বিএনপি নেতা ইশরাককে মেয়র ঘোষণা করে গেজেট জারি ও শপথ পড়ানোর ইস্যুটি পুরোটাই নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে বলে মন্তব্য করেছেন আপিল বিভাগ। আদালত বলেছেন, আইন, বিষয়বস্তুসহ অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করে, আমাদের মতামত হচ্ছে, এই মামলায় যে ইস্যুটি উত্থাপন করা হয়েছে এর পুরোটাই ছিল নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক এখতিয়ারাধীন বিষয়।
ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ঘোষণা করা নির্বাচন কমিশনের (ইসি) গেজেটের কার্যকারিতা স্থগিত চেয়ে করা লিভ টু আপিল পর্যবেক্ষণসহ নিষ্পত্তি করে দেওয়া রায়ে এই অভিমত দেওয়া হয়েছে। এর আগে গত ২৯ মে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির বেঞ্চ ওই রায় দেন। গতকাল দুই পৃষ্ঠার ওই রায়ের অনুলিপি প্রকাশিত হয়।
রায় প্রকাশের পর ইশরাকের আইনজীবী ব্যারিস্টার একেএম এহসানুর রহমান বলেন, ইশরাক হোসেনকে বিজয়ী ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশের পর ইলেকশন কমিশন বিগত ২৮ এপ্রিল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করে। এখানে ‘পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা’ বলতে স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইনের ধারা ৭(২)-এর দিকে ইংগিত করে। এই আইন অনুযায়ী শপথ পড়ানোর দায়িত্ব স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু অতীব আশ্চর্যের বিষয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বিগত ৫ মে চিঠির মাধ্যমে ইলেকশন কমিশনের কাছে ‘নির্দেশক্রমে অনুরোধ’ করে জানতে চায় রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে কিনা বা অন্য কোনো আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে কি না, যা তাদের এখতিয়ারবহির্ভূত এবং স্বাধীন নিবার্চন কমিশনের ওপর অযাচিত হস্তক্ষেপ। এর উত্তরে ইলেকশন কমিশন বিগত ১২ মে চিঠির মাধ্যমে জানিয়ে দেয় যে, ইশরাক হোসেনকে বিজয়ী ঘোষণা করে প্রচারিত রায়ের বিরুদ্ধে তারা আপিল করবে না বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
এই আইনজীবী আরও বলেন, আজকে আপিল বিভাগ ইশরাক হোসেনকে শপথ না পড়াতে দায়ের করা রিটের খারিজের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত লিভ টু আপিল নিষ্পত্তির রায়ে নির্বাচন কমিশনই যে উত্থাপিত বিষয়বস্তুর ব্যাপারে সাংবিধানিকভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত সেটা মনে করিয়ে দিয়েছেন। হাইকোর্টের খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে কোনো স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়নি। তার মানে দাঁড়ায় ইশরাক হোসেনের শপথ নিতে আইনগত কোনো বাধা নেই।
২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হয়। তাতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস মেয়র নির্বাচিত হন। নির্বাচন কমিশন ২ ফেব্রুয়ারি ভোটের ফলাফলের গেজেট প্রকাশ করে। এরপর শপথ নিয়ে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন তাপস। সেই নির্বাচনে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র পদে তাপস পেয়েছিলেন সোয়া চার লাখ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী ইশরাক পান দুই লাখ ৩৬ হাজার ভোট। নির্বাচনে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ফল বাতিল চেয়ে ২০২০ সালের ৩ মার্চ মামলা করেন বিএনপি নেতা ইশরাক। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের আগস্ট মাসে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের সব সিটি করপোরেশনের মেয়রদের অপসারণ করা হয়। এরপর ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন অতিরিক্ত সচিব শাহজাহান মিয়া।
এর মধ্যে গত ২৭ মার্চ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২০২০ সালের নির্বাচনে ফজলে নূর তাপসকে বিজয়ী ঘোষণার ফল বাতিল করে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করেন ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. নুরুল ইসলাম। আদালত ১০ দিনের মধ্যে গেজেট প্রকাশের নির্দেশ দেন। এ রায় পাওয়ার পর ২৭ এপ্রিল গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন। এদিকে গেজেট প্রকাশের দিন ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ঘোষণা করে দেওয়া রায় ও ডিক্রির বিরুদ্ধে আপিল করতে আইনি নোটিশ দেন রফিকুল ইসলাম ও মামুনুর রশিদ নামে দুই ব্যক্তি। নোটিশে গেজেট প্রকাশ এবং ইশরাককে শপথ নেওয়া থেকে বিরত থাকতে বলা হয়।
পরে মামুনুর রশিদ হাইকোর্টে রিট করেন। রিটে ২৭ মার্চের রায় এবং ২৭ এপ্রিলের গেজেট কেন বেআইনি হবে না এবং ইশরাক হোসেনের শপথ পরিচালনা থেকে বিরত রাখার নির্দেশনা কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারির আর্জি জানানো হয়। এ রুল বিবেচনাধীন থাকা অবস্থায় রায় ও গেজেটের কার্যক্রম স্থগিত চাওয়া হয়। রিট আবেদনটির শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট গত ২২ মে সরাসরি খারিজ করে আদেশ দেন। ওই খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল করা হয়।
মন্তব্য করুন