সিলেটে অবরোধ, সংঘর্ষ, ভাঙচুরের মধ্য দিয়ে বিএনপির ডাকা হরতাল শেষ হয়েছে। হরতাল চলাকালে রোববার (২৯ অক্টোবর) সকাল ৮টার পর থেকে বিভিন্ন স্থানে পিকেটিং করে বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
পুলিশও নগরে বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে অবস্থান নিয়ে পিকেটারদের ছত্রভঙ্গ করে দিতে থাকে। দক্ষিণ সুরমায় সড়কে গাছ ফেলে অবরোধ, টায়ারে আগুন দিয়ে অবস্থান নেয় বিএনপির নেতাকর্মীরা। অপরদিকে হরতালের প্রতিবাদে নগরীর সুরমা পয়েন্টে শান্তি সমাবেশ করে আওয়ামী লীগ। মিছিল-শোডাউন দেয় হরতালের সমর্থক ও বিরোধী দুপক্ষই। নগরীতে ধাওয়-পাল্টা ধাওয়া হয় পুলিশ ও বিএনপির। এ সময় আহত হন ৮ পুলিশ সদস্য। হরতাল চলাকালে সাংবাদিকের মোটরসাইকেল ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
এদিকে হরতাল চলাকালে মহানগর বিএনপি নেতা আবদুল কাইয়ুম জালালী পংকীসহ বিএনপি-জামায়াতের আটজনকে আটক করেছে পুলিশ। নগরীর পাড়া-মহল্লায় দোকানপাট খোলা থাকলেও মার্কেট বিপণিবিতানগুলো বন্ধ ছিল। নগরীর সড়কে যানবাহনের সংখ্যা তুলনায় অনেক কম ছিল। চলেনি বাস-মিনিবাস।
হরতাল চলাকলে রোববার সকাল ১০টার দিকে সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের দক্ষিণ সুরমার লালাবাজারে গাছ ফেলে অবরোধ করে বিএনপি নেতাকর্মীরা। এতে নেতৃত্ব দেন জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক কোহিনূর আহমদ ও সহদপ্তর সম্পাদক মাহবুব আলম। একই সময়ে সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের দক্ষিণ সুরমার তেতলিতে টায়ারে আগুন দিয়ে বিক্ষোভ করে দক্ষিণ সুরমা উপজেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা।
সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কে যানবাহন ভাঙচুর করেছে পিকেটাররা। সকাল ৯টার দিকে মহানগরের লন্ডনি রোডের হাজিপাড়ার মুখ থেকে ৩০-৩৫ টি মোটরসাইকেলে করে বিএনপি নেতাকর্মীরা বের হয়ে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কে গিয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ ১০-১২টি গাড়িতে ভাঙচুর চালান। তাদের অনেকের হাতে ছিল লাঠি। ১৫-২০ মিনিট ভাঙচুর চালিয়ে তারা চলে যান। পরে, সিলেট মহানগরের জেলরোড পয়েন্টে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। সকাল সোয়া ৯টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।
জিন্দাবাজার এলাকায় পুলিশের সঙ্গে বিএনপি ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। রোববার সকাল পৌনে ১০টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। এসময় পুলিশের দিকে নেতাকর্মীরা ইট-পাটকেল ও তাদের দিকে পুলিশ রাবার বুলেট, টিয়ার সেল নিক্ষেপ করে। পুলিশ এসময় সাউন্ড গ্রেনেডও ফাটায়। এ সময় পুলিশের ৫ সদস্য আহত হন।
পিকেটিংকালে জামায়াত-বিএনপি ও তাদের অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের ৮ নেতাকর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। আটক নেতাকর্মীরা হলেন, মহানগর বিএনপির সাবেক আহবায়ক আব্দুল কাইয়ুম জালালী পংকী, সিলেট জেলা ছাত্রদলের সহসাংগঠনিক সম্পাদক জুয়েল আহমদ ও দক্ষিণ সুরমা উপজেলা যুবদল নেতা মোহাম্মদ আব্বাস, ইমরান আহমদ, আব্দুল্লাহ আল ফাহিম, ইমরান হোসেন, নাদিম আহমদ, ওয়াহেদুল ইসলাম শহিদ।
আটকের বিষয়টি কালবেলাকে নিশ্চিত করেছেন সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম) মো. মাসুদ রানা।
জালালী পংকীকে আটকের বিষয়ে সিলেট কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আলী মাহমুদ বলেন, রোববার দুপুরে মহানগরের ভাতালিয়াস্থ নিজ বাসা থেকে তাকে আটক করা হয়েছে। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে সিলেট মহানগরের জিন্দাবাজারে বিএনপি নেতাকর্মীরা জড়ো হয়ে পিকেটিং করার চেষ্টা করলে তাদের সরিয়ে দেয় পুলিশ। এ ছাড়া, নগরীর দরগাগেইটে রিকশায় আগুন দিয়ে পিকেটিং করছেন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। সকাল ১০টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। একই এলাকায় দৈনিক খবরের কাগজের ফটো সাংবাদিক মামুন হোসেনের মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়।
সকাল ৮টার পর থেকে বিভিন্ন স্থানে অতর্কিত পিকেটিং করেন বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। সঙ্গে আছে জামায়াতও। তারা ভাঙচুর করছেন যানবাহন। পুলিশের দিকে ছুড়ছেন ইট-পাটকেল। তবে পুলিশও তাদের ঠেকাতে কঠোরভাবে রয়েছে মাঠে। যে স্থানেই বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীরা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার চেষ্টা করছেন সেখানেই উপস্থিত হয়ে টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে ছত্রভঙ্গ করে দিচ্ছে তাদের। স্থানে স্থানে পিকেটিংয়ের কারণে সিলেট-ঢাকা মহাসড়ক যানশূন্য হয়ে পড়ে। নিরাপত্তার অজুহাতে পরিবহন শ্রমিকরাও সকাল থেকে বাস চলাচল বন্ধ রেখেছেন। সিলেট থেকে ছেড়ে যায়নি দূরপাল্লার বাস।
এদিকে আওয়ামী লীগ নেতার মালিকানাধীন নেতার একটি বাস ভঙচুর করেন হরতাল সমর্থকরা। বাসটির মালিক জৈন্তাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের উপদপ্তর সম্পাদক ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া মাহমুদ জানান, তার মালিকানাধীন বাস ‘আল মাহমুদ পরিবহন’ সোমবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে জাফলং যাওয়ার উদ্দেশে রওয়ানা হয়। হুমায়ূন রশিদ চত্বরে আসার পর বিএনপির নেতাকর্মীরা গাড়িটি ভাঙচুর করেন। পরে বাসটি সোবহানীঘাটস্থ পেট্রলপাম্পের সামনে এনে রাখা হয়।
অন্যদিকে দুপুরে নগরীর সুরমা পয়েন্টে হরতালবিরোধী শান্তি সমাবেশ করে সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ। ওই সমাবেশে সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, বিএনপি একটি সন্ত্রাসী সংগঠন, তা তারা আবারও প্রমাণ করেছে। হরতাল ডেকে তারা অরাজকতা সৃষ্টির পায়তারা করছে। সিলেটবাসী তাদের ডাকা হরতালকে প্রত্যাখ্যান করে রাজপথে নেমে এসেছে।
শান্তি সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুর রহমান চৌধুরী,মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন খান, মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেনসহ সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
বিএনপির ডাকা হরতাল চলাকালে দোকানপাট ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকতে দেখা গেছে। তবে নগরীর প্রত্যেকটি বাজার বা পয়েন্ট এলাকায় হাতে গোনা কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজনিয় দ্রব্য সামগ্রীর দোকান অর্ধেক খোলা রেখে দোকানীদের দেখা গেছে। অপরদিকে সিলেট থেকে ছেড়ে যায়নি দূরপাল্লার বাস। আঞ্চলিক সড়কগুলোতেও চলছে না গণপরিহন।
কদমতলী বাস টারমিনালে গাড়ি না পেয়ে ভোগান্তি পড়া যাত্রী আব্দুস সামাদের সাথে কথায় কালবেলার। তিনি বলেন, সকাল ৭টা থেকে আমি বাস স্যান্ডে বসা ১টি গাড়ি ছাঁড়েনি। হরতালের কারণে ভোগান্তিতে পড়েছি। কিভাবে যাবো বাড়িতে।
নন্দ নামের এক মাইক্রোবাস চালক কালবেলাকে বলেন, গতকাল গোলাপগঞ্জ থেকে সিলেট এসেছি। সিলেটে এসে শুনি আগামীকাল সারাদেশে হরতাল। কিভাবে যাবো বাড়িতে তার নিশ্চিয়তা নাই।
ইমা নামের এক স্কুলশিক্ষক কালবেলাকে বলেন, সকালে বের হয়েছিলাম স্কুলের উদ্দেশে। অর্ধেক রাস্তা যাওয়ার পর বাসায় ফিরছি।
এদিকে, হরতালকে কেন্দ্র করে সিলেটে যাতে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সেজন্য রোববার ভোর থেকে সিলেটের গুরুত্বপূর্ণ সকল রাস্তা ও মোড়ে অবস্থান নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। মহানগরের প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা ও মোড়ে পুলিশ অবস্থান নিয়েছে। সব ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঠেকাতে তারা প্রস্তুত।
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের (এসএমপি) কমিশনার মো. ইলিয়াস শরীফ বলেন, সিলেটের জনগণের সার্বিক নিরাপত্তায় আমরা মাঠে রয়েছি। হরতালকে কেন্দ্র করে কেউ নাশকতার চেষ্টা করলে আমরা কঠোরভাবে তা দমন করবো। রোববার ভোর থেকে আমাদের মোবাইল টিম, সিআরটি ও সাদা পোশাকে একাধিক টিম মাঠে রয়েছে। প্রস্তুত রয়েছে পুলিশের সাজোয়া যান পিসিআর।
মন্তব্য করুন