হত্যা, চাঁদাবাজি, জমি দখলসহ হাফডজন মামলার আসামি রাজশাহীর শীর্ষ সন্ত্রাসী জহিরুল ইসলাম রুবেল রাজশাহী সিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর প্রার্থী। ৭ নম্বর ওয়ার্ডে তার প্রার্থী হওয়ার খবরে ভোটারদের মধ্যে বিরাজ করছে চরম আতঙ্ক। এ সন্ত্রাসীর ওপর বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নজরদারি রাখছেন বলেও জানা গেছে।
সূত্র জানায়, মাদক ও অস্ত্র জগতের ডনখ্যাত রুবেলের ইশারাতেই চলে রাজশাহী মহানগর ও এর আশপাশের অপরাধ জগৎ। নিজ এলাকা ছাড়াও নগরীর বেশ কয়েকটি এলাকায় রয়েছে তার দুর্ধর্ষ ক্যাডার বাহিনী ও শক্তিশালী মাদক সিন্ডিকেট। এ ক্যাডার বাহিনীর মাধ্যমেই জমি দখল, মাদক, জুয়া, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডসহ সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন রুবেল। হাফডজন মামলার আসামি হয়েও নির্বাচনী হলফনামায় তথ্য গোপন করে প্রার্থী হয়েছেন তিনি।
রুবেলের হলফনামা ঘেঁটে জানা গেছে, নগরীর চন্ডিপুরের বাসিন্দা এইচএসসি পাস রুবেল ব্যবসায়ী। বার্ষিক আয় ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা। বাসায় ১ লাখ ৫০ হাজার টাকামূল্যের ইলেকট্রনিকস সামগ্রী ও ১ লাখ ২০ হাজার টাকামূল্যের আসবাবপত্র রয়েছে। হত্যা, মাদক, অস্ত্র, পুলিশের ওপর হামলা এবং সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা চলমান। একটি হত্যা মামলায় খালাস পেয়েছেন বলে হলফনামায় উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু হলফনামার তথ্যের বাইরেও তার বিরুদ্ধে রয়েছে মামলা।
মামলার নথি অনুসন্ধানে জানা গেছে, রুবেলের বিরুদ্ধে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের পবা থানায় ২০১৩ সালের ২৪ অক্টোবর ৩০২/৩৪ ধারায় একটি মামলা হয়। যার এফআইআর নং-২০। ২০১৩ সালের ২২ জুলাই রাজপাড়া থানায় ৩২৩, ৩২৪, ৩২৬, ৩০৭, ৩৮০, ৪৪৮/৩৪ ধারার মামলার এজাহারভুক্ত আসামি রুবেল। রাজপাড়া থানায় ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর ১৪৩, ৪৪৮, ৩৮৫, ৩৭৯, ৪৩৫, ৪২৭, ৫০৬ ধারার মামলার আসামিও তিনি। ২০১১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ৩২৩, ৩২৫, ৩০৭, ৩৭৯ ধারার মামলাতেও রুবেল আসামি বলে জানা গেছে।
এ ছাড়া জমি দখলের অভিযোগ তুলে নগরীর হরগ্রাম পূর্বপাড়া (বাগান পাড়া) এলাকার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল ইসলাম গত বছরের ১৭ মে কাশিয়াডাঙ্গা থানায় একটি মামলা করেন। এসব মামলার কোনোটিই রুবেলের হলফনামায় উল্লেখ নেই।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, হলফানামায় পৈতৃক বাড়িতে বসবাসের বিষয়টি উল্লেখ করলেও রুবেলের রয়েছে বিলাসবহুল গাড়ি, বাড়ি ও সম্পদের পাহাড়। চন্ডিপুর এলাকায় নির্মিত হচ্ছে ছয়তলা বিশিষ্ট আলিশান বাড়ি। এ ছাড়া নগরীর নওদাপাড়া আমচত্বর এলাকায় আরও একটি আলিশান বাড়ি রয়েছে তার। রয়েছে বিলাসবহুল দুটি গাড়ি (প্রাইভেটকার) ও কয়েকটি মোটরসাইকেল। প্রাইভেটকার দুটির মধ্যে গত ২২ জানুয়ারি ৩৬ লাখ ২ হাজার টাকামূল্যের একটি নতুন গাড়ি রাজশাহীর শোরুম থেকে ১৫ লাখ টাকা ডাউন পেমেন্টে ক্রয় করেন রুবেল। ৪ মাস অতিবাহিত হলেও বাকি ২১ লাখ ২ হাজার টাকা পরিশোধ এখনো পরিশোধ করা হয়নি বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। অথচ নির্বাচনী হলফনামায় তার কোনো প্রাইভেটকার নেই উল্লেখ রয়েছে। এমনকি হলফনামায় তার কোনো ঋণ বা দেনা নেই বলা হয়েছে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, একসময়ের রাজশাহী মহানগর বিএনপির দুর্ধর্ষ নেতা শফিকুল ইসলাম ওরফে কানা শফিকের (বছর দেড়েক আগে নগরীর দাশপুকুর এলাকায় জমি দখলের সময় প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত) হাত ধরে রুবেলের উত্থান। এরপর সড়ক ও জনপথের বিভিন্ন টেন্ডারবাজির মাধ্যমে ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করতে থাকে রুবেলের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। এরপর এলাকায় প্রভাব বিস্তার করতে আরেক সন্ত্রাসী মাহাফুজের সঙ্গে গড়ে তোলেন ‘মায়া’ নামে একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ। এ মায়া গ্রুপ গড়ে তোলা থেকে শুরু করে সব ধরনের সহযোগিতা করতেন রুবেল এবং তার বড় ভাই ও ভাগ্নে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, রাসিকের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের প্রায় সব কেন্দ্রই ঝুঁকিপূর্ণ। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মাঠে নানা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে এ ওয়ার্ডের কেন্দ্রগুলোকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ বা গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে নির্বাচন কমিশনে রিপোর্ট দিয়েছেন।
নগরীর ডিঙ্গাডোবা বাগানপাড়ার মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশের আইজিপিসহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করেছেন রুবেলের বিরুদ্ধে। আমিনুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘আমি ১৯৮১ সালে পগি ঘোষ নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ১.৬৬ একর জমি ক্রয় করি। ক্রয়সূত্রে এ জমির মালিক আমি এবং আমার বৈধ কাগজপত্র সবই আছে। এখানেই ৫ কাঠা জমিতে বাড়ি করেছি। তখন থেকেই জমিটি ভোগদখল করে আসছি। কিন্তু হঠাৎ রুবেল, রকি ঘোষসহ ভুমিদস্যুরা জোরপূর্বক আমার জমি দখল করে এর চারপাশে সীমানা প্রাচীর দেয়। পরে আমার জমি বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করে দিয়েছে। আমি আদালতে মামলাও করেছি। দুটি ডিক্রিও পেয়েছি। তার পরও আদালতের আদেশ অমান্য করে তারা এসব করেছে। আমি এখন নিঃস্ব।’
এ ব্যাপারে জানতে রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রকি কুমার ঘোষকে একাধিকবার ফোন করা হলে তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন নম্বরটি বন্ধ পাওয়া য়ায়। ৭ নম্বর ওয়ার্ডের এক ভোটার জানান, রুবেলের কোনো দল নেই। প্রথমে তিনি বিএনপির রাজনীতি করতেন। এখন রাজশাহীর প্রভাবশালী আওয়ামী লীগারদের সঙ্গে আঁতাত করে মিলেমিশে জমি দখল, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। শুনলাম, তিনি নাকি কাউন্সিলর প্রার্থী। এ নিয়ে আমরা চরম আতঙ্কিত।
অভিযুক্ত জহিরুল ইসলাম রুবেলের মোবাইল ফোনে অসংখ্যবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তার বাড়িতে এবং সম্ভাব্য স্থানগুলোতে খোঁজ নিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। এমনকি প্রতিবেদকের পরিচয় দিয়ে খুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।
৭ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর ও কাউন্সিলর প্রার্থী মতিউর রহমান মতি বলেন, ‘নির্বাচনী আচরণবিধি যাতে কেউ লঙ্ঘন করে বিশেষ সুবিধা হাসিল করতে না পারে, সেদিকে নির্বাচন কমিশনকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। ওয়ার্ডের প্রতিটি কেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ। আমি চাই, এ ওয়ার্ডের ভোটাররা যাতে নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন।’
আরএমপির অতিরিক্ত কমিশনার বিজয় বসাক কালবেলাকে বলেন, ‘তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা আছে কি না, সেগুলো নথি না দেখে বলতে পারব না। কোনো তথ্য গোপন করলে অবশ্যই সেটি নির্বাচন কমিশন খতিয়ে দেখবে। তিনি যদি অবৈধ কিংবা বৈধ অস্ত্র প্রদর্শন করে থাকেন, তাহলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ রাসিক নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘প্রার্থীদের মামলা থাকতেই পারে। তার বিষয়ে কেউ অভিযোগ করেনি। কেউ অভিযোগ করলে সেটি কোথায় যাবে না যাবে, সে ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
মন্তব্য করুন