মো. শাহাদাতের বয়স ১০ বছর। কিন্তু তার অবয়বে প্রথম দেখায় ৬০ বছর বয়সী বৃদ্ধ বলে মনে হবে। জন্মের চার মাস পর থেকে প্রোজিরিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে মিরসরাই উপজেলার ওয়াহেদপুর ইউনিয়নের মো. হানিফ ও নাছিমা আক্তারে ছেলে মো. শাহাদাতের এ হাল। শাহাদাত তিন ভাইবোনের সবার ছোট। স্থানীয় মির্জাবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র সে।
শাহাদাতের সহপাঠী শিশুরা যখন খেলায় ব্যস্ত, তখন ঘরের মধ্যে বন্দিজীবন কাটাচ্ছে সে। অন্য শিশুরা তাকে খেলতে নিতে চায় না। অনেকেই মা-বাবার শেখানো কুসংস্কারে শাহাদাতের সঙ্গ এড়িয়ে চলে। কেউ বা রোগের জন্য তিরস্কার করে শিশুটিকেই। এ পরিস্থিতিতে দিন যতই গড়াচ্ছে ততই ছেলেকে নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে মা-বাবার। অপরদিকে প্রাসঙ্গিক শারীরিক জটিলতায় স্বাভাবিক জীবন থেকে বঞ্চিত হয়ে দুঃসহ জীবনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে শাহাদাত।
জানা গেছে, জন্মের চার মাস পর থেকে হঠাৎ সে প্রোজিরিয়া রোগে আক্রান্ত হয়। তখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ১ মাস ১৪ দিন চিকিৎসা নিয়েছে। চিকিৎসার পরও কোনো উন্নতি হয়নি। চিকিৎসক জানিয়েছেন এ রোগের চিকিৎসা বাংলাদেশে নেই। ১ মাস ১৪ দিন থাকার পর তারা গ্রামে চলে আসে।
দুই বছর পর তার শরীরে দেখা দেয় হার্নিয়া রোগ। এরপর অপারেশন করা হয়। তবে এখনো মাঝে মধ্যে ব্যথা অনুভব করে শাহাদাত। শাহাদাতের বাবা মো. হানিফ বলেন, ‘দুটি মেয়ের পর আমার একটি ছেলে সন্তান হয়। অনেক খুশি হয়েছি। কিন্তু কিছু দিন পর আমার একমাত্র ছেলের শরীরের রোগ দেখা দেয়। যখন তার এই রোগ দেখা দিয়েছে, তখন তাকে নিয়ে চমেক হাসপতালে ১ মাস ১৩ দিন ছিলাম। ডাক্তারের চিকিৎসা ফ্রি পেয়েছি, কিন্তু ওষুধ তো আর ফ্রিতে পাইনি। জায়গা-সম্পত্তি নাই যে বিক্রি করে ছেলের চিকিৎসা করাব। আমার ছেলেটা যদি একটু পরিবর্তন হয় তাহলে অন্যান্য শিশুদের সঙ্গে খেলা করতে পারত। তখন আমি মরে গেলেও শান্তি পেতাম।’
মো. হানিফ আরও বলেন, ‘সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি আমি। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালিয়ে সংসার এবং ছেলের চিকিৎসা খরচ চলছে। দৈনিক ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা আয় হয়। তার মধ্যে ২৫০ টাকা মালিককে দিয়ে দিতে হয়। স্ত্রী, ছেলেমেয়ে নিয়ে সওজের জায়গার ওপর ঘর তুলে কোনো রকম দিন কাটছে। তার এই রোগের কারণে অনেকে অনেক কথা বলে। তখন নিজের কাছে কষ্ট লাগে। কাউকে কিছু বলতে পারি না।’
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে ছোট্ট একটি ঘরে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বসবাস করছেন মো. হানিফ। ঘরের সামনে বড় বোনের সঙ্গে খেলা মেতেছে শাহাদাত। সব আচরণ শিশুসুলভ হলেও শরীর দেখে মনে হচ্ছে তার বয়স ৬০।
অসুস্থ মো. শাহাদাত বলে, ‘আমার স্কুলের স্যাররা আমাকে অনেক আদর করেন। কিন্তু আমার বন্ধুরা আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করে। আমার সঙ্গে কেউ খেলতে চায় না। আমি খেলতে গেলে তারা আমাকে দলে নেয় না। আমি সুস্থ হয়ে আমার বন্ধুদের সঙ্গে খেলা করতে চাই এবং পড়ালেখা করতে চাই।’
শাহাদাতের মা নাছিমা আক্তার কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘ছেলেটা জন্মের কিছু দিন পর বিরল রোগে আক্রান্ত হয়। তখন এলাকার মানুষজন থেকে টাকা-পয়সা তুলে চিকিৎসা করেছিলাম কিন্তু কোনো উন্নতি হয়নি। চিকিৎসক বলেছে, এ রোগের চিকিৎসা বাংলাদেশে নেই। তাকে সুস্থ করতে হলে বিদেশ নিয়ে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। ছেলেকে বিদেশ নিয়ে চিকিৎসা করানোর মতো কোনো সামর্থ্য নেই আমাদের।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার ছেলে শাহাদাতকে দেখলে অন্যান্য ছেলেরা ভয় পায়। তখন আমার ছেলে আমাকে বলে, আম্মু আমাকে দেখে সবাই ভয় পায় কেন? তখন আমি বলি, বাবারে আল্লাহ তোমাকে বানাইছে; সে আল্লাহর কাছে তোমাকে সুন্দর লাগছে। আমার কাছেও তোমাকে সুন্দর লাগছে।’
ওয়াহেদপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ফজলুল কবির ফিরোজ বলেন, ‘হানিফের জায়গা সম্পত্তি বলতে কিছু নেই। তারা খুবই গরিব। তার ছেলে শাহাদাতকে পরিষদ থেকে একটি প্রতিবন্ধী কার্ড করে দেওয়া হয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবেও তাকে সহযোগিতা করেছি।’
মিরসরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মিনহাজ উদ্দিন বলেন, ‘শিশুটির ছবি দেখে মনে হচ্ছে সে প্রোজিরিয়া রোগে আক্রান্ত। এটা জেনেটিক কারণে হয় এবং এ রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বিরল। শিশু বয়সে গায়ের চামড়া কুচকে যাওয়া, বৃদ্ধের মতো দেখতে এসব এ রোগের লক্ষণ। দ্রুত ঢাকার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।’
মন্তব্য করুন