পদ্মা সেতু উদ্বোধন হওয়ায় পর থেকে দেশের বৃহত্তম অর্থনৈতিক করিডর হিসেবে গড়ে উঠছে ঢাকা-দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল হাইওয়ে। বর্তমানে দেশের একমাত্র অর্থনৈতিক করিডর হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দরকেন্দ্রিক ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়েকে বিবেচনা করা হচ্ছে। আর দেশের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক করিডর হিসেবে গড়ে উঠেছে ঢাকা-দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল। চলমান উন্নয়ন এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়িত হলে এটাই হবে দেশের বৃহত্তম করিডর।
বাগেরহাট চেম্বারে সভাপতি ও সিএন্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. লিয়াকত হোসেন জানান, পদ্মা সেতু দেশের তিনটি বন্দরকে ঢাকার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করেছে। সেগুলো হলো, মোংলা বন্দর, পায়রা সমুদ্রবন্দর ও দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল। পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক ঢাকা-দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলকে দেশের নতুন অর্থনীতির করিডর হিসেবে বিবেচনা করছে ব্যবসায়ীরা।
তিনি আরও বলেন, এটি শুধু ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকেই যুক্ত করেনি, বরং মোংলা, পায়রা ও বেনাপোল বন্দরকে সরাসরি ঢাকার সঙ্গে যুক্ত করেছে। ভবিষ্যতে এই অবকাঠামোর মাধ্যমে বাংলাদেশ এশিয়ান হাইওয়েতে যুক্ত হবে, যা অর্থনীতিকে নতুন মাত্রা দেবে।
জানা যায়, পদ্মা সেতুর কারণে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মোংলায় গতিশীলতা বেড়েছে। মোংলা বন্দর থেকে এখন ঢাকায় পণ্য আসতে লাগছে মাত্র তিন ঘণ্টা। আগে যেখানে সময় লাগত লাগত ৮ থেকে ৯ ঘণ্টা। মোংলা থেকে সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে আগে লাগত ১৪ ঘণ্টা। সেতুর সুফলে তা কমে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টায় দাঁড়িয়েছে। এই বেঁচে যাওয়া সময়টাই হবে অর্থনীতির বড় পুঁজি। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) ও বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকিএমইএ) সদস্যরা ইতোমধ্যে মোংলা বন্দর ব্যবহার করে দুই দফায় বিদেশে গামেন্ট পণ্য রপ্তানি করেছে।
মোংলা বন্দর সূত্র জানায়, বর্তমানে মোংলা বন্দরে বছরে ১ হাজার ৫০০টি জাহাজ এবং প্রায় ১ লাখ কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা রয়েছে। তবে ব্যবহার হচ্ছে সক্ষমতার অর্ধেক। পদ্মা সেতু চালুর ফলে বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ অনেক বেড়েছে। এ কারণে জাহাজের ধারণক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে। ২০২৫ সাল নাগাদ বন্দরে তিন হাজারের মতো জাহাজ ভিড়তে পারবে।
বন্দরের উপসচিব মো. মাকরুজ্জামান মুন্সী জানান, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর মোংলা বন্দরে কন্টেইনারবাহী জাহাজ আগের তুলনায় বেশি আসছে। দেশের বিভিন্ন জায়গার গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে উৎপাদিত তৈরি পোশাক এ বন্দর দিয়ে রপ্তানি হওয়ার কারণে এক বছরে ১৫ শতাংশ রপ্তানি বেড়েছে। পর্যায়ক্রমে আরও বাড়বে।
বন্দরের এই কর্মকর্তা আরও জানান, মোংলা বন্দর দিয়েই ইউরোপের দেশ পোল্যান্ড, জার্মানি ও ডেনমার্কে পোশাক রপ্তানি করা হয়। রাজধানী ঢাকা থেকে মোংলার দূরত্ব কম হওয়ায় স্বল্প সময়ে কম খরচে পণ্য রপ্তানির জন্য গার্মেন্টেসের উদ্যোক্তারা এখন মোংলা বন্দর ব্যবহারে আগ্রহী হচ্ছে। বন্দর কর্তৃপক্ষের আশা আগামী কয়েক বছরের মধ্যে রপ্তানির হার ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড়িয়ে যাবে।
খুলনায় দেশের অন্যতম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হিমায়িত মৎস্য ও পাটশিল্পের অধিকাংশ। পদ্মা সেতুর কারণে এ খাতে রপ্তানি আয় আরও বেড়েছে। পাশাপাশি মোংলা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের সঙ্গে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থাও অনেক সহজ হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের কাঁচামাল আগে যেখানে জাহাজে আসত, সেখানে এখন সড়ক পথে আসছে। এতে মোংলা এই ইপিজেডে বিনিয়োগও বাড়তে শুরু করেছে।
দেশের তৃতীয় সমুদ্রবন্দর হচ্ছে পায়রা। এখন পদ্মা সেতুর কারণে এই বন্দরের উন্নয়ন অনেক বেগবান হবে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ এখানে বাড়াবে। বন্দরকে কেন্দ্র করে আশপাশের এলাকা শিল্পাঞ্চল হিসেবে গড়ে উঠবে। পদ্মা সেতু হওয়ায় পায়রা বন্দরের সঙ্গেও সারা দেশের সড়ক যোগাযোগটা স্থাপিত হয়েছে। শুধু সারা দেশই নয়, বহিঃবিশ্বের সঙ্গেও যোগাযোগ তৈরি হয়ে গেছে। বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ সংযুক্ত হয়েছে। ব্যবসায়ীরা যারা আমদানি-রপ্তানির সঙ্গে জড়িত তারা এখন আগ্রহী হয়ে উঠবে পায়রা বন্দরকে ব্যবহার করার জন্য। এখন তাদের মালামাল ঢাকা থেকে শুরু করে বাংলাদেশের যে কোনো প্রান্তে পাঠাতে আর কোনো সমস্যা থাকবে না।
এ ছাড়া ঢাকার সঙ্গে বেনাপোলের দূরত্বও কমেছে ৯৩ কিলোমিটার। ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের বড় অংশই হয় এ পথে। যা থেকে আদায়ের রাজস্বের পরিমাণ প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। এ পথে যাতায়াতে সময় বাঁচবে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা। সঙ্গে কমবে পরিবহন খরচ। তাই বাণিজ্য বৃদ্ধির সঙ্গে স্থলবন্দরটির রাজস্ব দেড় গুণ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশে আটটি রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) ও একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু আছে। এর মধ্যে পদ্মার ওপারে শুধু মোংলা ইপিজেড। পদ্মা সেতুকে ঘিরে যশোর ও পটুয়াখালীতে আরও দুটি ইপিজেড করার প্রস্তাব আছে। এতে এ অঞ্চলে রপ্তানিমুখী খাতে আরও বিনিয়োগ বাড়তে শুরু করেছে। এর ফলে বাড়ছে কর্মসংস্থান।
পদ্মা সেতু হওয়ায় ঢাকার সঙ্গে মোংলা, পায়রা ও বেনাপোলের সড়কটি একটি করিডরটা অর্থনৈতিক হিসেবে কাজ করবে। যা দেশের উন্নয়নে একটা উদ্দীপনা সৃষ্টি করছে। পাল্টে যেতে শুরু করেছে দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের পর্যটনের মানচিত্রও। সরকার সেতু ও সড়ক নির্মাণ করে উন্নয়নের মেরদণ্ড তৈরি করে দিয়েছে। এই সেতুকেন্দ্রিক ঢাকা-দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে গড়ে ওঠা নতুন অর্থনৈতিক করিডরের সুফল তাড়াতাড়ি পাওয়া যাবে।
মন্তব্য করুন