জগলুল হুদা, রাঙ্গুনিয়া (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ০৭ নভেম্বর ২০২৩, ১০:০২ এএম
অনলাইন সংস্করণ

মাটির ব্যাংকে জমানো টাকা ব্যবসার পুঁজি, এখন সফল উদ্যোক্তা ফেরদৌস

চট্টগ্রামের উদ্যোক্তা ফেরদৌস আকতার। ছবি : কালবেলা
চট্টগ্রামের উদ্যোক্তা ফেরদৌস আকতার। ছবি : কালবেলা

ছোটবেলা থেকে ফেরদৌস আকতারের স্বপ্ন প্রকৌশলী হবেন। এসএসসি পাস করার পর পলিটেকনিক্যালে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না তার। দুই বছর না যেতেই পড়ালেখার ইতি টানতে হলো। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণ আর এগোতে পারেনি ফেরদৌস। পরে বিয়ে হয়ে যায় তার। কিন্তু ফেরদৌসের স্বপ্ন থেমে থাকেনি। নতুন স্বপ্নে বিভোর ফেরদৌস। এবার ভাবলেন, সফল হতে হবে, নিজের একটা পরিচয় তৈরি করতে হবে। মাটির ব্যাংকে জমানো আট হাজার টাকা দিয়ে শুরু করলেন অনলাইনে মসলার ব্যবসা। এখন তিনি সফল উদ্যোক্তা। পেয়েছেন জয়ী ও জয়ীতাসহ নানা পুরস্কার। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পোমরা ইউনিয়নের গোচরা গ্রামে স্বামী লুৎফুর বারী পারভেজ, মেয়ে মাশরুবা বারী সোহা ও ছেলে সামিউল বারী ফাইরাজকে নিয়ে থাকেন ফেরদৌস।

সরেজমিনে তার বাড়িতে গেলে তিনি তার সফলতার সব গল্প বলেন। বাড়ির একটি কক্ষে তরে তরে সাজানো ক্রেস্ট, সনদসহ নানা অর্জন দেখান তিনি। তিনি বলেন, বিয়ের আগের জীবন আর বিয়ের পরের জীবন তফাত রয়েছে। বিয়ের পর স্বামী, সন্তান ও সংসারের সব কিছু সামলিয়ে নিজেকে কিছু একটা করার চেষ্টা করতে হয়। ২০১৬ সালটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে কষ্টের। মেয়ে সন্তানকে যখন পার্শ্ববর্তী একটি উপজেলার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করায়, তখন বুঝতে পারি পড়ালেখাটা কেন শেষ করিনি। বাড়ি থেকে স্কুল একটু দূরে হওয়ায় মেয়ের ক্লাস শেষ হওয়ার পর আবার নিয়ে আসতে হতো বাড়িতে। স্কুলে অপেক্ষা করতে হতো তখন। তখন ইন্টারনেটে সময় দিতাম। ভাবলাম, নিজে কিছু একটা করতে হবে। নইলে সংসার চালানোটাই কঠিন হবে। তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দেশে উদ্যোক্তাদের বড় সংগঠন উই (ওইম্যান অ্যান্ড ই কমার্স-ফোরাম) এর গ্রুপটি পেয়ে যাই। গ্রুপে ঘুরে দেখলাম দেশের হাজার হাজার নারী উই গ্রুপের মাধ্যমে পণ্য বেচাকেনার কাজ করছে। তখন নিজের ভেতর লালিত স্বপ্ন মোচড় দিয়ে উঠল। নিজেকে কিছু একটা করতে হবে। ২০২০ সালের মার্চ মাসে দেশে করোনা ভাইরাসের ছোবলের কারণে মানুষজন যখন ঘরবন্দি। তখন আমি ওই সময়টাকে কাজে লাগাই। মাটির ব্যাংকে জমানো ৮ হাজার টাকা দিয়ে গ্রামের কৃষকদের কাছ থেকে মরিচ, ধনিয়া ও হলুদ কিনি। সেগুলো শুকিয়ে গুঁড়ো করে প্যাকেটজাত করে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিই। কুক মাসালা নামে একটি ফেসবুক পেজও খুলি তখন।

উই গ্রুপ ও ফেসবুক পেজে মরিচ-মসলা কেনা থেকে শুরু করে ধোঁয়া, শুকানো, মিলিং ও প্যাকটজাত করার ভিডিও আপলোড দিই। তখন দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ফেসবুক কমেন্ট বক্সে ও ইনবক্সে মরিচ, হলুদ ও মসলার অর্ডার আসতে থাকে। ওই দিনে ৬ জন মরিচের গুঁড়ার অর্ডার দেন। ওই সময় খরচ বাদ দিয়ে ২২ দিনে আয় হয় প্রায় এক লাখ টাকা। ওই দিন থেকে আমার আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

পেছনের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, এক সময়ে অনেকের আত্মীয়স্বজন মসলাওয়ালি বলতো, ফেরিওয়ালি বলত। তারা এখন কিভাবে কাজটা করে সফল হবে আইডিয়া নেয়। তিনি বলেন, দেশের ৬৪ জেলাতে আমার মসলার স্বাদ পৌঁছাতে পেরেছি। অনেকেই বিদেশেও এসব মসলা পাঠান। ২০২১ সালে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে আমাকে জয়ীতা পুরস্কার দেওয়া হয়। সর্বশেষ অক্টোবর উই থেকে দেওয়া হয় জয়ী পুরস্কার। সারাদেশের ১৪ লাখ উই উদ্যোক্তা সদস্য থেকে ২০ জনকে দেওয়া হয় এই পুরস্কার। বিজনেস অব দ্য ইয়ার এই ক্যাটাগরিতে আমার হাতে পুরস্কার তুলে দেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি।

কয়েক বছর আগে একেবারেই সাদামাটা জীবন ছিল তার। এখন সারাদিন ফেসবুকে পণ্যের অর্ডার চেক করা। অর্ডার নেওয়া, পরিমাপ করে পণ্য প্যাকেট করে পৌঁছে দেওয়া কুরিয়ারে। তারপর তদারকি। গ্রাহকের হাতে পণ্য পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত ফোনে ফোনে আলাপ। পৌঁছে গেলে স্বস্তি। তার রোজকার কাজের রুটিন অনেকটা এ রকম।

ফেরদৌস ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে সারাদেশে নিয়মিত ক্রেতা ৫০০ জনের ওপরে। শুরু থেকে এই পর্যন্ত অনলাইনের মাধ্যমে ৪ হাজার গ্রাহকের প্রায় ৪০ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করেন তিনি।

উই গ্রুপের প্রেসিডেন্ট নাসিমা আকতার নিশার উৎসাহ পেয়ে কাজ শুরু করেন তিনি। ৬৪ জেলার মধ্যে ঢাকার উত্তরা ও মিরপুর থেকে সবচেয়ে বেশি অর্ডার হয়। হাটহাজারীর মিষ্টি মরিচর গুঁড়ার চাহিদা বেশি ক্রেতাদের। এ ছাড়া হলুদ, ধনিয়া, মেজবানি মসলা, বিরিয়ানি মসলা, মাংসের মসলা, জিরা, বিন্নি চাল, শীমের বিচি, আতপ চালের গুঁড়াও তিনি বিক্রি করেন। প্রতি মাসে তার লাখ খানেক টাকার পণ্য বিক্রি হয়। তবে তার একটি সমস্যা স্থানীয়ভাবে কুরিয়ার না থাকায় চট্টগ্রাম নগরের গিয়ে পণ্য ডেলিভারি দিতে হয়। এজন্য তার খরচ বেশি পড়ে। খরচটি তিনি ক্রেতার কাছ থেকে নিতে পারেন না। ভবিষ্যতে কুক মাসালা নামে এই পণ্যের কারখানা করতে চান তিনি।

নতুন উদ্যোক্তাদের উদ্দেশে ফেরদৌস আকতার বলেন, ভালো উদ্যোক্তা হতে চাইলে ধৈর্য ধরে এগিয়ে যেতে হবে। কে কি বলল, সেটা না ভেবে নিজের কাজটা নিজে ভালোভাবে করতে হবে। তাহলে একজন ভালো উদ্যোক্তা হওয়া যাবে।

জানতে চাইলে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা স্বজন কুমার তালুকদার বলেন, ফেরদৌস একজন সফল উদ্যোক্তা। নারীদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে হলে অবশ্যই ফেরদৌসের মতো উদ্যোগী হতে হবে। ইচ্ছাশক্তি মানুষকে অনেক দূর নিয়ে যায়। ফেরদৌস নারী সমাজের আইডল।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ইচ্ছাকৃতভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক পিছিয়ে রাখা হয়েছিল : পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

বিএনপি নেতা ফজলুর রহমানকে শোকজ

জোয়ারের তোড়ে লোকালয়ে ভেসে এলো বনের হরিণ

৩শ সাপ পুষছেন ইদ্রিস, কামড় খেয়েছেন দুই শতাধিক

রেকর্ড জয়ের পরও সিরিজ হাতছাড়া অজিদের

ভয়াবহ যৌন হয়রানির ঘটনা জানালেন সালমানের নায়িকা

‘আইন শক্তিশালী হলেই শতভাগ জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে’

দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারে ইউক্রেনকে বাধা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র

ইসিতে ধাক্কাধাক্কি-হাতাহাতি, ক্ষোভ ঝাড়লেন রুমিন ফারহানা 

গণফ্রন্টের কার্যকরী চেয়ারম্যান হয়েছেন অ্যাডভোকেট আজমল হোসেন

১০

ক্যাম্পাসে এখনো প্রান্তিক অবস্থায় ছাত্রদল, অভিযোগ আবিদের

১১

১২ মাসের জন্য ছিটকে গেলেন সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে গতিময় পেসার

১২

তরুণ ব্যবসায়ীর লাশ নিয়ে বিক্ষোভ

১৩

আমরা চাই টাকা-পয়সার ব্যাপারে সমাধান হোক : পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

১৪

বাম চোখ লাফালে কী হয়? যা বলছেন বিশেষজ্ঞ আলেম

১৫

গ্র্যান্ড স্ল্যামে প্রাইজ মানি বাড়ানোর আহ্বান জোকোভিচের

১৬

সবজির চড়া দামে বিপাকে সাধারণ মানুষ

১৭

গোবিন্দকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন রাভিনা ট্যান্ডন, দাবি সুনীতার

১৮

হঠাৎ মোবাইলের ডায়াল প্যাড পরিবর্তন হলে যা করবেন

১৯

পাকিস্তানের বন্যায় নিহত ছাড়াল ৪০০

২০
X