ঝালকাঠিতে সুগন্ধা নদীতে পদ্মা অয়েল কোম্পানির তেলবাহী জাহাজে বিস্ফোরণের ফলে ছড়িয়ে পড়া আগুন প্রায় ১১ ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে আসে।
সোমবার (৩ জুলাই) সন্ধ্যা থেকে পরদিন মঙ্গলবার ভোর সাড়ে ৫টা পর্যন্ত আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করেন ফায়ার সার্ভিস, কোস্টগার্ড, বিআইডব্লিউটিএর কর্মীরা।
এদিকে অগ্নিকাণ্ডের উৎসমুখ খুঁজতে গিয়ে মিলেছে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য। জাহাজের এক কর্মীর মতে, তেল অপসারণের সময় সাবমার্সিবল পাম্প চালু করতে গিয়ে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতেই জাহাজে আগুন লেগে যায়। অপরদিকে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সিগারেটের আগুন থেকে এ ঘটনা ঘটতে পারে।
ঘটনার সাক্ষী সাগর নন্দিনী জাহাজের পাশে থাকা সাগর নন্দিনী-৪ জাহাজের বাবুর্চি আহত কাইয়ুম হোসেন বলেন, দুর্ঘটনাকবলিত জাহাজ থেকে সাগর নন্দিনী-৪ জাহাজে তেল অপসারণের সময় সাবমার্সিবল পাম্প চালু করতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। আর তাতেই দুবার বিস্ফোরণ ঘটে। আহত কাইয়ুম এখনও ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
ঝালকাঠি ফায়ার স্টেশন কর্মকর্তা মো. শফিকুল বলেন, দ্বিতীয়বার জাহাজে তেল অপসারণের সময় সাগর নন্দিনী-২ থেকে তেল অপসারণের কাজ বন্ধ ছিল। তাই সাবমার্সিবল পাম্প থেকে আগুন লাগার কোনো কারণ নেই। সিগারেটের আগুন থেকে এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে পারে।
গত ৪ জুলাই পৌর মিনি পার্ক এলাকায় সংবাদ সম্মেলনে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ঝালকাঠি ফায়ার স্টেশনে পর্যাপ্ত ফোম না থাকায় এই ধরনের আগুন নিয়ন্ত্রণে আসতে সময় লাগছে। নন্দিনী জাহাজে বিস্ফোরণের ঘটনায় এখন পর্যন্ত তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিস্ফোরক অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে প্রধান করে একটি কমিটি করা হয়। এর আগে ফায়ার সার্ভিস, ঝালকাঠি জেলা প্রশাসন ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের পক্ষ থেকে আলাদা দুটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।
এদিকে ঝালকাঠি নদীপাড়ের বাসিন্দা ও এলাকার মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি, এই এলাকায় অন্ততপক্ষে একটি নৌ ফায়ার স্টেশন নির্মাণ করা হোক।
সাগর নন্দিনী-২ নামের এই জাহাজটি মাত্র ছয় মাস আগে ২৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বন্দর থেকে জ্বালানি তেল নিয়ে চাঁদপুরে পদ্মা অয়েল কোম্পানির ডিপোতে যাওয়ার পথে ভোলার তুলাতুলি কাঠিরমাথা এলাকায় ডুবেছিল। তখন কুয়াশার মধ্যে বালুবাহী একটি নৌযানের সঙ্গে সংঘর্ষে ট্যাংকারটির তলা ফেটে যায়।
এর আগে, ২০২১ সালের ১২ নভেম্বর সুগন্ধা নদীর একই স্থানে একই কোম্পানির সাগর নন্দিনী-৩ জাহাজটিতেও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ওই বিস্ফোরণে পাঁচজন নিহত হন।
এদিকে ঝালকাঠি জেলা পরিষদের সদস্য ও জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান শামসুল ইকরাম পিরু এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে এ বিষয়ে কিছু মন্তব্য করেছেন, যা জনমনে নতুন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
তিনি লিখেছেন, ‘জাহাজের কেবিন বিস্ফোরণে জাহাজ থেকে অনেক দূরে উড়ে গিয়ে পড়ে আছে। কেবিনের নিচে থাকে ইঞ্জিনরুম। তেল থাকে জাহাজের সামনে। কেবিনের নিচে বা ইঞ্জিনরুমে তেলের বিস্ফোরণ হওয়ার কথা নয়। কেবিন বা ইঞ্জিনরুমে এমন কোনো শক্তিশালী বিস্ফোরক ছিল যা বিস্ফোরিত হয়ে পুরো কেবিন বাতাসে ভেসে অনেক দূরে পড়ে গিয়েছে।’
তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘কেন বারবার ঝালকাঠিতেই এমন ঘটছে? দুবার তেলের জাহাজ, একবার লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা কাকতালীয় হতে পারে? দেশের আর কোথাও এমন হয়েছে?’
নাশকতার আশঙ্কা করে বলেন, ‘এই ঝালকাঠিতেই কিন্তু বাংলা ভাই, আবদুর রহমানের বিচার হয়েছিল। এই শহরেই বিচারক হত্যা ও পিপিকে হত্যা করা হয়েছিল। যার স্মৃতি জজকোর্টের সামনেই সংরক্ষিত আছে।’
গত ১ জুলাই দুপুরে ঝালকাঠি সুগন্ধা নদীতে সাগর নন্দিনী-২ জাহাজের তেলের ট্যাংকারে আগুন লেগে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে জাহাজের ইঞ্জিনের ওপরের মাস্টার ব্রিজ (কর্ম্পাটমেন্ট) উড়ে যায়। জাহাজে থাকা ৯ জন লোকের মধ্যে চারজনকে স্থানীয়রা উদ্ধার করে ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়। চিকিৎসক আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে উন্নত চিকিৎসার জন্য বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করেন। আহত জাহাজের বাবুর্চি মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেনকে পুলিশ উদ্ধার করে। তিনি জানান, ঈদের দুদিন আগে চট্টগ্রাম থেকে প্রায় ১১ লাখ লিটার তেল নিয়ে ঝালকাঠি পদ্মা অয়েল কোম্পানির ডিপো নিকটবর্তী সুগন্ধা নদীতে আসে। বিস্ফোরণে জাহাজে থাকা ৯ জনের মধ্যে চারজন নিখোঁজ ছিল। নিখোঁজ চারজনের মধ্যে ট্যাংকারের চালক আকরাম খা (৪০), মো. মাস্টার রুহুল আমিন, গ্রিজার হৃদয় ও মো. সুপারভাইজার বেলাল। এদের মধ্যে একজনকে জাহাজের ভেতরে এবং অপর তিনজনকে উড়ে যাওয়া কম্পার্টমেন্টের ভেতরে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। মরদেহের ময়নাতদন্তসহ অন্যান্য প্রক্রিয়া শেষ করে প্রশাসনের মাধ্যমে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
জেলা পুলিশ, নৌপুলিশ, কোস্টগার্ড বিআইডব্লিউটিএ ও স্থানীয়দের সহযোগিতায় ফায়ার সার্ভিস জাহাজের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। দুর্ঘটনাকবলিত এলাকায় পুলিশ মোতায়েন ছিল। প্রথম দিনে নিখোঁজ কাউকে উদ্ধার করা যায়নি। উদ্ধারকারী জাহাজের মাধ্যমে দুর্ঘটনাকবলিত জাহাজটিকে ঘটনাস্থলে ভাসিয়ে রাখা হয়েছিল। দ্বিতীয় দিন তেল অপসারণের কাজ শুরু হয়। প্রথমে স্থানীয় দুটি কার্গোর মাধ্যমে এবং পরবর্তীতে সাগর নন্দিনী-৪ এর মাধ্যমে তেল আনলোড করা হয়েছে।
গত ৩ জুলাই সন্ধ্যায় পূর্বের দুর্ঘটনাকবলিত সাগর নন্দিনী-২ জাহাজ হতে সাগর নন্দিনী-৪ জাহাজে তেল অপসারণের সময় আকস্মিক বিস্ফোরণের ফলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ডিপো ও জাহাজ মালিকপক্ষের দেয়া তথ্যমতে, আনলোডের বাকি ছিল আনুমানিক ৫৩ হাজার ৫০৬ লিটার ডিজেল ও ৩ লাখ ৮০ হাজার ৫৬২ লিটার পেট্রল। ঘটনাস্থলে নিরাপত্তার জন্য পুলিশ মোতায়েন ছিল। দ্বিতীয়বার বিস্ফোরণের ফলে থানা পুলিশ, নৌপুলিশসহ জাহাজের বেশ কয়েকজন স্টাফ নদীতে পড়ে যায়। স্থানীয়রা ঝালকাঠি জেলা পুলিশের এএসআই গনেশ, এসআই (এবি) আ. হাকিম, মো. শওকত হোসেন, পলাশ মোল্লা, দ্বীপ, মো. মেহেদী এবং বরিশাল নৌপুলিশের এসআই মো. মোস্তফা কামাল, এটিএসআই মো. হেলাল উদ্দিন, মো. সিদ্দিকুর রহমান, নৌপুলিশের মাঝি কাওছার মুন্সি। এ ছাড়া তেলবাহী জাহাজ নন্দিনী-৪ জাহাজের কর্মী কাইয়ুম (৩৫), স্টাফ মো. শরীফকে উদ্ধার করে ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে ভর্তি করলে চিকিৎসক প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে ঝালকাঠি জেলা পুলিশের কনস্টেবল মো. শওকত হোসেন, কনস্টেবল দ্বীপ ও জাহাজ নন্দিনী-৪ জাহাজের স্টাফ শরীফের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাদের উন্নত চিকিৎসার জন্য বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রেরণ করেন। শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক পুলিশ কনস্টেবল শওকত ও নন্দিনী-৪ জাহাজের স্টাফ শরীফের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাদের শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে রেফার্ড করেন।
মন্তব্য করুন