কুমিল্লার রসমালাইয়ের নাম শুনলেই জিহ্বায় পানি আসে না এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। জিআই পণ্য বা ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া এই সুস্বাদু মিষ্টি কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়।
এ স্বীকৃতি কুমিল্লার ইতিহাস-ঐতিহ্যের পারদে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। কুমিল্লার প্রত্নতাত্ত্বিক বা দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে আসা ভ্রমণপিপাসুদের প্রথম ইচ্ছা থাকে কুমিল্লার বিখ্যাত রসমালাইয়ের স্বাদ নেওয়া। সঙ্গে প্রিয় ব্যক্তি বা পরিবারের সদস্যদের জন্যও কিনে নিতে ভোলেন না তারা।
অতিথি আপায়্যন কিংবা ছোট-বড় অনুষ্ঠান আয়োজন সবকিছুতেই রসমালাই থাকে সব সময়। আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে বেড়াতে গেলে এ অঞ্চলের মানুষ রসমালাইকেই বেশি গুরুত্ব দেন। আবার রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেশি-বিদেশি অতিথিদের আপ্যায়ন করা হয় কুমিল্লার রসমালাই দিয়ে।
তবে আসল রসমালাইয়ের স্বাদ পেতে চাইলে যেতে হবে আসল মাতৃভাণ্ডারে। কারণ কুমিল্লা শহরকে ঘিরে নকল রসমালাইয়ের অগণিত দোকান গড়ে ওঠায় আসল যে রসমালাই তার স্বাদ অনেকেই পান না।
কুমিল্লার বিখ্যাত এই রসমলাই পেতে যেতে হবে কুমিল্লা শহরের মনোহরপুরের কুমিল্লা মাতৃভাণ্ডার নামের একটি প্রতিষ্ঠানে। এখানেই একটি ভিটি-পাকা টিনশেড ঘরে তৈরি ও বিক্রি হয় এ রসমালাই। ছুটির দিনগুলোতে রসমালাই কেনার জন্য উপচেপড়া ভিড় থাকে শতবর্ষী মিষ্টান্ন বিক্রির এ দোকানটিতে।
মাতৃভাণ্ডার নামেই এখন জেলার বাইরে কুমিল্লার রসমালাইকে চিনে। তবে মাতৃভাণ্ডার ছাড়াও নগরীর মনোহরপুরের ভগবতীপেড়া ভাণ্ডার, শীতল ভাণ্ডার, পোড়াবাড়ি, জেনিস, জলযোগ, মালাই, মিঠাই নামের দোকানগুলোতে মিলবে রসমালাই।
এ ছাড়াও কুমিল্লার এই খ্যাতিমান খাবার নিয়ে এক শ্রেণির মানুষ প্রতারণা করছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কুমিল্লার অংশে প্রবেশ করতেই চোখে পড়বে মহাসড়কের দুপাশে শত শত রসমালাইয়ের দোকান। এসব মিষ্টির দোকানের অধিকাংশই নকল মাতৃভাণ্ডার। যদিও নকল মাতৃভাণ্ডারের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্টদের দাবি, তারা নিয়ম মেনেই ব্যবসা করছেন। এতে বিএসটিআইয়ের অনুমোদন আছে।
কুমিল্লার রসমলাইয়ের দোকানগুলোর মধ্যে মাতৃভাণ্ডারেই প্রতিদিন গড়ে ৮/৯ মণ রসমালাই তৈরি করা হয়। এসব দোকানে প্রতিদিন ভোরে ও বিকেলে ৫-৬ জন দুধ ব্যবসায়ী প্রায় ১৫-২০ মণ দুধ সরবরাহ করে থাকেন। এখানে প্রতি কেজি রসমালাই বিক্রি হয় ৩৫০ টাকা দরে। এ ছাড়াও এখানে পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি ৩০০ টাকা কেজি, মালাইকারি ৩৫০ টাকা কেজি, ক্ষির ৬০০ টাকা কেজি, ছানা মুড়কি ৮০০ টাকা কেজি, স্পেশাল পেড়া ৬০০ টাকা কেজি এবং দধি ২৪০ টাকা কেজি। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে ক্রেতাদের কাছে চাহিদার শীর্ষে মাতৃভাণ্ডারের রসমালাই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুমিল্লায় রসমালাইয়ের আদি উদ্ভাবক ত্রিপুরা রাজ্যের ঘোষ সম্প্রদায়। ঊনিশ শতকের প্রথম দিকে ত্রিপুরা থেকে তারা বিভিন্ন পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে চাহিদা অনুযায়ী এ অঞ্চলের লোকদের বাহারি রকমের মিষ্টি সরবরাহ করতেন। সে সময় রসগোল্লার সঙ্গে মালাইকারির প্রলেপ দেওয়া এক রকম মিষ্টির প্রচলনও ছিল। কেউ কেউ একে মালাই রসগোল্লা বলতেন। পরে সময়ে দুধ জ্বাল দিয়ে খির বানিয়ে তার মধ্যে শুকনো রসগোল্লা ডুবিয়ে তৈরি করা হয় খিরসাহ রসগোল্লা। এর নাম দেওয়া হয় ক্ষিরভোগ।
১৯৩০ সালের দিকে এই রসগোল্লার আকার ছোট করে দুধের ক্ষিরের মধ্যে ডুবিয়ে পরিবেশন শুরু হয় এবং একপর্যায়ে এর নামকরণ হয় রসমালাই। আর ওই সময় থেকেই ক্ষণীন্দ্র সেন কুমিল্লার মিষ্টি ব্যবসায় রসমালাই বানিয়ে পরিচিতি পেতে থাকেন। পরে তার সন্তান মুক্তিযোদ্ধা শংকর সেন গুপ্তের হাত ধরে এটি কুমিল্লায় ব্যাপকভাবে বিকশিত হয় এবং রসমালাইয়ের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে দেশ-বিদেশে।
কুমিল্লায় বিখ্যাত মাতৃভাণ্ডার রসমালাইয়ের ব্যবসা পরিচালনা করতেন তখন শংকর সেন গুপ্ত। মাতৃভাণ্ডার নামেই কুমিল্লায় সকলের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন। কিন্তু পাঁচ বছর আগে শংকর সেন গুপ্ত মারা যাওয়ায় বর্তমানে তার ছেলে অনির্বাণ সেনগুপ্ত মাতৃভাণ্ডার রসমালাইয়ের ব্যবসা পরিচালনা করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষার্থী কোনো চাকরিতে না গিয়ে বংশ পরম্পরায় পরিবারের মিষ্টান্ন ব্যবসায় শামিল হন।
কুমিল্লা মাতৃভাণ্ডারে বর্তমানে উত্তম দে এবং ক্ষিতিষ মোদক নামে দুজন অভিজ্ঞ কারিগর এই রসমালাই তৈরি করছেন। তাদের কাছ থেকে নতুন প্রজন্মের কারিগররা রসমালাই তৈরি শিখে নিচ্ছেন।
কারিগর ক্ষিতিষ মোদক বলেন, কুমিল্লার মাতৃভাণ্ডারের ঐতিহ্যবাহী রসমালাই তৈরির প্রক্রিয়া খুবই সহজ। একটি পাতিলে বা কড়াইয়ে একমণ দুধ দুই ঘণ্টা ধরে জ্বাল দিলে তা ঘন হয়ে ১৩/১৪ কেজি ক্ষির তৈরি হয়। এই দুধ থেকে পাওয়া ছানার সঙ্গে কিছু ময়দা দিয়ে খামির তৈরি করে বানানো হয় ছোট ছোট গুলি বা রসগোল্লা। এক কেজি ছানাতে এক ছটাক পরিমাণ ময়দা দিয়ে এ গুলি বানানো যায়।
মাতৃভাণ্ডারের কারিগর উত্তম দে জানান, এক মণ দুধ দিয়ে ঘন ক্ষির তৈরি করে তাতে ছোট গুটি বা শুকনো রসগোল্লা দিয়ে ১৫ কেজির মতো রসমালাই বানানো যায়। প্রতিদিন ৩ বার নির্দিষ্ট কারিগর দিয়ে রসমালাই তৈরি করা হয়।
ডায়াবেটিক রোগীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মিষ্টি এড়িয়ে চলেন। কিন্তু তারা যাতে কুমিল্লার রসমালাইয়ের স্বাদ থেকে বঞ্চিত না হয়, সেজন্য এখন ডায়াবেটিক রসমালাইও তৈরি হচ্ছে। এটি প্রথম তৈরি শুরু করে শহরের নজরুল এভিনিউতে অবস্থিত অমৃত মিষ্টি ভাণ্ডার।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাইরে সাইনবোর্ডে বড় করে লেখা ‘কুমিল্লার মাতৃভাণ্ডারের শো রুম’। ভেতরে মাতৃভাণ্ডার সুইটস লিমিটেড। ওই প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক ইউসুফ মিয়া জানান, আমরা কোনোভাবেই গ্রাহকদের প্রতারিত করছি না। বিক্রির আগে আমরা অবশ্যই জানিয়ে দিই এটা আসল মাতৃভাণ্ডার নয়। কিন্তু গ্রাহকরা তারপরও কেনেন। এর কারণ হলো, তারা দামে ছাড় পান। আবার শহরের ভেতরে ঢুকে রসমালাই কেনার সুযোগ না পেয়েও কেউ কেউ এখান থেকে রসমালাই কিনে নিয়ে যান।
কুমিল্লার শতবর্ষী প্রতিষ্ঠান মনোহরপুরের মাতৃভাণ্ডারের স্বত্বাধিকারী অনির্বাণ সেনগুপ্ত বলেন, প্রতিদিনই রসমালাইয়ের চাহিদা থাকে অনেক। চাহিদা মতো দুধ না পেলে, রসমালাইও কম তৈরি হয়। মান ও গুণ ধরে রাখার জন্য আমরা সব সময় চেষ্টা করি।
তিনি বলেন, মহাসড়কের পাশে আমাদের নাম ব্যবহার করে যেসব প্রতিষ্ঠান রসমালাই বিক্রি করছে, তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তাদের কারণে যেমনিভাবে ক্রেতারা প্রতারিত হচ্ছে, তেমনি করে কুমিল্লার ঐহিত্যবাহী রসমালাইয়ের সুনাম নষ্ট হচ্ছে।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক শান্তিরঞ্জন ভৌমিক কালবেলাকে জানান, মাতৃভাণ্ডার সারাবিশ্বে কুমিল্লার মুখ উজ্জ্বল করেছে। কুমিল্লার অনেক ঐতিহ্য ধ্বংস হয়ে গেছে। তবে মাতৃভাণ্ডার ধ্বংস হয়নি বরং জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এটা গৌরবের বিষয়।
মন্তব্য করুন