আবুল হাসনাত, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৭:০৭ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
খাতুনগঞ্জে বেচাকেনায় ধস

দেশের ভোগ্যপণ্যের নিয়ন্ত্রণ কী হাতছাড়া হচ্ছে চট্টগ্রামের?

চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের দৃশ্য। ছবি : কালবেলা
চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের দৃশ্য। ছবি : কালবেলা

চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ যে বাজারকে দীর্ঘদিন ধরে দেশের ভোগ্যপণ্যের ‘নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র’ বলা হতো সেই বাজারেই এখন অস্বাভাবিক নীরবতা। একসময় যেখানে দিনের আলো ফোটার আগেই শুরু হতো পণ্যবাহী পরিবহনের চাপ, শ্রমিকদের হাঁকডাক আর দরদামের উত্তেজনা, সেখানে এখন ব্যস্ত কর্মদিবসেও স্বস্তির চলাচল। বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, এই স্বস্তি শক্তিশালী বাজারের লক্ষণ নয়; বরং ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়া এক বাণিজ্যকেন্দ্রের স্পষ্ট ইঙ্গিত।

সরেজমিনে দেখা গেছে, খাতুনগঞ্জের প্রধান সড়ক, আড়তপট্টি ও সংযুক্ত বাজার এলাকায় আগের মতো যানজট নেই। কয়েক বছর আগেও যেখানে পণ্যবাহী ট্রাকের দীর্ঘ সারিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকত যানবাহন, সেখানে এখন স্বাভাবিক গতিতে চলাচল হচ্ছে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই পরিবর্তন কোনো অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফল নয়; এটি সরাসরি বেচাকেনা কমে যাওয়ার প্রতিফলন।

খাতুনগঞ্জের আড়তদার আহমেদুর রহমান জানান, পণ্যের আমদানি বন্ধ হয়নি। ভোজ্যতেল, চিনি, ডাল, গমসহ প্রধান নিত্যপণ্যের সরবরাহ নিয়মিত আসছে। তবে সেই পণ্যের গন্তব্য বদলে গেছে। আগের মতো খাতুনগঞ্জকেন্দ্রিক হয়ে সারাদেশে পণ্য ছড়িয়ে পড়ছে না। অনেক ক্ষেত্রেই পণ্য বন্দরে খালাসের পর খাতুনগঞ্জে না এসে সরাসরি অন্য অঞ্চলে চলে যাচ্ছে।

প্রবীণ ব্যবসায়ী সঞ্জয় চক্রবর্তী বলেন, ‘আমদানি আছে, গুদাম ভরা, কিন্তু বিক্রি নেই। আগে দিনে তিন চার ট্রাক পণ্য বের হতো, এখন এক ট্রাক বের করাও কষ্টকর। পণ্য পড়ে থাকায় পুঁজি আটকে যাচ্ছে, ব্যাংকের সুদ বাড়ছে, কিন্তু বাজার ঘুরছে না।’

ব্যবসায়ীদের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালে এসে খাতুনগঞ্জের সামগ্রিক বেচাকেনা কমেছে অন্তত ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ। অথচ দেশের সামগ্রিক ভোগ্যপণ্যের বাজার কমেনি; বরং জনসংখ্যা ও চাহিদা বাড়ার কারণে বাজারের আকার বেড়েছে। এই বৈপরীত্যই নতুন করে প্রশ্ন তুলছে খাতুনগঞ্জ কী তার ঐতিহ্যগত নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে?

খুচরা ব্যবসায়ীরা এখন বড় অর্ডার দিতে আগ্রহী নন। দামের অস্থিরতা, বাজারের অনিশ্চয়তা ও বিক্রির ধীরগতির কারণে তারা প্রয়োজন অনুযায়ী অল্প অল্প করে পণ্য নিচ্ছেন। এতে পাইকারি ব্যবসার গতি আরও মন্থর হয়ে পড়েছে।

খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, একসময় দেশের মোট ভোগ্যপণ্যের আমদানির বড় একটি অংশ খাতুনগঞ্জকেন্দ্রিক ছিল। তখন এই বাজার থেকেই সারাদেশের দাম ও সরবরাহের গতি নির্ধারিত হতো। এখন সেই প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এসেছে। আগে যেখানে আমদানির প্রায় ৪০ শতাংশের ওপর খাতুনগঞ্জের প্রভাব ছিল, বর্তমানে তা নেমে এসেছে প্রায় ২০ শতাংশেরও বেশি।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের হিসাব বিশ্লেষণ করলেও একই চিত্র উঠে আসে। প্রধান ৬টি নিত্যপণ্যের আমদানিতে চট্টগ্রামের অংশীদারি গত দুই দশকে প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। অথচ একই সময়ে দেশের ভোগ্যপণ্যের বাজার বহুগুণ বিস্তৃত হয়েছে। অর্থাৎ বাজার বড় হলেও খাতুনগঞ্জ সেই প্রবৃদ্ধির সুফল পাচ্ছে না।

ব্যবসায়ীদের বড় অভিযোগ চট্টগ্রাম-ঢাকা মহাসড়কের ওজন স্কেল ব্যবস্থা ও পরিবহন বৈষম্য নিয়ে। তাদের দাবি, এই ব্যবস্থার কারণে চট্টগ্রামভিত্তিক আমদানিকারকরা নিয়মিত বাড়তি খরচ ও হয়রানির মুখে পড়ছেন। আড়তদারের ভাষায়, ঢাকার ব্যবসায়ীরা তুলনামূলক কম খরচে একই পণ্য পরিবহন করতে পারলেও চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে ওজন স্কেল, জরিমানা ও কাগজপত্রের জটিলতা নিত্যদিনের বিষয়।

এর ফলে বড় শিল্প গ্রুপগুলো চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করলেও পণ্য আর খাতুনগঞ্জে আনছে না। সূত্র জানায়, বহির্নোঙরে খালাস করা পণ্য অনেক ক্ষেত্রে ছোট জাহাজে বা সরাসরি পরিবহনে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ কিংবা দেশের অন্যান্য বড় ভোক্তা অঞ্চলে পাঠানো হচ্ছে। এতে খাতুনগঞ্জ ধীরে ধীরে তার ঐতিহ্যবাহী ট্রানজিট ভূমিকা হারাচ্ছে।

একসময় বন্দরে নামা পণ্য সরাসরি খাতুনগঞ্জে আসত। এখান থেকে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ত ভোগ্যপণ্য। সেই চেইন এখন ভেঙে গেছে। পাশাপাশি স্থলবন্দরকেন্দ্রিক আমদানিও খাতুনগঞ্জের গুরুত্ব কমিয়ে দিয়েছে। হিলি, বেনাপোল কিংবা টেকনাফ দিয়ে আসা অনেক পণ্য এখন সরাসরি জেলা বা উপজেলা বাজারে চলে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম শহর আর সেই কেন্দ্রবিন্দুতে নেই।

এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে বাজারে আর্থিক অনিশ্চয়তাও বেড়েছে। বাজার–সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কিছু বড় ব্যবসায়ী নির্দিষ্ট কয়েকটি ব্যাংকের চেক নিতে অনীহা প্রকাশ করছেন। চেক নগদায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ায় লেনদেনে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।

বাজার-সংশ্লিষ্টদের মতে, একটি বড় শিল্পগোষ্ঠী সক্রিয় থাকাকালে চট্টগ্রামের ভোগ্যপণ্যের বাজারে এক ধরনের অঘোষিত ভারসাম্য বজায় ছিল। তাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ থাকলেও বাজারে পণ্যের সরবরাহ সচল থাকত এবং বড় ধরনের সংকট দেখা দিত না। এখন সেই প্রভাব দুর্বল হয়ে পড়ায় অন্য মিলার ও সরবরাহকারীরা সুযোগ নিচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে দামে।

একাধিক ব্যবসায়ী মনে করছেন, এই সংকট কেবল অর্থনৈতিক নয়,এর সঙ্গে রাজনৈতিক ও নীতিগত অস্থিরতাও জড়িত। আগের শাসনামলে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বলয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যবসায়ীদের খাতুনগঞ্জে বড় ধরনের প্রভাব ছিল। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সেই কাঠামো ভেঙে পড়ায় অনেক ব্যবসায়ী দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। কেউ কেউ ঋণসংকট ও আর্থিক চাপে দেউলিয়া হয়ে গেছেন।

চট্টগ্রামের ১১ জেলার পণ্য একসময় খাতুনগঞ্জেই কেনাবেচা হতো। সময়ের পরিবর্তনে এখন জেলায় জেলায় বড় মোকাম গড়ে উঠেছে, তৈরি হয়েছে নতুন আমদানিকারক। ফলে অনেক জেলার খুচরা ব্যবসায়ী আর খাতুনগঞ্জমুখী হচ্ছেন না।

চট্টগ্রাম চেম্বার সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, লাইসেন্সভিত্তিক আমদানির যুগ শেষ হওয়ার পর ব্যবসা বিকেন্দ্রীকরণ হওয়া স্বাভাবিক ছিল। তবে খাতুনগঞ্জ সেই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে আধুনিক করতে পারেনি। অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, সংকীর্ণ সড়ক, আধুনিক গুদাম ও লজিস্টিক সুবিধার অভাব বাজারটিকে ধীরে ধীরে পিছিয়ে দিচ্ছে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বারডেমে বহির্বিভাগ মেডিসিন ফার্মেসি, স্বল্পমূল্যে মানসম্মত ওষুধের প্রতিশ্রুতি

খুলনায় দুর্বৃত্তদের গু‌লিতে যুবক নিহত

‘গণতান্ত্রিক উত্তরণের লড়াই বারবার হোঁচট খাচ্ছে’  

দেশের ক্রান্তিকাল কাটাতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফেরার আহ্বান সালামের

এলাকার উন্নয়নে ঐক্যের আহ্বান হাবিবুর রশিদ হাবিবের

তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনে সকল অপশক্তি পরাস্ত হবে : ইশরাক

পেশাজীবীদের সর্বাত্মক সহযোগিতো চাইলেন তারেক রহমান

দাপুটে জয়ে সিরিজে ২–১ ব্যবধানে এগিয়ে গেল ভারত

‌‘আমাকে শোরুমে নিয়ে যান, সব সত্য বেরিয়ে আসবে’

ওসমান হাদিকে গুলি : সন্দেহভাজন ফয়সলের স্ত্রীসহ আটক ৩

১০

ইসলামিক রিয়ালিটি শো ‘পুষ্টি ভার্সেস অফ লাইট- সিজন ২’ এর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা 

১১

লন্ডনে তারেক রহমানের জনসভা ১৬ ডিসেম্বর

১২

আইপিএলের মক নিলামে ৭৫ লাখ রুপিতে দল পেলেন তানজিম সাকিব

১৩

রোগী দেখার সময় চিকিৎসকের গেম খেলা, তদন্তে হাসপাতালে দুদক

১৪

চাঁদপুরে ২ জনের মরদেহ উদ্ধার

১৫

সেন্টমার্টিন যাত্রায় সক্রিয় জালিয়াতি চক্র, টিকিট যেন সোনার হরিণ

১৬

শান্তিরক্ষী মিশনে সুদানে ড্রোন হামলায় আহত ঘিওরের চুমকি

১৭

ছাত্ররাই হানাদার-স্বৈরাচারের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করেছে : হান্নান মাসউদ

১৮

চট্টগ্রামে ছয় প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা, বেকারি বন্ধ

১৯

নবনির্মিত নতুন ভবনে সিএমপি কমিশনার, উদ্বোধন

২০
X