হজমে সাহায্য করে। এ ছাড়া মাটির পাত্র ব্যবহারে আরও নানা স্বাস্থ্য উপকারিতার কারণে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকিও অনেকাংশে কমে আসে। তা ছাড়া মাটির পাত্র পরিবেশবান্ধব। অথচ প্লাস্টিক, মেলামাইনসহ আরও কিছু পাত্রে খাবার রান্না ও খাওয়ায় স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্ভাবনার রয়েছে যা চিকিৎসাবিজ্ঞান ইতোমধ্যে প্রমাণ করেছে।

কথা হয় ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহমুদা জাহানের সঙ্গে। তিনি কালবেলাকে বলেন, বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে মৃৎশিল্প ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। তবে আধুনিক সময়ে এসে বাজার দখল করা আধুনিক সরঞ্জামের ভিড়ে এ শিল্পটি পিছিয়ে পড়েছে। তবে এই শিল্পের প্রসারে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মিউজিক সিস্টেমে বোমা লুকিয়ে প্রেমিকার স্বামীকে হত্যার ফাঁদ

ফরিদপুরে ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতাদের ওপর হামলা

সাতক্ষীরায় প্রায় ১০ লাখ টাকার ভারতীয় মালামাল জব্দ

বরিশালে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিলেন চিকিৎসকরা

নেইমারকে উদ্দেশ্য করে স্লোগান, ব্রাজিলিয়ান ক্লাবকে বড় অঙ্কের জরিমানা

দেশে প্রথমবারের মতো বৈশ্বিক চাকরি মেলার আয়োজন করতে যাচ্ছে এটিবি জবস

নকল ওষুধ বিক্রি করায় লাজফার্মাকে জরিমানা

পুলিশের পোশাক পরে চাঁদা আদায় করতে গিয়ে ধরা, অতঃপর...

নরসিংদীতে শীর্ষ সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার, অস্ত্র-মাদক ও গানপাউডার উদ্ধার

উমামা ফাতেমার নেতৃত্বে হচ্ছে প্যানেল

১০

গৃহযুদ্ধের মাঝেই মিয়ানমারে নির্বাচন, কী চাইছে জান্তা?

১১

‘গুঞ্জন নিয়ে আমি কম পরোয়া করি’ তিশার সাফ জবাব

১২

‘অদৃশ্য শিক্ষক’- নেই ক্লাসরুমে, আছেন বেতনের খাতায়

১৩

ডাকসু নির্বাচন / শিবিরের প্যানেলে জায়গা পেয়ে সর্ব মিত্র চাকমার স্ট্যাটাস

১৪

সাবধান, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খালি হতে পারে এক কলেই

১৫

আল্লাহ আমাকে এই দেশের অভিভাবক বানিয়েছেন : আসিম মুনির

১৬

খুলনায় কৃষি ব্যাংক লুটের ঘটনায় মূলহোতা গ্রেপ্তার

১৭

নায়িকাদের জীবন নিয়ে পর্দায় রুনা খান

১৮

মাত্র ৩০ বছরেই থেমে গেল জনপ্রিয় মডেলের জীবন

১৯

সুযোগ-সুবিধাসহ চাকরি ফেরত পাচ্ছেন সেই ৮৫ নির্বাচন কর্মকর্তা

২০
X