

পাখির কিচিরমিচির আর সুরেলা কলতানে ভোর শুরু হয় রবিউল হাসান ওরফে ভুটান সরকারের পরিবারের। এই সুর দিনভর ভাসে বগুড়ার ধুনট উপজেলার যমুনা পাড়ের মাধবডাঙ্গা গ্রামে। চার একরজুড়ে বিস্তৃত এই নিরিবিলি চৌহদ্দিটি এখন সবার কাছে পরিচিত ‘পাখিবাড়ি’ নামে।
গ্রামের শত শত মানুষ প্রতিদিন উপভোগ করেন এখানে হাজারো পাখির ওড়াউড়ি আর কলতান। ভোর হতেই গাছের মগডাল কাঁপে পালকের ফড়ফড় আর হাওয়ার মৃদু ছোঁয়ায়। এমন এক প্রকৃতির সিম্ফনির মাঝে বসবাস করছেন ভুটান সরকার। তিনি এই বাড়িকে প্রকৃতির সঙ্গে এক নীরব চুক্তি হিসেবে মনে করেন।
তবে যোগাযোগ ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় পাখিবাড়িতে পৌঁছানো সহজ নয়। ভাঙা রাস্তা আর দুর্বল যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে অনেক দর্শনার্থীকেই মাঝপথ থেকে ফিরে যেতে হয়।
বাড়ির মালিক ভুটান সরকার বলেন, প্রায় ৩৫ বছর আগে এক বিকেলে প্রথম একঝাঁক পাখি এসে বসে ছিল বাড়ির তেঁতুলগাছে। সেদিন কেউ ভাবেনি সেটিই হবে এক দীর্ঘ বসবাসের সূচনা। এরপর প্রতি বছর গ্রীষ্মের শুরুতে পাখিরা দলবল নিয়ে আসে, বাসা বাঁধে, ছানা ফোটায়। বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত শেষে শীত এলেই তারা দলবেঁধে চলে যায়। আবার পরের বছর ফিরে আসে।
চার একরজুড়ে পাখিবাড়ির সামনে দুটি বড় পুকুর, পাড় ঘিরে মেহগনি, কড়ই, জাম, তেঁতুল, আম, কাঁঠালসহ নানা প্রজাতির গাছ। পেছনে ঘন বাঁশঝাড়। এই বাগান এখন হাজারো পাখির স্থায়ী আশ্রয়। প্রতিদিন ভোরে তারা উড়ে যায় খাবারের খোঁজে, দুপুর শেষে ফিরে আসে। সূর্য ঢলে পড়লে গাছের ডালজুড়ে শুরু হয় তাদের ডাকাডাকি, ছানাদের খাওয়ানো আর নীড় গড়ার ব্যস্ততা।
এখানে পানকৌড়ি, বক, ঘুঘু, শালিক, টিয়া, চড়ুই সবাই আছে নিজস্ব নীড়ে, নিজস্ব গাছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, পাখিদের গাছের নিচেই ভুটান সরকারের দুটি বড় আয়তনের পুকুর রয়েছে। সেখানে তিনি মাছ চাষ করেন। কিন্তু কোনো পাখিই তার পুকুরে কখনো মাছ ধরে না, বরং দূর নদী-খাল থেকে শিকার করে এনে ছানাদের খাওয়ায়।
স্থানীয়রা জানান, ভুটান সরকারের বাড়ির পাখিদের অন্য কোনো বাড়ির গাছে দেখা যায় না। এই পাখিবাড়িই যেন তাদের স্থায়ী নিবাস। বাড়ির লোকজনও পাখিদের আপন আত্মীয়র মতোই দেখে। প্রতিদিনই আসেন প্রকৃতিপ্রেমীরা— কেউ ছবি তুলতে, কেউ কবিতা লিখতে, কেউ বা শুধু প্রকৃতির এই মায়াবী সঙ্গ অনুভব করতে।
ফজলুল করিম নামে এক দর্শনার্থী বলেন, ‘সবুজ পাতার ভেতর পাখির ওড়াউড়ি আর বিচিত্র শব্দ শুনে হৃদয়টাই হালকা হয়ে যায়। এমন দৃশ্য শহরে দেখাই যায় না।’
স্থানীয় প্রকৃতিপ্রেমী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘এটি এখন শুধু একটি বাড়ি নয়, পরিবেশ সচেতনতার জীবন্ত প্রতীক। অনেক স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা এখানে আসে— কেউ ছবি আঁকে, কেউ কবিতা লেখে। যেন এক জীবন্ত পরিবেশ শিক্ষাকেন্দ্র।’
সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আতিকুর করিম আপেল বলেন, ধুনট উপজেলার সবচেয়ে সুন্দর জায়গা ভুটান সরকারের বাড়ি। পাখিরা এখানে নিরাপদ আশ্রয় পায় বলেই এটি অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। তবে সরকারিভাবে পাখিদের সংরক্ষণের উদ্যোগ নিলে প্রকৃতি আরও সুন্দর হবে। পাখিদের টিকিয়ে রাখতে সরকারি উদ্যোগ জরুরি।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তীরের সভাপতি আশামনি বলেন, সরকার যদি এলাকাটিকে পাখির অভয়ারণ্য ঘোষণা করে এবং নতুন গাছ রোপণসহ সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়, তাহলে এই সৌন্দর্য বহু বছর টিকে থাকবে। পাখি বাঁচলে প্রকৃতি বাঁচবে, আর প্রকৃতি বাঁচলেই মানুষ টিকবে।
মন্তব্য করুন