জনশ্রুতি আছে, এক সময় স্থানীয় লোকজন বিয়েশাদির অনুষ্ঠান আয়োজন করলে, আগের দিন দিঘির পাড়ে গিয়ে থালাবাসনের কথা বলে আসতে হতো। অনুষ্ঠানের জন্য দিঘির পাড়ে অদৃশ্যভাবে প্রয়োজনমতো চলে আসত থালাবাসন। ব্যবহারের পরে তা পরিষ্কার করে ফেরত দিতে হতো। তবে এখন সেই চল না থাকলেও বিশাল দিঘির জলরাশিজুড়ে রয়েছে নয়নাভিরাম দৃশ্য।
দিঘির চারপাশ সবুজ গাছের সমারোহে সারাক্ষণই পাখির কলকাকলিতে মুখর হয়ে থাকে। বলছি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী ঢোল সমুদ্র দিঘির কথা। দিঘিটি গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলা বাসস্ট্যান্ড থেকে মাত্র ১৩ কিলোমিটার উত্তরে বোয়ালী ইউনিয়নের ঢোল সমুদ্র গ্রামে অবস্থিত। বিশাল আকারের এই দিঘিটির দৈর্ঘ্য ৬০০ হাত ও প্রস্থ ৩০০ হাত (প্রায়)। দিঘিটি ঠিক কবে খনন করা হয়, সে সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না। তবে জনশ্রুতি রয়েছে, দশম শতাব্দীতে রাজা যশোপাল বিশাল আয়তনের এ দিঘি খনন করেন। দিঘিটি এতই গভীরভাবে খনন করা হয়েছিল যে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত দেখা যেত না। এত গভীরভাবে খনন করার পরও দিঘিতে পানি না ওঠায় রাজা যশোপাল পড়েন মহাবিপদে। এমতাবস্থায় এক রাতে হঠাৎ তিনি স্বপ্নে দেখেন, তার ছয় রানির মধ্যে ছোট রানি যদি ঢাক-ঢোল বাজাতে বাজাতে দিঘির ওপর থেকে নিচের দিকে যান তাহলে দিঘিতে পানি উঠবে। রাজার কথা মতো ছোট রানি ঢাক-ঢোল বাজাতে বাজাতে দিঘির নিচের দিকে নামতে থাকেন। এভাবে রানি যতই নিচের দিকে নামতে থাকেন দিঘিতে ততই পানি উঠতে থাকে। একপর্যায়ে রানি পানিতে তলিয়ে যান। তারপর থেকে তাকে আর দেখা যায়নি। ঢোল বাজিয়ে পানি ওঠানো হয়েছে বলে দিঘিটার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ঢোল সমুদ্র’। দিঘির নামকরণ নিয়ে আরেকটি জনশ্রুতি রয়েছে। কথিত আছে, দিঘিটি এতই গভীর ছিল, এটি পরিমাপ করা ওই সময়ে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। পাল রাজা দিঘিটির গভীরতা পরিমাপের জন্য কয়েকজন ঢুলিকে দিঘির ভেতরে নামিয়ে দেন। ঢুলিরা ঢোল বাজাতে বাজাতে দিঘির নিচে নামতে থাকলে একপর্যায়ে ঢোলের আওয়াজ আর শোনা যাচ্ছিল না। সেই থেকে এই দিঘিটির নামকরণ করা হয় ঢোল সমুদ্র দিঘি।
এই দিঘি ঘিরে আরেকটি জনশ্রুতি রয়েছে—এই গ্রামসহ আশপাশের এলাকায় যদি কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান হতো দিঘির পাড়ে গিয়ে অনুষ্ঠানের জন্য প্লেট, গ্লাস, রান্না করার হাঁড়ি-পাতিলসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম চাইলে দিঘির পাড়ে উঠে আসত। অনুষ্ঠান শেষে সব জিনিস দিঘির পাড়ে রেখে এলে তা আপনা-আপনি দিঘির নিচে চলে যেত। এ ছাড়া দিঘিতে মাঝে মধ্যে সোনার নাও ভেসে উঠত বলেও জনশ্রুতি রয়েছে। এ জন্য ঢোল সমুদ্র দিঘিকে ‘সোনা দিঘি’ নামেও ডাকা হয়।
স্থানীয়রা জানান, ঢোল সমুদ্র গ্রামের তৎকালীন ডিসট্রিক্ট প্রেসিডেন্ট আবু নাসের ফজলুল হক ওরফে ডা. ইয়াদ আলি এলাকাবাসীর পক্ষে দিঘিটি নিয়ে মামলা করেন। দিঘিটি জনস্বার্থে ব্যবহারের জন্য আদালতের রায় পান। বর্তমানে দিঘিটির আয়তন আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। আগে দিঘিটির একপাশ থেকে অন্য পাশ দেখা যেত না। সরকারিভাবে যদি ঐতিহ্যবাহী এই দিঘিটি সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়, তাহলে এলাকার বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান হবে। একইসঙ্গে সরকারও আর্থিক লাভবান হবে। হাশেম মিয়া নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ‘আমাদের গ্রামে এক সময় কোনো নলকূপ ছিল না। গ্রামের সবাই নানা কাজে এই দিঘির পানিই ব্যবহার করত। আস্তে আস্তে দিঘির আয়তন কমে আসছে, পানিও আগের মতো পরিষ্কার নেই।’ কালিয়াকৈর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাজওয়ার আকরাম সাকাপি ইবনে সাজ্জাদ বলেন, ‘ঢোল সমুদ্র দিঘি নিয়ে মামলা চলছে। মামলা শেষ হলে দিঘিটির খননকাজ করা হবে। এই ঐতিহ্যবাহী দিঘি নিয়ে আমাদের বিশদ চিন্তা-ভাবনা রয়েছে।’
মন্তব্য করুন