সময়ের পরিবর্তন, আধুনিকায়ন ও প্রযুক্তির উৎকর্ষে বিশ্ব এখন গ্লোবাল ভিলেজ। দেশের একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এখন আর বিশ্বায়নের প্রভাব এড়ানোর সুযোগ নেই। ফলে আমাদের গ্রামগুলো বদলে যাচ্ছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চিরচেনা জনপথ হয়ে উঠছে শহর। যতই নগরায়ণ হোক, তাই বলে কী গ্রাম থাকবে না?
পরিবর্তনের এ ধারায় কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ার গ্রামগঞ্জ থেকে হারিয়ে গেছে শিশুদের খেলনা সুপারি পাতার গাড়ি। একসময় এ জনপদে যত্রতত্র চোখে পড়ত সুপারি পাতার গাড়িতে শিশুদের খেলার দৃশ্য। বিজ্ঞানের উৎকর্ষের ছোঁয়ায় আর আধুনিক খেলনাসামগ্রীর দাপটে এখন আর দেখা যায় না গ্রামীণ ঐতিহ্যের নিদর্শন সুপারি পাতার গাড়ি।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কয়েক যুগ আগেও এই উপজেলার পাড়া ও মহল্লার শিশুরা সুপারি গাছ থেকে খসে পড়া সুপারির খোলকে গাড়ি বানিয়ে খেলাধুলা করত। সুপারি গাছের শুকনো পাতার খোলে বানানো গাড়িতে একজন বসে থাকত আর অন্যজন ধুলো উড়িয়ে সেটা টেনে নিয়ে ছুটে চলত। এভাবেই শিশুরা গাড়ি চড়ার আনন্দ ভাগাভাগি করে খেলাধুলা করত।
কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা ফারুক আহমেদের সঙ্গে, তিনি শৈশবের স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমাদের ছেলেবেলা ছিল উন্মুক্ত ও খেলাধুলায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমরা পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা করে সময় কাটাতাম। এখনকার শিশুরা পড়াশোনা আর মোবাইল নিয়ে সময় কাটায়। আমরা তখনকার সময় বন্ধুরা মিলে কতরকম চমকপ্রদ গ্রামীণ খেলায় মজে থাকতাম। এসব খেলার মধ্যে সুপারি পাতার গাড়িও একটি। আমরা বন্ধুরা সুপারি গাছের শুকনো পাতাকে গাড়ি হিসেবে ব্যবহার করে খেলতাম। একজন পাতার সরু অংশে ধরে সামনের দিকে টেনে নিয়ে যেত আর আরেকজন পাতার খোলটাতে বসে মজা নিত। এভাবে আমরা গাড়ি চড়ার আনন্দ উপভোগ করতাম। অবশ্য এখন আর তেমন একটা সুপারি গাছও দেখা যায় না। এই আধুনিক যুগের শিশুদের খেলতেও দেখা যায় না সুপারি পাতার গাড়িতে।
গ্রামীণ খেলাধুলা বিষয়ে উপজেলা সদরের বাসিন্দা আবু তাহের জানান, কয়েক যুগ আগেও শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ গ্রামে বসবাস করত। তখনকার ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলার প্রতি আকর্ষণ ছিল। এখন গ্রামগঞ্জেও ঢুকে গেছে শহুরে সংস্কৃতি, যে কারণে এই আধুনিক যুগে বিলুপ্ত প্রায় আনন্দ ভাগাভাগি করার মতো গ্রামীণ খেলাধুলা। সেইসব খেলাধুলার মধ্যে বৌচি, কানামাছি ভোঁ ভোঁ, গোল্লাছুট, ইচিং বিচিং চিচিং চা ও সুপারি পাতার হাতে টানা গাড়ি ছিল অন্যতম।
এ বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আবু হাসনাত মো. মহিউদ্দিন মুবিন কালবেলাকে বলেন, বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার এই যুগে আমাদের ছেলেমেয়েরা ইলেকট্রনিক্স খেলনা নিয়ে মগ্ন থাকে। মোবাইল, কম্পিউটার, গেমস ও ইন্টারনেট দুনিয়ায় মগ্ন থাকে তারা। যার ফলে বাঙালি সংস্কৃতির সুপারি পাতার গাড়ির মতো আরও বহু গ্রামীণ ঐতিহ্যের খেলা দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। এতে করে আধুনিক প্রজন্মের শিশুরা বাঙালির গ্রামীণ ঐতিহ্যের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, শুধু গ্রামীণ ঐতিহ্যের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হওয়াই নয়, পাশাপাশি এ প্রজন্মের শিশুরা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতেও ভুগছে। নিয়মিত খেলাধুলা শিশু-কিশোরদের সুস্থতা ধরে রাখতে সহায়তা করে। কিন্তু কায়িক শ্রম ও শরীরচর্চার অভাবে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়ে নানা অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত হচ্ছে তারা।
মন্তব্য করুন