চায়ের রাজধানীখ্যাত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত উপজেলা শহর শ্রীমঙ্গল। ঢাকা থেকে ১৮০ কিলোমিটার দূরত্বের এই শহরে দেশ-বিদেশের ভ্রমণপিপাসুদের স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে আসা পর্যটকদের পদচারণা এখন সারা বছরজুড়েই। প্রকৃতিনির্ভর চিরহরিৎ অরণ্য লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্ক, যে পার্কে রয়েছে বিস্তর গাছগাছালি জীববৈচিত্র্য ও পাখিদের কলতান।
এই সবুজ গালিচা বিছানো উঁচু-নিচু নান্দনিক চা বাগান ঘেরা শহর থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার দূরত্বের ছোট্ট একটি গ্রাম রাধানগর। বছরজুড়ে এখানে আসেন দেশি-বিদেশি পর্যটকরা। পাখির চোখে দেখলে রাধানগর গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যে কাউকেই বিমোহিত করবে এবং গ্রামটিকে মনে হবে এক শ্যামল সংরক্ষিত বনভূমি। যে গ্রামের বাঁকে-বাঁকে গড়ে উঠেছে আধুনিক নানা রিসোর্ট ও কটেজ।
একসময় যেখানে নিস্তব্ধতা আর প্রাকৃতিক শোভা ছিল প্রধান আকর্ষণ, আজ সেখানে পর্যটনের ছোঁয়াতে বদলে গেছে গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রার মান। আধুনিকতার ছোঁয়ায় বদলে যাওয়া এই গ্রাম এখন পর্যটকদের কাছে এক আকর্ষণীয় গন্তব্য। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টায় জেগে থাকে এই গ্রাম। প্রতিদিন অন্তত ৫ শতাধিক পর্যটক এই গ্রামে গড়ে উঠা অসংখ্য রিসোর্ট- কটেজে রাত্রিযাপন করেন।
একটি মাত্র গ্রামে এখন পাঁচতারকা মানের রিসোর্টসহ ৫০টিরও অধিক রিসোর্ট, কটেজ, হোটেল ও গেস্ট হাউস তৈরি হয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, কবি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা এই গ্রামে রাত্রিযাপন করতে এসে এই গ্রামের সৌন্দর্যের প্রেমে পড়ে যান। নিজেরাই গড়ে তুলেছেন এক একটি নান্দনিক কটেজ ও রিসোর্ট, যেখানে কর্মসংস্থান হয়েছে এই গ্রামের এবং আশপাশের ৫ শতাধিক মানুষের। এখানে কেউ রিসোর্ট দিয়েছেন, কেউ দিয়েছেন রেস্তোরাঁ, আবার কেউবা পর্যটকদের জন্য পরিবহনের কাজ করছেন।
কিন্তু রাধানগরের এই রূপান্তর এক দিনে ঘটেনি, একসময় এই গ্রাম ছিল কৃষিনির্ভর। স্বাধীনতার পর এখানে আখচাষের প্রচলন হয়, যা শ্রমজীবী মানুষের এক বৃহৎ অংশকে টেনে আনে। ক্রমে আখচাষের স্থান দখল করে লেবু ও কাঁঠালের বাগান। সময়ের পরিক্রমায় এই গ্রাম হয়ে ওঠে সুগন্ধি লেবুর এক সমৃদ্ধ ভূখণ্ড। এরপর, ২০০৯-১০ সালের দিকে পর্যটনের সম্ভাবনা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকে। লাউয়াছড়া বনের পাশে হওয়ায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এখানে ছিল মনোমুগ্ধকর। শ্রীমঙ্গলের আরেক অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য চা-বাগানকে ঘিরেও এখানে পর্যটকদের আনাগোনা বাড়তে থাকে, আর সেই সুযোগেই রাধানগর তার নিজের নতুন আত্মপরিচয় গড়ে তোলে।
রিসোর্টগুলোর স্থাপত্য ও পরিবেশবান্ধব নকশা রাধানগরকে দিয়েছে এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গড়ে ওঠা কাঠ ও বাঁশের কটেজগুলো পর্যটকদের আকৃষ্ট করছে। এখানে রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা শহুরে কোলাহল থেকে দূরে প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে থাকার এক দুর্লভ সুযোগ এনে দেয়।
রাধানগরের পর্যটন শিল্প শুধু এখানকার মানুষের জীবনে নয়, শ্রীমঙ্গল তথা পুরো মৌলভীবাজার জেলার অর্থনীতিতে এনেছে অভূতপূর্ব পরিবর্তন। প্রতিদিন শত শত পর্যটকের আনাগোনায় স্থানীয়দের জন্য সৃষ্টি হয়েছে নতুন কর্মসংস্থান। কেউ গাইড, কেউ গাড়িচালক, কেউ বা হস্তশিল্পের ব্যবসা করছেন। এখানকার রেস্টুরেন্টগুলোতে দেশি-বিদেশি মেন্যুর সমারোহ মিলছে, যা রাধানগরকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
পরিবেশবান্ধব পর্যটনের ক্ষেত্রে রাধানগর হয়ে উঠেছে দেশের অন্যতম রোল মডেল। এখানকার রিসোর্টগুলোতে প্ল্যাস্টিকমুক্ত ব্যবস্থা, স্থানীয় উপকরণ ব্যবহারের প্রবণতা এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে। চা-বাগানের ছায়ায় গড়ে ওঠা এই গ্রামে পর্যটকেরা যেমন প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন, তেমনি স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে যাওয়ার সুযোগও পান।
রাধানগর গ্রামের চামুং রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড ইকো ক্যাফের পরিচালক তাপস দাশ জানান, দেশে পর্যটন শিল্পের এখন অনেক সম্ভবনা রয়েছে। আমাদের রাধানগর গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে এখানকার পর্যটন শিল্প। প্রতিদিন শতাধিক পর্যটক এখানে ঘুরতে আসেন। সেইসঙ্গে রেস্টুরেন্টে খাবার খান, জিপগাড়ি নিয়ে ঘুরতে বের হন এবং রিসোর্টে রাত্রিযাপন করেন এতে করে সরকারও এখান থেকে বিপুল রাজস্ব পাচ্ছে।
শান্তিবাড়ি রিসোর্টের পরিচালক তানভীর লিংকন আহমেদ বলেন, রাধানগর গ্রামে পরিবেশবান্ধব পর্যটনশিল্প কেন্দ্র গড়ে তুলতে আমি ২০১২ সালে এই শান্তিবাড়ি ইকো রিসোর্ট তৈরি করি এবং তারপর থেকে আমাদের এখানে দেশ-বিদেশের অসংখ্য প্রকৃতিপ্রেমিক পর্যটক রাত্রি যাপন করেন। এখন অসংখ্য পরিবেশবান্ধব রিসোর্ট তৈরি হয়েছে। এতে করে পর্যটকরা যেমন পরিবেশবান্ধব পর্যটন সম্পর্কে অবগত হচ্ছেন তেমনি কর্মসংস্থান তৈরি করতেও সক্ষম হয়েছে এই রাধানগর গ্রাম।
শ্রীমঙ্গলের পর্যটন কল্যাণ পরিষদের সদস্যসচিব তারেকুর রহমান পাপ্পু কালবেলাকে বলেন, শ্রীমঙ্গল দেশের পর্যটন শিল্পের উজ্জ্বল এক সম্ভাবনা। আর তার হৃদয়স্থল রাধানগর। বিগত কয়েক বছরে এখানে কমিউনিটি বেসড ট্যুরিজম বিকশিত হয়েছে, যা স্থানীয় মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি ও নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
তিনি বলেন, সরকার আরও সুদৃষ্টি ও উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ নিলে এই এলাকা পর্যটনের আরও বৃহৎ কেন্দ্র হয়ে উঠবে। সুযোগ-সুবিধা বাড়লে পর্যটকের আগমনও বাড়বে, যা রাধানগরকে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার সুযোগ করে দেবে।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইসলাম উদ্দিন কালবেলাকে বলেন, শ্রীমঙ্গলের পর্যটন শিল্প বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। এখানে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের বিপুল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আমরা ইতোমধ্যেই রাধানগর এলাকায় রাত্রিকালীন সড়ক বাতির প্রকল্প গ্রহণ করেছি। যাতে পর্যটকদের স্বাভাবিক যাতায়াত বিঘ্নিত না হয় এবং জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে দৃষ্টিনন্দন ও পরিবেশবান্ধব পর্যটন শিল্প নিয়ে কাজ করছি। আশা করছি আগামীতে সরকারি বরাদ্দ পেলে শ্রীমঙ্গলের পর্যটন শিল্প উন্নয়নে আরও কাজের সুযোগ তৈরি হবে।
মন্তব্য করুন