কারও বেড়েছে ২০০ গুণ। কারও ৫০০ গুণ। কারও এই সীমানাও ছাড়িয়ে গেছে। আবারো কারও বেলায় কল্পনাকেও হার মানিয়েছে! যিনি আগে দিতেন ৩০০০ টাকা, তার ওপর ট্যাক্স ধার্য্য হয়েছে ১৫০০০ টাকা। কারও বেলায় ঘটেছে তুঘলকি কারবার! ৮০০ টাকার বার্ষিক হোল্ডিং ট্যাক্স গিয়ে ঠেকেছে ১৮০০০ টাকায়! এটি সম্প্রতি নগরবাসীর জন্য ধার্য করা সিলেট সিটি করপোরেশনের হোল্ডিং ট্যাক্সের চিত্র! সিলেট সিটিতে হোল্ডিং ট্যাক্স নিয়ে এমন তুলকালাম কাণ্ডে বাসা-বাড়ির মালিক, কাউন্সিলর ও বসবাসকারী নগরবাসীর মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। সিটির ট্যাক্সকাণ্ডে তারা অবাক! তারা রীতিমতো ক্ষুদ্ধ। বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল- বাসদ এ ইস্যুতে আন্দোলনে নেমেছে। ট্যাক্স বাতিলের দাবিতে তারা সোমবার (৬ মে) বিকেল ৫টায় নগরীতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করে।
তবে ট্যাক্স নিয়ে জনমনে ব্যাপক ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলেও সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী এখনো কোনো মন্তব্য করেননি বা প্রেসনোটও দেননি। সিসিকের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে- কারো কাছে ট্যাক্স বেশি মনে হলে লিখিতভাবে আপত্তি জানানোর সুযোগ রয়েছে। সেটি যাচাই করে পরবর্তীতে তার ট্যাক্স পুনঃনির্ধারণ করা হবে। এ ছাড়া বর্তমানে আরোপিত হোল্ডিং ট্যাক্সের অ্যাসেসমেন্ট (মূল্যায়ন) এই পরিষদের সময়ে হয়নি। হয়েছে সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী দায়িত্বে থাকাকালে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সভাপতি ফারক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, হোল্ডিং ট্যাক্স নিয়ে এমন অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত নগরপিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। বিষয়টি নিয়ে প্রথমে নগরবাসীর সঙ্গে সিসিক মতবিনিময় করে শতকরা কতভাগ ট্যাক্স বাড়াবে তা নির্ধারণ করতে পারত। তিনি বলেন, সময় এখনো ফুরিয়ে যায়নি, বর্তমান হোল্ডিং ট্যাক্সের কার্যক্রম স্থগিত করে একটি সার্বজনিন সভা করে সকলের মতামতের ভিত্তিতে হোল্ডিং ট্যাক্সের হার নির্ধারণ করা হোক।
সিলেট মেট্রোপলিটন চেম্বারের সিনিয়র সহসভাপতি আব্দুল জব্বার জলিল বলেন, যারা হোল্ডিং ট্যাক্স দেয় তাদের উপর বোঝা না চাপিয়ে নতুন ট্যাক্সদাতা তৈরী করা উচিত। হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়াবার আগে নাগরিক সুযোগ সুবিধা বাড়াতে হবে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই সময়ে যখন মানুষের নাভিশ্বাস তখন এমন ভৌতিক হোল্ডিং ট্যাক্স মেনে নেয়া যায় না। এই কার্যক্রম স্থগিত করে সহনীয় হারে হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়ানো হউক।
সোমবার (৬ মে) বেলা ২টার দিকে নগরভবনে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের প্রাঙ্গণজুড়ে শামিয়ানা টানিয়ে করা হয়েছে বড় একটি ক্যাম্প। ক্যাম্পটি শুরু হয়েছে ৩০ এপ্রিল থেকে, চলবে ১৪ মে পর্যন্ত। তবে সরকারি ছুটির দিন ক্যাম্পে কোনো কার্যক্রম হবে না। ক্যাম্পের মধ্যে রয়েছে ৪০টির মতো বুথ। এর মধ্যে প্রতিটি ওয়ার্ডের জন্য আলাদা বুথ, একটি ইনফরমেশনের জন্য এবং বাকিগুলো লিখিতভাবে আপত্তি জানানোর। ক্যাম্পের বিভিন্ন খুঁটিতে লাগানো রয়েছে হোল্ডিং ট্যাক্স-বিষয়ক নানা তথ্যসম্বলিত ফেস্টুন। তথ্য জানা বা ট্যাক্স দেওয়ার ওয়ার্ড-নির্দিষ্ট কয়েকটি বুথের সামনে দেখা গেলো নারী-পুরুষের দীর্ঘ সারি। এছাড়া প্রাঙ্গণজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন লোকজন। সবার মুখে একটাই কথা- হঠাৎ করে হোল্ডিং ট্যাক্স খুব বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে সিসিক কর্তৃপক্ষ। যা তাদের জন্য পরিশোধ করা কষ্টদায়ক হবে। তবে বেশ কয়েকজনকে ট্যাক্স পরিশোধ করতেও দেখা গেছে। এদিকে শুধু তথ্য জানা বা ট্যাক্স দেওয়ার ওয়ার্ড-নির্দিষ্ট বুথগুলোর সামনেই লম্বা সারি নয়, আপত্তি জানানোর কয়েকটি বুথের সামনেও দেখা গেলো মানুষের বেশ ভিড়। তারা নির্দিষ্টি ডি-ফরম পূরণ করে লিখিতভাবে তাদের আপত্তি জানাচ্ছেন।
আপত্তি-বুথের সামনে দাঁড়ানো মহানগরের ১৭ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা রুবেল আহমদের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তিনি বলেন- ‘আমার থাকার এবং দোকানকোটা- দুটোরই হোল্ডিং ট্যাক্স অতিরিক্ত হারে বাড়ানো হয়েছে। আমার থাকার ঘর এক তলা, পাকা। আগে বছরে ট্যাক্স দিতাম ৫০০ টাকা। এখন নতুন করে নির্ধারণ করা হয়েছে ৮ হাজার টাকা। দোকানকোটার জন্য আগে বছরে ট্যাক্স দিতাম ৮০০ টাকা। এখন দিতে হবে ১৮ হাজার টাকা। এই পরিমাণের টাকা দেওয়া কি সম্ভব? বর্তমানে তো খেয়ে-পরে বাঁচাই দায়, এই সময়ে যদি সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ আমাদের ঘাড়ের উপর এমন ট্যাক্স চাপিয়ে দিয়েছে। আমি তো রীতিমতো দিশাহারা হয়ে গেছি। তাই লিখিত আপত্তি জানাবো। দেখি পরবর্তীতে কী হয়।’
হোল্ডিং ট্যাক্সের বিষয় নিয়ে কথা হয় প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মো. মতিউর রহমান খানের সঙ্গে। তিনি বলেন- ‘হোল্ডিং ট্যাক্সের জন্য দুই ধরণের অ্যাসেসমেন্ট (মূল্যায়ন) করা হয়। একটি জেনারেল অ্যাসেসমেন্ট, ৫ বছর পর পর হয়। আর আরেকটি অ্যাসেসমেন্ট করা হয় প্রতি বছর, সিসিকের রাজস্ব শাখার নিজস্ব লোক দিয়ে। তবে সিসিকে ২০০৫ সালের পর কোনো অ্যাসেসমেন্ট হয়নি। ২০০৫ সালের অ্যাসেসমেন্টের নির্ধারিত হোল্ডিং ট্যাক্স ২০০৭ সাল থেকে কার্যকর হয়। তবে ২০১১ সাল থেকে গণপূর্ত অধিদপ্তর (পিডব্লিউডি) কর্তৃক সিটি করপোরেশনের জন্য নির্ধারিত হোল্ডিং ট্যাক্স নগরবাসীর কাছ থেকে আদায় করা হতো। তবে বর্তমানে আরোপিত হোল্ডিং ট্যাক্সের অ্যাসেসমেন্ট ২০১৯-২০ অর্থবছরে করা হয় এবং এখন সেটি মহানগরের পুরাতন ২৭টি ওয়ার্ডের জন্য কার্যকর করা হয়েছে। আর নতুন ওয়ার্ডগুলোতে অ্যাসেসমেন্টের কাজ চলমান রয়েছে, শেষ হলে এসব ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের হোল্ডিং ট্যাক্সের পরিমাণ জানিয়ে দেওয়া হবে।’
সিসিক সূত্র জানায়, বর্তমানে নির্ধারিত হোল্ডিং ট্যাক্সের জন্য ফিল্ড সার্ভে হয় ২০১৯-২০ অর্থবছরে। ২০২১ সালের আগস্টে তৎকালীন সিসিক পরিষদের বিশেষ সভায় সেটি পাস হয়। কর ধার্য্যের অর্থবছর নির্ধারণ করা হয় ২০২১-২২ সাল। ওই অ্যাসেসমেন্টে মোট ৭৫ হাজার ৪শত ৩০ টি হোল্ডিংয়ে ১ শত তেরো কোটি ২৭ লক্ষ ৭ হাজার ৪ শত ৪৫ টাকা লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। সেটি অনুমোদনের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হলে পরে ২০২১ সালের অক্টোবরে তা অনুমোদিত হয়।
সিসিকের সম্প্রতি আরোপিত হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণের পদ্ধতি সম্পর্কে মো. মতিউর রহমান খান বলেন- ‘ইমারত ও জমির উপর কর ৭%, ময়লা নিষ্কাশন রেট ৭%, সড়কবাতি রেট ৭% ও পানি ৩%- এই মোট ২০%। অন্যদিকে, স্থাপনা পাকা হলে প্রতি বর্গফুট ৫, আধা-পাকা ৩, কলোনি ৫ ও বাণিজ্যিক ৭ টাকা।’
ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন- ‘যদি কারো হোল্ডিং-এর ভাড়া মূল্য প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা হয়, তবে নিজে ব্যবহারের ক্ষেত্রে কর ভিত্তি হিসাবের জন্য তার হোল্ডিং-এর বার্ষিক মূল্য হবে ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা এবং হোল্ডিং ট্যাক্স-এর পরিমাণ হবে বার্ষিক ১২ হাজার টাকা। তবে সিসিক ছাড় দিয়েছে। যেমন- রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বাবদ ২ মাসের ভাড়া মূল্যের সমপরিমাণ অর্থ (যদি) ১০ হাজার টাকা ধরা হয়েছে। এছাড়া মালিক নিজে ভবন ব্যবহার করলে, ভবনের বার্ষিক মোট মূল্য থেকে রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বাবদ অর্থ ছাড় দেয়ার পর অবশিষ্ট ভাড়া মূল্যের উপর আরও ৪০% ছাড় দেওয়া হয়েছে। সব ছাড়ের পর (মাসিক ভাড়া ১০ হাজার হিসাব ধরে) বার্ষিক ১ লাখ ২০ হাজার টাকা নয়, অর্ধেক ভাড়া অর্থাৎ- ৬০ হাজার টাকার করের ভিত্তি হিসাবে বার্ষিক হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণ করা হয়েছে।’
বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামানের মোবাইলে বার বার ফোন দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা সাজলু লস্কর বলেন, হোল্ডিং ট্যাক্স নিয়ে ভয় পাবার কিছু নেই। মেয়র বিষয়টি দেখবেন। তিনি আরো বলেন, হোল্ডিং ট্যাক্সের এই কার্যক্রমটি সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর সময়ে নেয়া হয়েছিলো।
মন্তব্য করুন