লালমনিরহাট প্রতিনিধি
প্রকাশ : ২৪ অক্টোবর ২০২৫, ১২:৫৮ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

এই সীমান্তের ৭০ শতাংশ বাসিন্দা মাদক ও চোরাচালানে জড়িত 

লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ সীমান্ত। ছবি : সংগৃহীত
লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ সীমান্ত। ছবি : সংগৃহীত

লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার ভারত সীমান্তসংলগ্ন গোড়ল ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৪টি ওয়ার্ড সীমান্তঘেঁষা। আর ওই ৪টি ওয়ার্ডের ৭০ শতাংশ বাসিন্দাই মাদক ও বিভিন্ন চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছে।

এদিকে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন ওই এলাকাগুলো থেকে ব্যবসা ভেদে ১০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়মিত মাসোহারা আদায় করছে বলে অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসী। নিয়মিত মাসোহারা দেওয়া একাধিক মাদক মামলার আসামি জানান, ‘মাসোহারার টাকার ভাগ স্থানীয় গোড়ল পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ এসআই মোস্তাকিম ইসলামের হাত হয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তা ব্যক্তির পকেটে। আর মাসোয়ারার টাকা কালেকশন করেন ওই গোড়ল পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের কনস্টেবল ফারুক ইসলাম।’

এদিকে মাদক নিয়ন্ত্রণে ওই গোড়ল ইউনিয়নে ২০২১ সালে স্থাপন করা হয় পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র। আর মাদকপ্রবণ এলাকা হওয়ায় ওই তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ পদে কাউকে এক বছরের বেশি সময় রাখেন না পুলিশ বিভাগ। কিন্তু বর্তমান অভিযুক্ত ওই পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ এসআই মোস্তাকিম ইসলামের ওই কর্মস্থানে এক বছর পেরিয়ে গেছে। এতে তার সঙ্গে স্থানীয় মাদক ও চোরাচালানকারীদের সখ্য গড়ে উঠছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।

জানা গেছে, ওই গোড়ল ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের লোহাকুচি সীমান্ত, ৫নং ওয়ার্ডের বালাটারী, ৪নং ওয়ার্ডের বগুড়াপাড়া, বলাইরহাট এবং ১নং ওয়ার্ডের বুড়িরহাট বাজার সীমান্তঘেঁষা এলাকা। এসব এলাকার ৭০ শতাংশ মানুষ মাদক ও চোরাচালানসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত। এসব অপরাধ তাদের নিত্যদিনের কাজ। দীর্ঘদিন থেকে পরিবারের প্রায় সবাই মিলে এসব কাজ করে তারা জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। তবে ওই এলাকার কিছুসংখ্যক মানুষ কৃষিকাজের সঙ্গেও জড়িত। আর সিংহ ভাগ মানুষ কেউ করেন মাদক বিক্রি, কেউ করেন মাদক বহন। আবার কেউ কেউ বিএসএফের গুলি উপেক্ষা করে কাঁটাতারের বেড়ার ওপর দিয়ে চরকি দিয়ে গরু পারাপার করেন, কেউ আবার স্বর্ণ পাচার, হুন্ডি ব্যবাসা এমনকি মানব পাচারের মতো বড় অপরাধের সঙ্গে জড়িত। আর এসব এলাকার যেসব বাসিন্দা মাদক ও চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত নয় তারা রয়েছেন কোণঠাসা। মুখ খুললেই বিপদ, জড়ানো হয় মাদক মামলায়। করা হয় হয়রানি। তাদের এলাকায় বসবাস করাই যেন কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। দিন দিন ওই এলাকাগুলো মাদককারবারিদের নিরাপদ আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি কালবেলার অনুসন্ধানে বেড়িয়ে এসেছে মাদক ও চোরাচালানের এসব নানা তথ্য।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এসব এলাকায় প্রতিদিনই বাড়ছে মাদকের প্রবণতা। জেলার বিভিন্ন এলাকাসহ রংপুর থেকে দিনে রাতে পুলিশের নাকের ডগার সামনে দিয়ে দলে দলে মোটরসাইকেল যোগে শত শত লোকজন এসে নির্ভয়ে মাদকসেবন করে চলে যাচ্ছেন। অভিযানে মাঝেমধ্যে কিছু মাদক উদ্ধার হলেও মূল ব্যবসায়ীরা থেকে যাচ্ছে অধরা।

তারা জানান, ওই এলাকার গোড়ল পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পুলিশ কর্মকর্তা ফারুক নামে এক পুলিশ কনস্টেবল এর মাধ্যমে মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা আদায় করে আসছে। পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পুলিশদের বিরুদ্ধে নিরপরাধ মানুষকে আটকে মাদক মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে মারধর করে চাঁদা আদায় করারও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ।

সম্প্রতি স্থানীয় সাইদুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি গোড়ল পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ এসআই মোস্তাকিম ইসলাম ও কনস্টেবল ফারুকের নাম উল্লেখ করে আদিতমারী থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন।

অভিযোগকারী সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘গত ৯ অক্টোবর রাত ১০টার দিকে ময়নারচওড়া বাজার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। এ সময় ইনচার্জ মোস্তাকিম ঘটনাস্থলে আসে। তার আগমনে মাঠের একপাশে বসা কয়েকজন ব্যক্তি সরে যায়। পরে ইনচার্জ এসে কিছু না বলেই আমাকে ধরে মারধর শুরু করে। এরপর কিছুটা দূরে নিয়ে টাকা দাবি করে। টাকা না দিলে মাদক দিয়ে চালান দেওয়ার হুমকি দেয়। ভয়ে আমি ২০ হাজার টাকা দেই।’

সাইদুলের অভিযোগের বিষয়ে জানতে সরেজমিন কথা হয় স্থানীয় ব্যবসায়ী ও বাসিন্দাদের সঙ্গে। এ বিষয়ে ময়নারচওড়া বাজারের মুদি দোকান ব্যবসায়ী মহরম আলী (৫০) কালবেলাকে বলেন, ‘সেদিন রাতে পুলিশের গাড়ি আসার কিছুক্ষণ পরই মারধরের শব্দ শুনেছি। কয়েকজন সরে গিয়েছিল। পরে জানতে পারি সাইদুলকে পুলিশ মারধর করেছে।’

স্থানীয় বাজারের রাইসমিল গোডাউন ব্যবসায়ী আব্দুল জলিল (৪৫) বলেন, ‘সেদিন কয়েকজন মাঠের একপাশে লুডু খেলছিল। পুলিশ আসতেই তারা পালিয়ে যায়। এরপরই সাইদুলকে ধরে পুলিশ এবং মারধর করে।’

এ সময় গোড়ল ইউনিয়নের মালগাড়া গ্রামের এক মাদ্রাসাশিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘সম্প্রতি বগুড়াপাড়া ব্রিজের পশ্চিমে তৌহিদুল নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে অভিযান চালায় পুলিশ। বাড়িঘর তন্নতন্ন করে খুঁজে কিছু পায়নি যা স্থানীয় অনেকেই দেখেছেন। পরে তার বাড়ির উত্তরে নদীপাড় থেকে বিপুল পরিমাণ গাঁজা উদ্ধার করে পুলিশ। ওই মাদকের কিছু তৌহিদুলের বাড়ি থেকে পাওয়া গেছে দাবি করে পুলিশ এবং তার নামে মামলা দেয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘গোড়ল পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের কতিপয় পুলিশ সদস্যের সঙ্গে মাদক কারবারিদের গড়ে উঠছে সখ্য। প্রায়ই মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে চায়ের আড্ডায় দেখা যায় এসব অসাধু পুলিশ সদস্যদের। সীমান্ত এলাকা হওয়ায় মাদক ব্যবসায়ীরা শক্তিশালী ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী। এখানে কেউ কিছু বলতে চায় না। কিছু বললেই বিপদে পড়তে হয়।’

মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা এবং নিরীহ মানুষকে ধরে নির্যাতন ও মাদক মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে চাঁদা আদায়ের অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে ওই গোড়ল পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ এসআই মোস্তাকিম ইসলামের বিরুদ্ধে। তবে নিয়মিত মাসোহারা দেওয়া একাধিক মামলার আসামি মাদক ব্যবসায়ী জানান, ‘মাসোহারার টাকা শুধু ইনচার্জ এসআই মোস্তাকিম ইসলামের পকেটে নয়, এই টাকার ভাগ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তা ব্যক্তির পকেটেও চলে যায়।’

অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে গোড়ল পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ এসআই মোস্তাকিম ইসলাম সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমাকে মাদক ব্যবসায়ীরা সহ্য করতে পারছে না। আমি যোগদানের আগে ময়নারচওড়া এলাকায় মাদক বেশি ছিল, এখন কমে এসেছে। মাদক ব্যবসায়ীরা আমাকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করছে।’

এ বিষয়ে লালমনিরহাটের পুলিশ সুপার (এসপি) তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘গোড়ল ও চন্দ্রপুর ইউনিয়নে ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ কোনো না কোনোভাবে মাদক ও চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত। বিষয়টি পুলিশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।’

তিনি আরও বলেন, ‘গোড়ল তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। নিরীহ কাউকে হয়রানির সুযোগ নেই পুলিশের।’ মাদক নিয়ন্ত্রণে সামাজিক সচেতনতা কার্যক্রমও চলছে বলেও তিনি জানান।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

নির্বাচনে বিএনপি জিতলে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, জানালেন মির্জা ফখরুল

ডোবায় ভাসছিল মরদেহ

ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ৪৬৮

ভবদহে ৬টি নদী খনন কাজের উদ্বোধন

ভাইয়েরা মিলে কুপিয়ে মারল ভাইকে

সালমান হত্যার আসামিদের গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে যা জানাল পুলিশ

সাগরে লঘুচাপ, ঘূর্ণিঝড়ের সম্ভাবনা কতটুকু

উৎসবের আয়োজন করে মানুষ, অতিথি হয়ে আসে বাদুড়

৭ নেতার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করল বিএনপি

যেসব খাবারের সঙ্গে ডিম খাওয়া যায় না

১০

বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার, বিএনপিতে ফিরলেন ভালুকার বাচ্চু

১১

১০ লাখ টাকার হেরোইনসহ মাদক কারবারি গ্রেপ্তার

১২

ফোনে স্ত্রীর নাম ‘মটু’ দিয়ে সেভ করায় ডিভোর্স

১৩

পরীক্ষার খাতা দেখে পাস করাতে টাকা দাবি করেছিলেন শিক্ষক

১৪

স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে লালন স্মরণোৎসব ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’

১৫

দেশকে শেখ পরিবারের জমিদারি বানিয়েছিল হাসিনা : প্রেস সচিব

১৬

যুদ্ধোত্তর গাজা নিয়ে কায়রোয় হামাস-ফাতাহ বৈঠক

১৭

রোহিঙ্গাদের নতুন সংগঠনের আত্মপ্রকাশ 

১৮

সপ্তাহের সেরা চাকরির বিজ্ঞপ্তি, পদ সংখ্যা ৭৩৭

১৯

এবার কোক স্টুডিওতে তুহিনের গান

২০
X