দেশের সর্বোত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার আকাশে ভোরের প্রথম আলোয় স্পষ্ট দেখা মিলছে বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা। যদিও এ বিখ্যাত পর্বতটি হিমালয়ের দ্বিতীয় শৃঙ্গ। শীতের আগে আগে আকাশ যখন মেঘহীন আর বাতাস নির্মল থাকে ঠিক এ দৃশ্যের দেখতে পাওয়া যায়। এতে স্থানীয়সহ আগত পর্যটকরা মুগ্ধ হয়ে দেখছেন অবিশ্বাস্য এ দৃশ্য। বাংলাদেশ-ভারত বিভক্তকারী নদী মহানন্দা কোলঘেঁষা তেঁতুলিয়া ডাকবাংলোর পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এখানে দাঁড়িয়ে সোজা উত্তরে তাকালে চোখে পড়বে সুনীল আকাশ আর হিমালয়ে ছড়ানো পর্বতশ্রেণি।
১৬৫ কিলোমিটার দূরের এ শৃঙ্গ এমনভাবে আকাশপটে ভেসে উঠছে, যেন দিগন্তের কোলেই এ শৃঙ্গ দাঁড়ানো। এটি পার্শ্ববর্তী দেশ নেপাল এবং সিকিম সীমান্তে অবস্থিত বিশ্বের তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা। কাঞ্চনজঙ্ঘার উচ্চতা ৮ হাজার ৫৮৬ মিটার।
এ ছাড়াও গত কয়েকদিন ধরে আকাশ মেঘমুক্ত ছিল তখন ভালোভাবে দেখা যায়নি। বর্তমানে বাতাসে ধূলিকণার পরিমাণ কমে যাওয়ায় এবার আগেভাগেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দৃশ্যমান হয়েছে।
বুধবার (১ নভেম্বর) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সকালে সূর্যোদয়ের কিছুটা পর কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতশৃঙ্গের অপরূপ দৃশ্য দেখা যায় তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো থেকে। পঞ্চগড়ের বিভিন্ন জায়গা থেকেও কম বেশি দেখা যাচ্ছে তা। এতে ব্যাপক সাড়া পড়ে গেছে জেলায়। মূলত সকাল ভোর ৫টা থেকে সকাল সাড়ে ৬টার মধ্যে দেখা মেলে কাঞ্চনজঙ্ঘার। যেন চোখের পলকে সামনে ভেসে ওঠে পর্বতটি। সূর্যের আলো মাটিতে পড়ার কয়েক মিনিট আগে যখন ভোরের প্রথম কিরণ কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া স্পর্শ করে তখন শ্বেতশুভ্র এই পর্বতটি হয়ে ওঠে উত্তপ্ত লাভার মতো লাল। পাহাড়ের চূড়া ছাড়াও, ভারতের কালিম্পং শহরের যানবাহন চলাচল এবং বৈদ্যুতিক আলো, দার্জিলিং মহকুমা সদর দপ্তর এবং রাতে প্রদর্শিত ভারতের সীমান্ত বাহিনীর ওয়াচ লাইট তেঁতুলিয়ার ডাকবাংলো এলাকা থেকে উপভোগ করা যায়। ভারতীয় সীমান্তের কাঁটাতারের ওপারে মেঘের মধ্যে বিরল-সূর্যাস্ত আরেকটি মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। সন্ধ্যায় মহানন্দা নদীর তীরে বসে এই দৃশ্য দেখতে পান পর্যটকরা।
তবে মেঘমুক্ত আকাশে শীতের সকালের রোদ কাঞ্চনজঙ্ঘার প্রধান শৃঙ্গে ঠিকরে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই অনাবিল সৌন্দর্য দেখতে সবাই দৃষ্টি ফেলে সোজা উত্তরে। অনেকেই এই দৃশ্যটি নিজ ফোনের ক্যামেরায় ধারণ করার চেষ্টা করছেন। বিশেষ করে তেঁতুলিয়ার ঐতিহাসিক ডাকবাংলো খানিকটা উঁচু হওয়ায় সেখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায় পরিষ্কারভাবে।।
বিশেষ করে সূর্যোদয়ের পর পরই দেখা যায় এই দৃশ্য। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোদের তেজ বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে ক্রমেই মিলিয়ে যেতে থাকে কাঞ্চনজঙ্ঘা। শেষ বিকেলে আরেকবার দেখা দিয়ে মিলিয়ে যায় এ পর্বতচূড়া।
এর আগে চলতি মৌসুমে ৩০ ও ৩১ অক্টোবর কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। তবে আবহাওয়া জনিত কারণে কখনও কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়, আবার দেখা যায় না। শীত মৌসুমে অনেকবার এমন দৃশ্য দেখা যাবে তেঁতুলিয়া থেকে। কপাল ভালো হলে পঞ্চগড় জেলা শহরের যে কোনো উঁচু ভবন থেকেও দেখা মিলবে কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ সৌন্দর্য।
জানা যায়, পৃথিবীতে উচ্চতার দিক থেকে প্রথম তিনটি পর্বতই হিমালয় পর্বতমালায় অবস্থিত। প্রথম অবস্থানে রয়েছে মাউন্ট এভারেস্ট। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এভারেস্ট শৃঙ্গের উচ্চতা ৮ হাজার ৮৪৮ মিটার বা ২৯ হাজার ২৯ ফুট। আর দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা পর্বত কে-টুর উচ্চতা ৮ হাজার ৬১১ মিটার বা ২৮ হাজার ২৫১ ফুট। আর তৃতীয় অবস্থানে থাকা কাঞ্চনজঙ্ঘার উচ্চতা ৮ হাজার ৫৮৬ মিটার বা ২৮ হাজার ১৬৯ ফুট। তবে কাঞ্চনজঙ্ঘার পাঁচটি চূড়ার মধ্যে তিনটি চূড়া পড়েছে উত্তর সিকিমে আর দুটি চূড়া পড়েছে নেপালের মেচি জোনের তাপলেজাং জেলায়। কাঞ্চনজঙ্ঘার সুউচ্চ চূড়া কাছ থেকে দেখা যায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার টাইগার হিল থেকে। যেখানকার উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২ হাজার ৫৭৩ মিটার বা ৮ হাজার ৪৪১ দশমিক ৬০১ ফুট। এই উচ্চতা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার দূরত্ব সোজা পূর্বে ৭৯ দশমিক ৮ কিলোমিটার।
উত্তরের এ জেলাজুড়ে আছে পর্যটনের আরও নিদর্শন। প্রাচীন স্থাপনা, প্রত্ন পর্যটন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, গুপ্ত, পাল, সেন ও মুসলিম শাসনামলের হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এ জেলা। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। দেশের একমাত্র চার দেশীয় বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর এ জেলায়। আরও রয়েছে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর ইমিগ্রেশন ও জিরো পয়েন্ট, বিজিবি-বিএসফের জয়েন্ট রিট্রিট সেরিমনি, ইংরেজ আমলে জেলা পরিষদ ডাকবাংলো, সমতল ভূমির চা-বাগান, টিউলিপ গার্ডেন, আনন্দধারা পার্ক, ভিতরগড় দুর্গনগরী, মহারাজা দিঘি, পাথরের জাদুঘর, মোগল স্থাপনা মির্জাপুর শাহী মসজিদ, বোদেশ্বরী পীঠ।
জেলার পর্যটনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু আবাসিক হোটেল। সরকারিভাবে রয়েছে আবাসন ব্যবস্থা। পঞ্চগড় জেলা শহরে রয়েছে সার্কিট হাউসসহ স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং সড়ক ও জনপদ বিভাগের গেস্টহাউস। বেসরকারিভাবে সেন্ট্রাল গেস্টহাউস, হোটেল মৌচাক, হোটেল প্রিতম, অগ্রদূত প্যালেস, এইচ কে প্যালেস, ধানসিঁড়িসহ বিভিন্ন আবাসিক হোটেল রয়েছে পঞ্চগড়ে।
তেঁতুলিয়ায় রয়েছে সরকারি ও বেসরকারি হোটেল ও বাংলো। মহানন্দা নদী ঘেঁষে উঁচু টিলার ওপর অবস্থিত শতবর্ষ পুরোনো তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো। ব্রিটিশ আমলের এই ডাকবাংলো বর্তমানে জেলা পরিষদ ডাকবাংলো হিসেবে পরিচিত। আগেভাগে যোগাযোগ করে এই ডাকবাংলোয় থাকার ব্যবস্থা করতে পারেন। পুলিশের অফিসার্স মেস, উপজেলা পরিষদের বেরং কমপ্লেক্স, সড়ক ও জনপদের গেস্টহাউস, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের গেস্টহাউস, বন বিভাগের গেস্টহাউস, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলের গেস্টহাউসে থাকার ব্যবস্থা আছে।
এছাড়া তেঁতুলিয়ায় বেসরকারিভাবে হোটেল দোয়েল, স্কয়ার হোটেল, স্বপ্ন গেস্টহাউস, কাঠের বাড়ি গেস্টহাউস, হোটেল সীমান্তের পাড়, হোটেল কাঞ্চনজঙ্ঘা, কাজী ব্রাদার্স এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইএসডিও পরিচালিত মহানন্দা কটেজসহ রয়েছে বিভিন্ন আবাসিক হোটেল।
এদিকে পর্যটনে ঘুরে দাঁড়িয়েছে স্থানীয় অর্থনীতি। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজারো পর্যটকের সমাগম ঘটে এ জেলায়। বিশেষ করে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে অক্টোবর ও নভেম্বর মাসজুড়ে পর্যটকের ভিড়ে মুখরিত থাকে তেঁতুলিয়া। এতে ব্যস্ততা বেড়ে যায় হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোতে। গতি পায় তিন চাকার ভ্যান আর অটোরিকশার মতো যানগুলোও। বিগত কয়েকবছর ধরে পর্যটকদের সংখ্যা বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয়রা, বিশেষ করে যারা বিভিন্ন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, তারা বিভিন্ন নতুন সেবা ও সুযোগ-সুবিধা চালু করলেও চাহিদার তুলনায় তা অপ্রতুল।
স্থানীয়রা জানায়, মূলত আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে। যদিও প্রতিবছর অক্টোবর শেষে ও নভেম্বর মাসের শুরুতে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা গেলেও এবছর নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে দেখা মিলছে এবং বিগত বছরের তুলানায় আকাশ মেঘমুক্ত থাকায় অনেক পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আর কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য দেখতে ছুটে আসতে শুরু করেছে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা পর্যটক ও ভ্রমণপিপাসুরা। অনেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘার রুপ দেখার জন্য রাত থেকে অপেক্ষা করে বসে থাকে। পর্যটকদের থাকার জন্য জন্য রয়েছে জেলা পরিষদের ডাকবাংলো ও উপজেলা পরিষদের বেরং কমপ্লেক্সে এবং বাণিজ্যিকভাবে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন আবাসিক হোটেল। দেশের সব বিনোদন কেন্দ্র টাকা বা টিকেট কাটতে হলেও তেঁতুলিয়ায় বিনা পয়সায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখা যায়।
তেঁতুলিয়ার জেলা পরিষদের ডাকবাংলো থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা, মহানন্দা নদীতে পাথর উত্তোলনের দৃশ্য আরও বেশি নজর কাড়ে পর্যটকদের। এছাড়া তেঁতুলিয়া পিকনিক কর্নারে রয়েছে বিভিন্ন স্থাপনা যা ছোট বড় সব বয়সী মানুষের নজর কারে।
ঢাকা থেকে আগত পর্যটকরা জানান, আগে শুধু শুনেছি তেঁতুলিয়া থেকে হিমালয় পাহাড় দেখা যায়। কিন্তু এবার বাস্তবে দেখলাম। অসাধারণ এক দৃশ্য। যা না দেখলে কেউ অনুধাবন করতে পারবে না। এত কাছে, এত স্পষ্ট আমি কল্পনাই করতে পারিনি।
আরেফিন আকতার নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, দিনের বেলায় কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা শেষে সন্ধ্যার পর মহানন্দার পাড়ে বসে সীমান্ত লাইট ও শৈল শহর দার্জিলিংয়ের পাহাড়ের ওপরের নিয়ন বাতি জ্বলতে দেখা যায়। তাদের ঘরবাড়ি, যানবাহন চলাচলও দেখা যায়, যা অসাধারণ লাগে।
ঢাকা থেকে আগত পর্যটক সাদ্দাম হোসেন বলেন, আজই আমরা কাঞ্চনজঙ্ঘার দর্শন পেলাম খুব ভালোভাবে। যদিও বিগত মাস থেকে দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা ছিলো। এখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভ্রমণপিপাসুরা আসেন কাঞ্চনজঙ্ঘার অবলোকন করতে।
শহিদুল্লাহ নামে ভ্যানচালক বলেন, এই মৌসুমে শত শত মানুষ এখানে আসে। কাঞ্চনজঙ্ঘার পাশাপাশি তারা দলবেঁধে চা বাগান, রওশনপুরের আনন্দধারা, জিরো পয়েন্টসহ বিভিন্ন এলাকায় যান। এ সময়টাতে আমাদের ভালো আয় হয়। অনেকে ভাড়ার পাশাপাশি বকশিশও দেয়।
পঞ্চগড় টুরিস্ট পুলিশ জোনের উপপরিদর্শক মামুনুর রশীদ বলেন, দেশের বিভিন্ন জায়গা, দূরদূরান্ত থেকে যে সব পর্যটক কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে আসেন। প্রতিদিন ভোর থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত পর্যটনস্পট ডাকবাংলো পিকনিক কর্ণারে ট্যুরিস্ট পুলিশ মোতায়েন করা থাকে। আমরা নতুনভাবে উদ্যোগ নিয়েছি কোন পর্যটক যেন স্থানীয় কিংবা দুস্কৃতকারী দ্বারা হয়রানি শিকার না হন, তার জন্য আমরা হেল্প ডেস্ক তৈরি করবো। এটি স্থানীয়দের সহযোগিতা নেওয়া হবে। পর্যটকরা সমস্যা তুলে ধরতে পারবেন। আমরা তা নিরসন ও নিরাপত্তা প্রদানে সর্বদা কাজ করছে টুরিস্ট পুলিশ।
তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফজলে রাব্বি বলেন, তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো থেকে মনোমুগ্ধকর কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা মিলছে। কাঞ্চনজঙ্ঘার এই মনোমুগ্ধকর রুপ অবলোকনসহ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও দেখতে দিন দিন পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় পর্যটকদের সংখ্যা বাড়ছে। পর্যটকদের আবাসিক সমস্যা দূরীকরণে সরকার বিভিন্ন উদ্যােগ গ্রহণ করছে। আমরা ইতিমধ্যে তেঁতুলিয়া ডাকবাংলোকে নতুন করে সাজিয়েছি। পর্যটকদের সংখ্যা বৃদ্ধির ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসন সচেতন আছে এবং তাদের সুবিধার্থে কাজ করছে।
মন্তব্য করুন