আধুনিক বিজ্ঞানের উৎকর্ষের যুগে ফসলে নানারকম কীটনাশক ব্যবহারের ফলে কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ায় বিলুপ্ত হয়ে পড়ছে কৃষকবান্ধব পোকা লেডিবাগ। এক সময় এই উপজেলার ফসলি মাঠ থেকে শুরু করে বাড়ির আঙিনায় আবাদ করা সবজি গাছে এই পোকাদের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য হারে লক্ষ্য করা যেত। এরা ফসলের ক্ষতিকারক পোকা-মাকড় খেয়ে ফসল রক্ষায় ভূমিকা রাখত। লেডিবাগ পোকাকে একসময় ফসলের পাহারাদার পোকাও বলা হতো।
জানা গেছে, কীটপতঙ্গ বিদ্যা অনুযায়ী লেডিবাগ Hemiptra গোত্রের অথবা অন্তর্ভুক্ত Coleoptra গোত্রের একটি পতঙ্গ। পুরো পৃথিবীতে এদের ৫ হাজারেরও বেশি প্রজাতি রয়েছে। বহুবর্ষ পূর্বে ইউরোপিয়ান গম্বুজ পিঠধারী গুবরে পোকার নাম দিয়েছিল লেডিবার্ড, যা পরে আমেরিকায় লেডিবাগ নামে প্রতিস্থাপিত করা হয়। কীটতত্ত্ববিদদের কাছে এটি Lady beetle নামেই পরিচিত।
উপজেলা কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, কৃষকবান্ধব লেডিবাগ লাল বা কমলা রঙের একটি গোবরে পোকা। এরা গোলাকৃতি গম্বুজের মতো হয়। দেখতে অনেকটা কচ্ছপের মতো। আকারে ছোট পোকাটির লাল রঙের শরীরে কালো কালো ফোটা বা লম্বা লম্বা দাগ থাকে। কৃষকবান্ধব এই পোকা উৎপাদনশীল শস্যের ক্ষতিকারক পোকামাকড় দমনে সহায়তা করে। এরা চেলাপোকা, আঁশযুক্ত পোকা, সাদাপোকা ইত্যাদি খেতে ভালোবাসে। পূর্ণ বয়স্ক লেডিবাগ বিটল পোকা বাদামী ঘাস ফড়িং, সাদাপিট ঘাস ফড়িং, ছাতরা পোকা, জাব পোকা ও ফসলের ক্ষতিকারক অন্যান্য পোকার লার্ভা ও ডিম খেয়ে ফসলকে ক্ষতির হাত থেকে সুরক্ষা দেয়। এরা একদিনে শতাধিক লার্ভা পোকা খেতে পারে। প্রাপ্তবয়স্ক লেডিবাগ একদিনে অর্ধশতাধিক গোগ্রাসে খেতে পারে। এ ছাড়াও এরা অন্য প্রতিরোধ ব্যবস্থাতেও অসাধারণ। এরা এমন কিছু পেপটাইড (অতি ছোট প্রিটিন) ও হারমোনাইন নামের এক ধরনের যৌগ তৈরি করে যা দ্বারা ফসলের ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলে। লেডিবাগরা বসবাসের জন্য উষ্ণ আবহাওয়াযুক্ত পরিবেশ পছন্দ করে। তাই এরা শীতকালে শীত নিদ্রা দিয়ে কোনোরকমে শীতকালটা কাটিয়ে দেয়।
স্থানীয় কৃষক এরশাদুল ইসলাম বলেন, এক সময় লেডিবাগ পোকা ফসলের মাঠে সচরাচর চোখে পড়ত। ইদানিং এই পোকাটির উপস্থিতি তেমন একটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। ফসলে অতিমাত্রায় কীটনাশক ব্যবহারের কারণে লেডিবাগসহ উপকারী অনেক পোকা দিন দিন কমে যাচ্ছে।
আরেক কৃষক মশিউল আলম সরকার বলেন, ফসলের মাঠে দেখা যাওয়া সব পোকা ক্ষতিকারক পোকা নয়, এদের মধ্যে উপকারী পোকাও রয়েছে। এদের মধ্যে অন্যতম উপকারী একটি পোকা লেডিবাগ। তবে দিন দিন ফসলের মাঠে অতিমাত্রায় কীটনাশক দেওয়ার কারণে ক্ষতিকর পোকামাকড়ের সঙ্গে সঙ্গে উপকারী পোকাগুলোও বিলুপ্ত হয়ে পড়ছে।
ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. মাসুদ রানা কালবেলাকে বলেন, ফসলের জমিতে ক্ষতিকর পোকা যেমন থাকে তেমনি উপকারী পোকাও থাকে। এসব উপকারী পোকা ক্ষতিকর পোকা খেয়ে, ক্ষতিকর পোকার ডিম নষ্ট করে, আহত করে, প্রজনন প্রক্রিয়া ব্যাহত করে, বাচ্চা নষ্ট করাসহ বিভিন্নভাবে ক্ষতিকর পোকাকে ধ্বংস করে। পূর্ণবয়স্ক লেডিবাগ (লেডি বার্ড) বিটল এবং এদের বাচ্চা বাদামি গাছ ফড়িং, সাদা পিট গাছ ফড়িং, জাব পোকা ও অন্যান্য ক্ষতিকর পোকার ডিম ও কিড়া খেয়ে ফসলকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। ফসলে অধিক মাত্রায় কীটনাশক ব্যবহারের ফলে এসব বন্ধু পোকার সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে এবং এতে পরিবেশের ভারসাম্যও নষ্ট হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (আইপিএম) পদ্ধতি অনুসরণ করে আমরা বালাই নাশকের ঝুঁকি হ্রাস এবং বন্ধু পোকামাকড়ের বংশ-বিস্তার বৃদ্ধি করতে পারি। বন্ধু পোকামাকড় সংরক্ষণ ও লালন পালন করেও আমরা ফসলে ব্যবহার করতে পারি। উপকারী পোকামাকড়ের বংশবৃদ্ধি ও সংরক্ষণের জন্য ফসলে এলোপাতাড়ি বালাইনাশক ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এসব বিষয়ে উপজেলা কৃষি অফিস প্রান্তিক কৃষকদের নানা পরামর্শ দিয়ে আসছে।
মন্তব্য করুন