নিজ সন্তানকে কোথায় পড়াবেন, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার অভিভাবকদের। কিন্তু, ঝিনাইদহ পৌর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষকদের বেলায় বোধহয় এই যুক্তি খাটে না। কারণ, প্রতিষ্ঠানপ্রধানের পক্ষ থেকে সম্প্রতি কয়েকজন শিক্ষককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, শিক্ষকরা যেন তাদের স্কুলেই সন্তানদের ভর্তি করান। এমনকি, নির্দেশনা বাস্তবায়নে চারজন শিক্ষককে কারণ দর্শানোর নোটিশও (শোকজ) দেওয়া হয়েছে। সিদ্ধান্ত না মানলে ওই শিক্ষকদের চাকরিচ্যুতি করার হুমকিও দিয়েছেন প্রতিষ্ঠানপ্রধান।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ১৬ জানুয়ারি ঝিনাইদহ পৌর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান শিক্ষক মোছা. শাহানাজ পারভীন চারজন শিক্ষককে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠান। নোটিশগুলোর কপি কালবেলার হাতে এসেছে। আলাদা আলাদা চিঠিতে শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছে, পৌর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ম্যানেজিং কমিটির ২০২৩ সালের ১ ও ৭ নম্বর সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের সন্তানকে নিজ বিদ্যালয়ের বাইরে অন্য বিদ্যালয়ে ভর্তি করতে পারবেন না এবং যাদের সন্তান অন্য বিদ্যালয়ে পড়ে তাদের সন্তানকে ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে নিজ বিদ্যালয়ে ভর্তি করবেন। বিষয়টি ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি নিজে আপনাদের অবগত করেছিলেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আপনি এই সিদ্ধান্ত অমান্য করে আপনার সন্তানকে এখনো এই বিদ্যালয়ে ভর্তি করেননি। যেটা বিদ্যালয়ের স্বার্থ হীনকার কাজ। বেসরকারি চাকরি বিধি মোতাবেক আপনার এ কর্মকাণ্ড আচরণবিধি পরিপন্থি ও বিদ্যালয়ের সুনাম ক্ষুণ্ন করে। আপনার এই ‘অসদারচণ’ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বেসরকারি চাকরি বিধিমোতাবেক আপনার বিরুদ্ধে কেন বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নিকট শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ করা হবে না তা এই পত্র প্রাপ্তির তিন কর্মদিবসের মধ্যে লিখিতভাবে জানাতে হবে।
এ বিষয়ে শোকজ পাওয়া চারজন শিক্ষকের মধ্যে দুজনের সাথে কথা বলেছে কালবেলা। তারা জানিয়েছেন, পৌর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এমপিভুক্ত। যে কারণে ম্যানেজিং কমিটি বা প্রতিষ্ঠানপ্রধানের ক্ষমতা অনেক। কথায় কথায় তারা যে কারও চাকরি খেয়ে দিতে পারেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানের এ ধরনের সিদ্ধান্ত আমাদের অবাক করেছে। সন্তানকে কোথায় পড়াব তা অভিভাবক হিসেবে আমরা ঠিক করব, প্রতিষ্ঠান কেন ঠিক করে দিবে? আবার, আমার ছেলে বা মেয়ে এক স্কুলে ভর্তি হয়ে সেখানকার বন্ধুদের ছেড়ে আমাদের স্কুলে আসতে চাচ্ছে না। কিন্তু, তারপরও প্রতিষ্ঠানপ্রধান কারণ দর্শানোর নোটিশের পাশাপাশি চাকরিচ্যুতির হুমকি দিয়েছেন। এটি ভীষণ অন্যায়। এ ধরনের কর্মকাণ্ডে চাকরি নিয়ে শঙ্কায় দিন পার করছি।’
জানতে চাইলে ঝিনাইদহ পৌর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান শিক্ষক মোছা. শাহানাজ পারভীন শিক্ষকদের শোকজ করার বিষয়টি স্বীকার করেন। অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে শিক্ষকদের চাপ দেওয়ার বিষয়টি অকপটে স্বীকার করেছেন তিনি। তবে, বারবার প্রতিবেদকের কাছে কোনো শিক্ষক এই বিষয়ে অভিযোগ করেছেন তা জানতে চান।
কোন নীতিমালার আওতায় শিক্ষকদের শোকজ করা হয়েছে জানতে চাইলে শাহানাজ পারভীন কালবেলাকে বলেন, ‘আমার বাচ্চাদেরও এই স্কুলে ভর্তি করিয়েছি। আমরা স্কুলটিকে সেরা বানানোর লড়াইয়ে নেমেছি। সে কারণে গত বছর ম্যানেজিং কমিটির এক সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, যেসব শিক্ষকের বাচ্চা বাইরের স্কুলে পড়ছেন, তাদের বাচ্চাকে যাতে এই স্কুলে ভর্তি করানো হয়। এ বছর একজন শিক্ষক তার বাচ্চাকে অন্য স্কুলে ভর্তি করানোয় আমাদের তো মাথা খারাপ। তাহলে আমরা কমিটি কি করছি?’
তিনি বলেন, ‘৫-৬ জন শিক্ষকের বাচ্চা অন্য স্কুলে পড়ে। তারা যেন বাচ্চাদের এই স্কুলে ভর্তি করান সেটিই অনুরোধ করা হয়েছে। পরবর্তীতে এটিকে হুমকিস্বরূপ মনে হয়েছে বিধায় গতকাল (বৃহস্পতিবার) অনুষ্ঠিত ম্যানেজিং কমিটির সভায় শোকজ বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেখানে আরও সিদ্ধান্ত হয়েছে, শিক্ষকরা স্কুলের ভালো চাইলে তাদের বাচ্চা এই স্কুলে নিয়ে আসতে পারেন।’
ঝিনাইদহ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মুহম্মদ আব্দুল মালেক বলেন, ‘সাধারণ জ্ঞানে বলা যায় প্রতিষ্ঠান চাইলে এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। তবে এখনো কারও অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
জানতে চাইলে বিদ্যালটির ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও ঝিনাইদহ পৌরসভার মেয়র কাইয়ুম শাহরিয়ার জাহেদী হিজল কালবেলাকে বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা জানেন।’
মন্তব্য করুন